ঘুষের সম্রাট সরাইল থানার দারোগা আবু বক্কর সিদ্দিক
সরাইল প্রতিনিধিঃ আবু বক্কর সিদ্দিক । সরাইল থানার একজন সাব ইন্সপেক্টর। থানা এলাকা জুড়েই ছড়িয়ে পড়েছে তার নাম। তবে সেটি আইন প্রয়োগ বা অপরাধ দমনের জন্যে নয়। ঘুষ খাওয়ার পারদর্শীতার কারনেই নাম হয়েছে তার। অভিযোগ টাকা পেলে সব করতে পারেন এই দারোগা। ডাকাত হয়ে যায় তার কাছে ভালো মানুষ। আর নিরীহ লোকজন হয় মামলার আসামী। রিমান্ড তার কাছে বড় বানিজ্য। যেকোন উপায়ে টাকা কামাই করাই যেন তার বড় দায়িত্ব। বেপড়োয়া এই দারোগার কাছে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাও অসহায় হয়ে পড়েন অনেক সময়। অনুসন্ধানে জানা যায়, এস আই সিদ্দিক সরাইল থানায় যোগদেন মাস ছয়েক আগে। এর আগে ছিলেন নবীনগর থানায়। সরাইলে যোগদানের পর অল্প সময়েই নিজেকে পরিচিত করে তুলেছেন। চোর, ডাকাত, সাধারণ মানুষ সবাই জেনে গেছে তার বিশেষ গুনের কথা। এলাকার একাধিক ডাকাতের বক্তব্য – টাকা খাওয়ার জন্য সিদ্দিক স্যার বেটা। আর জনপ্রতিনিধিরা বলেন সে ডাকাতেরও ডাকাত। ডাকাতি মামলা থেকে বাদ দেয়ার কথা বলে সর্বোচ্চ ২ লাখ টাকা ঘুষ নেয়ার ঘটনা ব্যাপক আলোচিত করে তুলেছে তাকে । সরাইল সদরের সৈয়দটুলা গ্রামের ফারুক ও শামীমের পরিবারের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনায় ১৭ জুলাই ফারুক বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন সরাইল থানায়। মামলা তদন্তের দায়িত্ব পান এস আই সিদ্দিক। এরমধ্যেই গ্রামের লোকজন সামাজিক ভাবে বিরোধ নিস্পত্তি করে ফেলে। দু-পক্ষের আপোষে আসে। শামীম জানায়, আপোষনামা নিয়ে থানায় গেলে সিদ্দিক স্যার ৪০ হাজার টাকা দাবী করেন। গত ১৫ মার্চ গভীর রাতে সদর ইউনিয়নের কুট্টাপাড়াপাড়া গ্রামের আবুল কালামের বসত বাড়িতে দূর্ধর্ষ ডাকাতির ঘটনা ঘটে। পরের দিন ১৬ মার্চ অজ্ঞাত লোকজনকে আসামী করে সরাইল থানার একটি জিডি করেন আবুল কালাম। এর তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় এস আই সিদ্দিককে। তদন্তের দায়িত্ব নিয়ে তিনি নেমে পড়েন মাঠে। ১৬ মার্চ সকালে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার করেন নোয়াহাটি গ্রামের আরমান, কুট্টাপাড়ার মোর্শেদ, কালিকচ্ছের রুবেলকে। ঐসময়ই বাদী কালামের ভাতিজা আরব আলীকে তার নিজ বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করেন সিদ্দিক। ভাতিজা গ্রেপ্তারের খবরে পাগল হয়ে যান কালাম। কালাম তার আত্মীয় স্বজনকে নিয়ে চেষ্টা তদবির করে আরব আলীকে থানা থেকে বের করে আনেন। আরব আলীর পিছু লাগে সিদ্দিক। এস আই সিদ্দিক আরব আলীকে এই বলে হুমকি দেয়- গ্রেপ্তারকৃত হেলাল তোর নাম বলেছে। তোকে এই মামলায় আসামী করা হবে। আসামীর তালিকা থেকে নাম কাটাতে হলে টাকা দিতে হবে। আরব আলী জানায়, আমার চাচার ঘর ডাকাতি হয়েছে। ধরে নিয়েছে আমাকে। থানায় নিয়ে অযথা আমাকে প্রহার করেছে। মামলা থেকে নাম কাটার কথা বলে সিদ্দিক স্যার আমার কাছ থেকে দু’দফায় ২৩ হাজার টাকা নিয়েছেন। বাদী আবুল কালাম দুঃখ করে বলেন, পুলিশ পারে না এমন কাজ দুনিয়াতে নেই। আমার ঘর ডাকাতি হল। তারা গ্রেপ্তার করল আমার ভাতিজাকে। আবার টাকাও নিল। বড় দেওয়ান পাড়া গ্রামের বাসিন্দা উপ-সহকারি খাদ্য কর্মকর্তা মোঃ জাকির হোসেনের পরিবারে জায়গা-জমি নিয়ে বিরোধ চলছিল