Main Menu

আল্লামা মোহাম্মদ আলীর জানাজায় মানুষের ঢল

+100%-

মোহাম্মদ মাসুদ : সরাইলের শতবর্ষী এ আলেমে দ্বীন ওস্তাজুল ওলামা আল্লামা শাঈখ মোহাম্মদ আলী কাসেমী (রহঃ) গত রোববার রাতে বার্ধক্যজনিত কারনে ইন্তেকাল করেন (ইন্নালিল্লাৃ..রাজিউন)। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ১০৩ বছর। সরাইল সদর ইউনিয়নের কুট্টাপাড়া গ্রামে ক্বারী মো. আবদুল হেকিমের ৮ সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন পঞ্চম।

মাওলানা মোহাম্মদ আলী জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার সরাইল প্রতিনিধি, সরাইল প্রেসক্লাবের সভাপতি ও মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ বদর উদ্দিনের পিতা। তাঁর জীবনের অধিকাংশ সময়ই ইসলামী কর্মকা-ে ব্যয় করেছেন। অসামাজিক কর্মকা-ের বিরুদ্ধে তাঁর লড়াই সংগ্রামের ইতিহাসও সুদীর্ঘ। সোমবার তাঁর জানাজায় মানুষের ঢল নেমেছিল। সকাল ১১টা থেকেই জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে লোকজন আসতে শুরু করে। সময় বৃদ্ধির সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে লোকজনের উপস্থিতি। উনার বাড়ি সংলগ্ন খেলার মাঠটি এক সময় কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। জেলা এবং জেলার বাহিরের আলেম উলামা, জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ, উকিল, সাংবাদিক, মসজিদের ইমাম, মাদরাসার শিক্ষক ও অগণিত শিক্ষার্থীরা হাজির হয় উনাকে শেষ বারের মত একনজর দেখে জানাজায় শরিক হতে। এক সময় গোটা মাঠটিতে আর তিল ধরার জায়গা ছিল না। বাদ যোহরের কথা থাকলেও জানাজা অনুষ্ঠিত হয় পোনে তিনটায়।

উনার জানাজার ইমামতি করেন হযরত মাওলানা সাজিদুর রহমান।

জানাজার পূর্বের আলোচনায় বক্তব্য রাখেন- উনার ছেলে মাওলানা কুতুব উদ্দিন, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের সাবেক এমপি অ্যাডভোকেট জিয়াউল হক মৃধা, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান রফিক উদ্দিন ঠাকুর, মাও. জুনায়েদ আল-হাবিব, মাওলানা মুবারক উল্লাহ, মাওলানা আবুল কাশেম, মাও. জহিরুল ইসলাম প্রমূখ।

পারিবারিক ও স্থানীয় আলেম ওলামাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, শৈশবকাল থেকেই আল্লামা মোহাম্মদ আলী ছিলেন খুবই বিনয়ী ও শান্ত স্বভাবের। গ্রামের মক্তবে তিনি ক্বারি আনসারিয়ার কাছে থেকে আরবি ফার্সি ও উর্দু ভাষায় ইসলামি শিক্ষার তালিম (পাঠ গ্রহণ) নেন। কিছুদিন সরাইল ফার্সি মাদরাসায় (দেওয়ান বাড়িতে অবস্থিত-পরে বিলুপ্ত) অধ্যয়ন করেন। পরে মালিহাতা গ্রামের বাসিন্দা মাওলানা আবদুল আলী (রাহ.) প্রতিষ্ঠত জামিয়া ইসলামিয়া তাজুল উলুম মাদরাসায় ভর্তি হন। মালিহাতা মাদরাসায় পাঠ গ্রহণ শেষে ভর্তি হন আল্লামা তাজুল ইসলাম (ফখরে বাঙ্গাল) পরিচালিত ব্রা‏‏হ্মণবাড়িয়া জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুসিয়া মাদরাসায় । জামিয়ায় অধ্যয়ন শেষে ১৯৪৫ খ্রি.চলে যান বিশ্বের অন্যতম প্রধান ইসলাম ধর্মীয় শিক্ষালয় ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদরাসায়। অল্প দিনের মধ্যে তিনি তৎকালীন বিশ্ববরেণ্য আলেমে দ্বীন কুতুবে আলম আল্লামা হুসাইন আহম্মদ মাদানীর প্রিয়ভাজন হয়ে ওঠেন। সেখানে তিনি বৃত্তিলাভ করে বিনা খরচে অধ্যয়নের সুযোগ লাভ করেন। সেখানে সর্বোচ্চ সনদ দাওরায়ে হাদীস লাভ করে ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর তিনি দেশে ফিরেন। যোগদান করেন ওস্তাদ ফখরে বাঙ্গালের মাদরাসায়। কয়েক মাস পরই ওস্তাদের নির্দেশে ফিরে যান মালিহাতা মাদরাসায়। যোগদানের পর থেকে মৃত্যুও আগ পর্যন্ত তিনি ওই মাদরাসায় প্রতিষ্ঠান প্রধান হিসেবে সাত দশক ধরে অত্যন্ত দক্ষতা নিষ্ঠা ও সততার সাথে দায়িত্ব পালন করে আসছেন। একই সময় থেকে তিনি আনসারিয়া মো‏হাম্মদীয়া ঈদগা মাঠে (কুট্টাপাড়া,খাঁটিহাতা ও বেতবাড়িয়া গ্রামের যৌথ ঈদগা মাঠ) ও খাঁটিহাতা জামে মসজিদে খতিবের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। একই সাথে ওই ঈদগা মাঠের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছিলেন।

