১০ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ জাতীয় বীর আবদুল কুদ্দুস মাখনের ২৫তম মৃত্যুবার্ষিকী।
স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্য, মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, ডাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সংসদ সদস্য জাতীয় বীর আবদুল কুদ্দুস মাখন ১৯৪৭ সালের ১লা জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের মৌড়াইল গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। পিতা-মরহুম মোহাম্মদ আবদুল আলী এবং মাতা-মরহুমা আলহাজ্ব আমেনা খাতুন। সাত ভাই ও দুই বোনের মধ্যে জনাব মাখন ছিলেন তৃতীয়।
তিনি একজন অত্যন্ত মেধাবী ছাত্র ছিলেন। ১৯৬২ সালে তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া নিয়াজ মোহাম্মদ হাই স্কুল থেকে মানবিক শাখায় ১ম বিভাগ পেয়ে কৃতিত্বের সাথে মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। স্কুল জীবনেই তাঁর ছাত্র রাজনীতির গোড়াপত্তন। ১৯৬২ সালের শিক্ষা আন্দোলনে তৎকালীন ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমার স্কুল ছাত্র/ছাত্রীদের সংগঠিত করে ছাত্র আন্দোলনে এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ থেকে ১৯৬৪ সালে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগে অনার্স ক্লাশে ভর্তি হন। অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যে তিনি গোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সমাজে পরিচিত হয়ে উঠেন এবং ছাত্রলীগের নেতৃত্বে আসীন হন।
বঙ্গবন্ধুর ঘোষিত ছয় দফা আন্দোলনে তিনি সক্রিয়ভাবে জড়িত থেকে ছাত্র সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করতে ব্যাপক প্রয়াস নেন এবং ছাত্র আন্দোলনকে গতিশীল করতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। তিনি ১৯৬৬-৬৭ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হল ছাত্র সংসদের সহ সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৬৮-১৯৬৯ সালে ফজলুল হক হল ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ছাত্র নেতা হিসাবে ৬৯’র গণঅভ্যুত্থানে তিনি ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান করেন এবং ছাত্র-জনতার ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনকে সুসংহত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৬৯ সালে এম এ পাশ করে একই বৎসরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৭০ সালে তিনি সর্ব প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের প্রত্যক্ষ ভোটে ডাকসুর সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং তৎকালীন ডাকসুর নেতৃত্বে গোটা ছাত্র সমাজকে ছাত্রলীগের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ করে প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে অসামান্য গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
১৯৭১ সালে ১লা মার্চ গঠিত স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের চার সদস্যের অন্যতম সদস্য জনাব আবদুল কুদ্দুস মাখন। চার খলিফা বলে খ্যাত স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অপর তিন সদস্য হলেন জনাব নূরে আলম সিদ্দিকী, জনাব শাহজাহান সিরাজ ও জনাব আ স ম আবদুর রব। স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক ২রা মার্চ ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সম্মুখে সর্ব প্রথম স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়। ৩রা মার্চ পল্টন ময়দানের ঐতিহাসিক ছাত্র জনসভায় স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার দৃপ্ত শপথ গ্রহণ করা হয় এবং এই ঐতিহাসিক জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থিতিতে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে স্বাধীনতার প্রথম ইস্তেহার পাঠ করা হয় এবং