দীর্ঘদিন যাবৎ। এর জের ধরে জাকির হোসেনের বিরুদ্ধে তার চাচাত ভাইয়ের স্ত্রী রতনা বেগমকে ফুসলিয়ে কিছু লোক নারী নির্যাতন মামলা করিয়ে দেয়। বিষয়টি ছিল পুরো পরিবারের অজানা। প্রতিপক্ষের লোকজন এস আই সিদ্দিকের সাথে মোটা অংকের টাকায় জাকিরকে গ্রেপ্তারের চুক্তি করে। কোন গ্রেপ্তারী পরোয়ানা নেই। থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাও কিছু জানেন না। ১ লা মে রাত ১২টায় জাকিরের বাড়িতে হানা দেয় এসআই সিদ্দিকের নেতৃত্বে একদল পুলিশ। কি অভিযোগ জানতে চাইলে তাকে ধমক দিয়ে সিদ্দিক বলেন, থানায় চলেন। জাকিরকে রাখা হয় থানা হাজতে। সকালে তার স্বজনরা গ্রেফতারী পরোয়ানা দেখতে চাইলে শুরু হয় তালবাহানা। সিদ্দিকের একান্ড নিয়ে আলোচনা চলতে থাকে থানার অন্যান্য পুলিশ সদস্যদের মধ্যে। ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে এর কোন সদুত্তর দিতে পারেনি সিদ্দিক। দীর্ঘ সময় অপোর পর জাকিরের স্বজনরা উত্তেজিত হয়ে পড়েন।জাকির হোসেন আক্ষেপ করে বলেন, টাকা পেলে পুলিশ সব পারে। মিথ্যা ভিত্তিহীন ষড়যন্ত্র মূলক মামলায় কোন কাগজ ছাড়াই আমাকে গ্রেপ্তার করল। অথচ থানায় সহস্রাধিক ওয়ারেন্ট পড়ে আছে। আসামী ধরার নাম নেই। থানা থেকে মাত্র ৫০ গজ দূরে মাদক সম্রাজ্ঞী খ্যাত আবেদা ও দুইশত গজ দূরে লিল বানুর আস্তানায় এখন দেদারছে চলছে মাদক ব্যবসা। এস আই সিদ্দিকের সাথে তাদের সখ্যতার বিষয়টি চাউর রয়েছে গোটা এলাকায়। গত ২০ আগষ্ট সদর ইউনিয়নের সৈয়দটুলা গ্রামের গড়েরপাড় এলাকার বাসিন্ধা জামিনে থাকা আসামী আবু মিয়াকে গ্রেপ্তার করতে যায় সিদ্দিক। জামিনের কথা বলার পরও তাকে গ্রেপ্তার করে থানায় নিয়ে যায়। আবুর পরিবারের অভিযোগ থানায় নিয়ে পুলিশ আবুকে বেধড়ক পেটায়। পরে গুরুতর আহত আবুকে প্রথমে সরাইল উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ও পরে জেলা সদর হাসপাতালে প্রেরন করা হয়। একই রাতে জামিনে থাকা আরেক আসামী ওয়াসিম মিয়াকে গ্রেপ্তারের পর থানা কাষ্টরিতে রাখেন সিদ্দিক। এক ঘন্টা পর ওয়াসিমের স্বজনরা রিকল নিয়ে গেলে তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় পুলিশ। সেখানেও বাণিজ্য জড়িত। সম্প্রতি মেঘনা নদীতে ডাকাতির ভাগ বাটোয়ারা নিয়ে গভীর রাতে দু’দল ডাকাতের মধ্যে বন্ধুক যুদ্ধ হয়। এতে নিহত হয় অরুয়াইল রাজাপুর গ্রামের ডাকাত আসাদ উল্লাহ (২৩)। পরের দিন সকালে পুলিশ নিহত ডাকাতের লাশ উদ্ধার করে। এ ঘটনায় এস আই সিদ্দিক নৌ ডাকাত কাওছারকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের পর তার স্বজনদের কাছে মামলা থেকে বাদ দেয়ার কথা বলে মোটা অংকের টাকা দাবী করেন। কাওছারের একাধিক অভিভাবক জানান, এরপর আমরা সিদ্দিক স্যারকে দুই লাখ টাকা দেই। কিন্তু তারপরও কাওছারকে আসামী করা হয়েছে। মামলার ভয় দেখিয়ে ডাকাত আবুল কাশেমের কাছ থেকেও টাকা নিয়েছেন সিদ্দিক। ধামাউড়া গ্রামে দু’গোষ্ঠীর সংঘর্ষের পর নিরীহ লোকদের ধর পাকড় ও হুমকি ধমকি দিয়ে তার বাণিজ্যের বিষয়টি চাউর রয়েছে গোটা অরুয়াইলে। বাজারের অনেক ব্যবসায়ীকে সুযোগে শোষন করেছেন তিনি। গ্রেপ্তারের ভয়ে তারা এসব সহ্য করেছেন নিরবে। পাকশিমুলের আবদুল জাহেরের পুত্র অরুয়াইল কলেজের ডিগ্রী পড়–য়া ছাত্র দুলালকে গত ২৩ মার্চ পিটিয়ে গুরুতর আহত করে