তিনি ১৯৮০ সালে দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসায় অনুষ্ঠিত বিশ্বের বড় বড় ওলামাদের সম্মেলনে যোগ দান করেন। ওই বছর তিনি খেলাফত লাভ করেন। দীর্ঘ তিন যুগ পরও তিনি নিজেকে এভাবে উপস্থাপন করেননি। তিনি প্রতিষ্ঠা করেছেন অসংখ্য মসজিদ ও মাদরাসা। তৈরী করেছেন অর্ধলক্ষাধিক আলেমে দ্বিন। হাজার হাজার ওয়াজ ও তফছির মাহফিলেন সভাপত্বি করেছেন।সুদীর্ঘ বর্ণাঢ্য জীবনের অধিকারী আল্লামা শাঈখ মোহাম্মদ আলী অনেক বন্ধুর পথ অতিক্রম করেছেন। অনৈসলামিক কাজের বিরোধীতা করতে গিয়ে ভোগান্তিতে পড়েছেন একাধিকবার। বৃদ্ধ বয়সে কারাবরণও করেছেন। ’৭০দশকে কুট্টাপাড়ায় ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের পাশে (কুট্টাপাড়া খেলার মাঠ সংলগ্ন) কালাশাহ’র কাল্পনিক আসন দরগা (মাজার) তৈরি করে শিরক ও বেদাআদ করতে থাকে নিজ গ্রোত্রের লোকজন। মাজার সমর্থকরা ওরসের নামে কুট্টাপাড়া খেলার মাঠে চালু করেছিল অনৈসলামিক কাজ। দীর্ঘ আন্দোলনের পর ’৮৪ সালে কাল্পনিক মাজার উচ্ছেদ করতে সক্ষম হন। ওই বছর থেকেই কুট্টাপাড়া মাঠে হেফাজতে ইসলাম নামের এক সংগঠনের মাধ্যমে ওয়াজ ও তফসির মাহফিলেন অয়োজন করেন।একই দশকে সরাইল অন্নদা উচ্চ বিদ্যালয় (বর্তমানে সরকারি) মাঠে চালু করা হয় মেলার নামে জুয়া ও অনৈসলামিক কাজ। এর প্রতিবাদে সহপাঠি উপজেলা সদরের আলীনগর গ্রামের বাসিন্দা আল্লামা সিদ্দুকুল্লাহ কাসেমীকে (রাহ.) নিয়ে ’৭৫ সাল থেকে ওই মাঠে চালু করেন ওয়াজ ও তফসির মাহফিল। আল্লামা সিরাজুল ইসলাম (বড় হুজুর রাহ.) এখানে পবিত্র কোরআন তফসির করতেন। স্বল্প সময়ের মধ্যে এটি সরাইল উপজেলার সবচেয়ে বড় তফসির মাহফিল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেন। ১৯৯৭ সালে তিনি হজ্বব্রত এবং ২০১৪ সালে ওমরা পালন করেন। তিনি ছয় ছেলে ও সাত মেয়ের জনক। প্রথম আলোর সরাইল প্রতিনিধি মোহাম্মদ বদর উদ্দিন তাঁর তৃতীয় ছেলে। তিনি ছিলেন শান্তির প্রতীক। শিরক-কুফর-ফেতনা ও বাতেল বিরোধী আন্দোলনের জীবন্ত ইতিহাস। বর্তমানে তিনিই ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সবচেয়ে বয়স্ক আলেমে দ্বীন। গতকাল সোমবার বাদ জোহর কুট্টাপাড়া খেলার মাঠে অর্ধলক্ষাধিক মুসল্লির উপস্থিতিতে তাঁর প্রথম জানাজা এবং শেষে জামিয়া ইসলামিয়া তাজুল উলুম মাদ্রারা প্রাঙ্গণে তাঁকে দাফন করা হয়েছে।






Shares