এই ইস্তেহারেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের সর্বাধিনায়ক এবং বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীত নির্ধারণ করে ঘোষণা প্রদান করা হয়। উল্লেখ্য, এই জনসভার এক প্রস্তাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে জাতির পিতা হিসাবে উল্লেখ করা হয়। স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক স্বাধীনতার ইস্তেহার পাঠের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই ঐতিহাসিক জনসভায় অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দেন। গোটা জাতি এই অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ডাকে সাড়া দেন। স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এই অহিংস অসহযোগ আন্দোলনে অনন্য অসাধারণ ভূমিকা পালন করে।
৭ই মার্চ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণে বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার দিক নির্দেশনা প্রদান করেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দেশবাসীকে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামে লিপ্ত করার প্রয়াসে অতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ২৩ শে মার্চ পল্টন ময়দানে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ জয় বাংলা বাহিনীর কুচকাওয়াজের অভিবাদন গ্রহণ করেন। এই সমাবেশেই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করা হয়। ঐদিনই ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ৩২নং ধানমন্ডির বাসায় বঙ্গবন্ধুর হাতে স্বাধীন বাংলার পতাকা তুলে দেন এবং বঙ্গবন্ধু ৩২নং বাসভবনে উৎফুল্ল জনতার মাঝে স্বাধীন বাংলার এই পতাকা তুলে ধরেন। ঐদিন ঢাকাসহ সর্বত্র স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলিত হয়। স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে এ দেশের ছাত্র-জনতা সুসংগঠিত হয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিটি আন্দোলন ও কর্মসূচিতে।
২৬ শে মার্চের প্রথম প্রহরে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণার পর গোটা বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মহান মুক্তিযুদ্ধকে সুসংহত ও সুসংগঠিত করার কাজে ব্যাপক কার্যক্রম পরিচালনা করে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। বাংলাদেশের প্রতিটি এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদেরকে সুসংগঠিত করে প্রশিক্ষণ প্রদান ও মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় অতি গুরুত্বপূর্ণ ও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ। স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে সাড়া দিয়ে সমগ্র বাঙালি জাতি দীর্ঘ নয় মাস সশস্ত্র যুদ্ধে সীমাহীন ত্যাগ এবং অসম বীরত্ব প্রদর্শন করে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর ছিনিয়ে আনে আমাদের মহান বিজয়। অর্জিত হয় আমাদের মহান স্বাধীনতা। স্বাধীনতা আন্দোলনে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ঐতিহাসিক ভূমিকা বাঙালি জাতির ইতিহাসের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। বাঙালি জাতি চিরদিন তাঁদের এ অবদানকে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে।
জনাব মাখন স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্য হিসাবে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ পরিচালিত সকল আন্দোলন ও সংগ্রামে ছাত্র-জনতাকে সুসংগঠিত করার জন্য উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। ৭১’ এর মুক্তিযুদ্ধে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে মহান মুক্তিযুদ্ধে বলিষ্ঠ নেতৃত্ব প্রদান করেন। তিনি পূর্বাঞ্চলীয় এলাকার (চট্টগ্রাম, ঢাকা, কুমিল্লা, নোয়াখালী এবং ফরিদপুরের একাংশ নিয়ে গঠিত) সকল শ্রেণীর মুক্তিযোদ্ধাদের রিক্রুটমেন্ট, ট্রেনিং ও অস্ত্র সরবরাহের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পূর্বাঞ্চলীয় লিবারেশন কাউন্সিলের ছাত্র প্রতিনিধি হিসাবেও জনাব মাখন বিশেষ দায়িত্ব পালন করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন মহান সংগঠক হিসাবে জনাব মাখনের এই ঐতিহাসিক অবদান দেশ ও জাতির নিকট চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে।