অরুয়াইলের লোকজন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় ২৬ মার্চ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে দুলাল মারা যায়। ছেলে হত্যার বিচারের আশায় জাহের মিয়া বাদী হয়ে থানায় একটি মামলা দায়ের করেন। আই ও এস আই সিদ্দিক। আবদুল জাহের চোখের পানি ছেড়ে দিয়ে বলেন, পৃথিবীতে গরীবের জন্য কেউ নেই। ছেলের হত্যাকারীরা প্রকাশ্যে ঘুরলেও পুলিশ ধরে না। আসামী ধরার কথা বলে সিদ্দিক স্যার ১৯ হাজার টাকা নিল। কিন্তু ফলাফল শুন্য। এ মামলায় আমার এ পর্যন্ত ১ লাখ ৬০ হাজার টাকা খরচ হয়েছে। পুলিশের কাছ থেকে এক পয়সার সহযোগিতাও পায়নি। চুন্টার লোপাড়া গ্রামের শুক্কুর মিয়ার দিন মজুর ছেলে ফরিদ(৩৬) অরুয়াইলে বাজার করতে গিয়ে রহস্যজনক ভাবে জাল টাকা সহ পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। অভিযোগ এক ব্যবসায়ীর ইশারায় এস আই সিদ্দিক ওই ছেলের কাছ থেকে একটি পাঁচশত টাকার জাল নোট উদ্ধার করে। তাকে আটক করে নিয়ে যায় ফাঁড়িতে। এরপর তাকে ছাড়িয়ে নিতে দশ হাজার টাকা চেয়ে বসেন সিদ্দিক। নিরুপায় হয়ে একজন ইউপি সদস্যের মধ্যস্থতায় আট হাজার টাকা দিয়ে ছাড়া পায় ফরিদ। ইউপি সদস্য বলেন, সুদে টাকা এনে সিদ্দিক স্যারকে দিয়েছে দিন মজুর ফরিদ। আদৌ সে ওই আট হাজার টাকার সুদের বুঝা টানছে। এটা অত্যন্ত অমানবিক। জয়ধরকান্দি গ্রামের সামছুল ইসলাম জানান, আমাদের দুটি মামলার আইও সিদ্দিক স্যার। এ পর্যন্ত ১৫/১৬ হাজার টাকা খরচ করেছি। সামাজিক ভাবে আমরা আপোষ নিস্পত্তি করেছি। এখন টাকা ছাড়া তিনি মামলার ফাইনাল দিবেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন। তেলিকান্দি গ্রামে নুরু মিয়া হত্যা মামলা সহ ৪/৫টি মামলাকে পুঁজি করে বিশেষ কৌশলে টুপাইস কামানোর বিষয়টি চাউর রয়েছে গোটা ইউনিয়নে। চুন্টা গ্রামের উত্তর পাড়ার কুয়েত প্রবাসী আকবরের বাড়িতে ডাকাতির ঘটনায় এস আই সিদ্দিক জুটন (২৫) ও রসুলপুর গ্রামের মাফুজ (২২) কে গ্রেপ্তার করেন। পরে তিনি জুটনের স্বজনদের কাছে উৎকোচ দাবী করেন। তারা সিদ্দিককে ৩০ হাজার টাকা দেন। অরুয়াইল, পাকশিমুল ও চুন্টা এলাকার একাধিক জনপ্রতিনিধি ও গন্যমান্য ব্যক্তি বলেন, এস আই সিদ্দিক এ পর্যন্ত তিন ইউনিয়ন থেকে কম করে হলেও বিশ লাধিক টাকা কামাই করেছেন। সরাইলের উত্তরাঞ্চলের একজন প্রভাবশালী জনপ্রতিনিধি দুঃখ করে বলেন, এস আই সিদ্দিক ডাকাতের চেয়ে বড় ডাকাত। তবে এস আই আবু বক্কর সিদ্দিক সকল অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, সব মিথ্যা। আপনারা যাচাই করে দেখেন। আমি এখানে বিনে পয়সায় মানুষকে সেবা দিচ্ছি। নিজের পকেটের টাকা খরচ করে ডাকাত ধরছি। শুধুমাত্র মানুষকে ভাল রাখার জন্য। আমি সরাইলে ডাকাতের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষনা করেছি। আমার শক্ত অবস্থান না থাকলে সরাইলের ঘরে ঘরে ডাকাতি হত। এসব অভিযোগ ডাকাতদের ষড়যন্ত্র কিনা দেখতে হবে। আরব আলীকে সন্দেহ ভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার করেছিলাম। পরে ছেড়ে দিয়েছি। অরুয়াইলের কাউছারকে তিনটি অস্রসহ গ্রেপ্তার করেছি। সে জেল হাজতে আছে। যারকাছ থেকে অস্র উদ্ধার হল তাকে মামলা থেকে বাদ দিব কিভাবে? গ্রেপ্তারি পরোয়ানা ছাড়া খাদ্য কর্মকর্তা জাকিরকে কে গ্রেপ্তার করেছে আমি জানি না। |