দেশ স্বাধীন হবার পর ১৯৭২ সালে ডাকসু’র সহ-সভাপতি জনাব আ স ম আবদুর রব ও ডাকসু’র সাধারণ সম্পাদক জনাব আবদুল কুদ্দুস মাখন এর নেতৃত্বে ডাকসুর পক্ষ থেকে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ডাকসুর আজীবন সদস্যপদ প্রদান করা হয়। ১৯৭২ সালের পর বাংলাদেশ ছাত্রলীগকে সুসংগঠিত করার কাজে জনাব মাখন বলিষ্ঠ নেতৃত্ব প্রদান করেন। জনাব মাখন ১৯৭২ সালে ভারতের কলকাতায় অনুষ্ঠিত ভারত বাংলাদেশ মৈত্রী মেলায় বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৭৩ সালে ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন ও যুবলীগ সমন্বয়ে গঠিত দলের সদস্য হিসাবে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিভিন্ন অঞ্চল সফর করেন। তিনি ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন। ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনাব মাখন সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ পুনর্গঠনে নিরলস পরিশ্রম করেন। তিনি ১৯৭৪ সালে বার্লিনে আন্তর্জাতিক বিশ্ব যুব উৎসবে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন।
১৯৭৫ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যা করার পর ২৩শে আগষ্ট রাতে জাতীয় নেতৃবৃন্দের সংগে জনাব মাখনকে গ্রেফতার করা হয়। দীর্ঘদিন কারাভোগের পর ১৯৭৮ সালের ১২ নভেম্বর জেল থেকে মুক্তি লাভ করে তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন এবং স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের সদস্য হিসাবে জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। তিনি আজীবন নিজ এলাকাসহ গোটা দেশের আপামর জনসাধারণের কল্যাণে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। তিনি ছিলেন জনগণের কল্যাণে নিবেদিত প্রাণ। দলমত নির্বিশেষে সকল শ্রেণী পেশার লোকজনের একজন অতি প্রিয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব।
জনাব মাখন মাত্র ৪৭ বৎসর বয়সে হেপাটাইটিস বি ভাইরাস জনিত জন্ডিস রোগে আক্রান্ত হয়ে লিভার সিরোসিসে ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৪ খ্রিঃ তারিখে আমেরিকার ফ্লোরিডায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। তাঁর মৃত্যু সংবাদ রেডিও, টিভি এবং সংবাদ পত্রে প্রচারিত হবার পর গোটা দেশে শোকের ছায়া নেমে আসে। তৎকালীন সময়ে কার্যরত জাতীয় সংসদ অধিবেশন তাঁর মৃত্যুর সংবাদ প্রাপ্তির সাথে সাথে মুলতবি ঘোষণা করা হয়। ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৪ খ্রিঃ তারিখে তাঁর লাশ ঢাকা বিমান বন্দরে পৌছলে জাতীয় নেতৃবৃন্দ, অসংখ্য গুণগ্রাহী ও শুভাকাংখী অশ্রুসিক্ত নয়নে লাশ গ্রহণ করেন। অতঃপর মরহুমের লাশ তাঁর নিজ বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরে হেলিকপ্টার যোগে নেয়া হলে সেখানে এক স্মরণকালের সর্ববৃহৎ শোক সমাবেশ হয়। গোটা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এক হৃদয় বিদারক মর্মস্পর্শী দৃশ্যের অবতারণা হয় এবং সেখানে তাঁর জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। পরদিন ১৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা জাতীয় ঈদগাহ্ ময়দানে বিশাল সমাবেশে জানাজা অনুষ্ঠিত হবার পর মিরপুর জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা গোরস্থানে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় জাতীয় বীর আবদুল কুদ্দুস মাখনকে দাফন করা হয়। তাঁর দাফনের পূর্বে বীর মুক্তিযোদ্ধারাও তাঁকে বিশেষ মর্যাদায় সম্মান জানিয়ে সম্মিলিতভাবে স্যালুট প্রদান করে।
জনাব মাখনের মৃত্যুতে তৎকালীন বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি, বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের মাননীয় বিরোধী দলীয় নেত্রী, জাতীয় নেতৃবৃন্দ, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ ও জাতীয় সংসদ সদস্যবৃন্দ, বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দ শোক প্রকাশ করেন। তাছাড়াও, সাংবাদিক, কবি, লেখক, সাহিত্যিক, চিকিৎসক, প্রকৌশলী, আইনজীবী, শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, শিল্পী, সুহৃদ, শুভাকাংখীসহ নানা শ্রেণী পেশার লোকজন শোক প্রকাশ করেন।
জনাব আবদুল কুদ্দুস মাখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মাটি ও মানুষের নেতা ছিলেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সকল শ্রেণী পেশার মানুষের তিনি ছিলেন অতি আপনজন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রায় মানুষই তাঁকে ‘মাখন কুদ্দুস’ হিসাবে ডাকতেন। যে কোন আপদে-বিপদে বা সমস্যায় যে কোন লোক ছুটে গিয়েছেন তাঁদের অতি প্রিয় ‘মাখন কুদ্দুস’ এর নিকট। তিনি অতি সহজেই সব মানুষকেই অতি আপন করে নিতে পারতেন। তাঁর প্রতি মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস ছিল অগাধ। অতি অনায়াসেই যে কেউ তাঁর নিকট পৌঁছতে পারতেন। তিনি ধৈর্য সহকারে সকলের কথাই শুনতেন। যে কোন লোকের যে কোন সমস্যা সমাধানের জন্য তিনি মনে প্রাণে চেষ্টা করতেন। নিজ জেলা ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উন্নয়নে তিনি সর্বদাই সচেষ্ট ছিলেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শিক্ষা বিস্তার, সাহিত্য ও সংস্কৃতির বিকাশ, ইতিহাস ও ঐতিহ্য রক্ষা, বিভিন্ন শিক্ষা, সাহিত্য ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপনে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা, শিল্প ও কল-কারখানা স্থাপন, কৃষকদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি, বেকার যুবকদের কর্মসংস্থান, এলাকার জনগণের সুবিধার্থে রাস্তা-ঘাট নির্মাণ ও উন্নয়ন, এলাকার জনগণের জন্য গ্যাস ও বিদ্যুৎ সুবিধা নিশ্চিতকরণ, সাধারণ মানুষের চিকিৎসা সেবা প্রদান, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ ইত্যাদি কার্যক্রমে তিনি সব-সময়ই অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। উল্লেখ্য, তৎকালীন সময়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের অনেক ছাত্র-ছাত্রীকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ব্যাপারে তিনি প্রয়োজনীয় সাহায্য ও সহযোগিতা প্রদান করেছেন। তাঁর প্রচেষ্টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বহু ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি হবার সুযোগ পেয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে অনেক ছাত্র-ছাত্রীর থাকার ব্যবস্থাও তিনি করে দিয়েছেন। তিনি ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বহু লোককে বিভিন্ন ধরনের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিয়েছেন। বিভিন্ন লোককে বিভিন্ন কাজে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেয়ার তাঁর এই আন্তরিক প্রচেষ্টা সকলের নিকট ছিল অত্যন্ত প্রশংসনীয়। তাছাড়াও, তিনি বিভিন্ন সময়ে অনেক গরীব ও অসহায় অসুস্থ লোককে হাসপাতালে ভর্তিসহ প্রয়োজনীয় চিকিৎসা সেবা প্রদানের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তাঁর এ ধরনের মানবিক জনসেবামূলক কাজের মাধ্যমে বহুলোকই উপকৃত হয়েছেন। সাধারণ মানুষ তাঁর এ মহৎ গুণাবলীর জন্য সবসময় তাঁর গুণকীর্তন করে এবং তাঁকে পরম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।
তিনি সর্বদাই হাস্যোজ্বল থাকতেন। তাঁর মুখ জুড়ে ছিল একটা শিশুসুলভ কোমল ছায়া। তিনি অতি ভদ্র, বিনয়ী এবং খুবই অমায়িক ছিলেন। অতি সহজ সরল মন ছিল তাঁর। বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রতি ছিল তাঁর অগাধ শ্রদ্ধাবোধ। সে জন্যে, যে কোন পেশার বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিগণ জনাব মাখনকে দারুণ পছন্দ করতেন। তাঁর যে কোন কাজে বয়োজ্যেষ্ঠরা স্বতঃফূর্তভাবে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা প্রদান করতেন। তাঁর সমবয়সী বন্ধু-বান্ধবদের সাথে তাঁর সম্পর্ক ছিল সবসময়ই অতি মধুর। বন্ধুত্ব ও সম্প্রীতির এক অপূর্ব মিলন ছিল তাঁদের মাঝে। যা দেখে সকলেই মুগ্ধ হতেন। কনিষ্ঠদের প্রতি তাঁর স্নেহ ও ভালবাসা ছিল তুলনাহীন। ছোট ভাই হিসাবে অতি অনায়াসেই আপন করে নিয়েছেন সকলকে। বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োজনের তাগিদে অনেকই তাঁর ছোট ভাই হিসাবেই পরিচিতি দিয়েছেন সর্বত্র। তাঁর এ উদার মন এবং বুক ভরা ভালবাসা ও ¯েœহ বহু লোককে তাঁদের স্বপ্ন পূরণের পথকে সুগম করে দিয়েছে। তাঁদের হৃদয়ে স্থায়ীভাবে ঠাঁই হয়ে রয়েছে আবদুল কুদ্দুস মাখনের স্মৃতি।
জনাব মাখনের মা-বাবার প্রতি দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ অনুসরণীয় ও অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে চিরদিন। মা-বাবার ইচ্ছা এবং স্বপ্ন পূরণে তিনি কর্মমুখর জীবনের মাঝেও সর্বদাই ব্যতিব্যস্ত থাকতেন এবং সাধ্যমত সব চেষ্টাই করতেন। মা-বাবার সেবা যতেœর বিন্দুমাত্র ত্রুটি না হয় সে বিষয়ে তিনি সব সময়ই অত্যন্ত সতর্ক ও অতি যতœবান ছিলেন। বাবার মৃত্যুর পর মা দীর্ঘদিন বেঁচে ছিলেন। মা জীবিত থাকাকালেই জনাব মাখন মৃত্যুবরণ করেন। তিনি আমৃত্যু মা এর সুখ-শান্তি ও আরামদায়ক জীবনের জন্য যে সেবা-শুশ্রুষা ও যতœ করেছেন তা তুলনাহীন। ভাই-বোন ও আত্মীয় স্বজনদের প্রতি তাঁর মমত্ববোধ ও ভালবাসা ছিল অকৃত্রিম ও অতুলনীয়। সকলেই অতি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে তাঁর সেই সব গুণাবলী।
তিনি ছিলেন প্রাণখোলা নিরহঙ্কার সদালাপি একজন বৃহৎ হৃদয়ের মানুষ। ঢাকাস্থ ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সমিতির প্রতিটি অনুষ্ঠান দলমত নির্বিশেষে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের উপস্থিতিতে সরব ছিল আবদুল কুদ্দুস মাখনকে ঘিরেই। সব পেশার লোকজন জনাব মাখনকে খুবই পছন্দ করতেন। সকলেরই প্রিয় মুখ এবং প্রিয় ব্যক্তি ছিলেন তিনি। এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সমিতির যে কোন কার্যক্রম ও অনুষ্ঠানে হৃদ্যতা আর মনের আনন্দের ব্যাপ্তিতে সকলকেই মোহাচ্ছন্ন ও বিমোহিত করে রাখতেন তিনি। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সমিতির প্রতিটি অনুষ্ঠান ছিল অফুরন্ত আনন্দের এক মিলন মেলা। সকলেই এক অপরের সান্নিধ্যে এসে প্রাণভরে আনন্দ উপভোগ করতেন। সৌহার্দ্য ও সম্প্রীতির বন্ধনে একে অপরকে অতি কাছে টেনেছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখার প্রয়াসে উজ্জীবিত হয়েছেন। তিনি ঢাকাস্থ ব্রাহ্মণবাড়িয়া ছাত্র-ছাত্রী কল্যাণ সমিতি প্রতিষ্ঠা করে ছাত্র-ছাত্রীদের মাঝে সহযোগিতা ও সহমর্মিতার পথকে প্রশস্ত করেছেন। এ সমিতির মাধ্যমে গরীব ও মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের বৃত্তি প্রদান, পুনর্মিলনী, স্মরণিকা প্রকাশ, বনভোজনের আয়োজন ইত্যাদি কার্যক্রমে সকল প্রকার সহযোগিতা প্রদান করেছেন। এতে করে ঢাকাস্থ ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছাত্র-ছাত্রীগণ পারস্পরিক সৌহার্দ্যপূর্ণ ও ভ্রাতৃত্ববোধে উজ্জীবিত হয়ে বিভিন্ন সামাজিক কল্যাণ ও বিনোদনমূলক কার্যক্রম সম্পাদন করার প্রয়াসে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত হয়েছেন। ঢাকাস্থ ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলা সমিতি প্রতিষ্ঠা করে সেখানেও তিনি সকল শ্রেণী পেশার লোকজনের মাঝে সম্প্রীতি ও ভ্রাতৃত্ববোধের এক চমৎকার পরিবেশ রচনা করেছেন। সকলকেই ঐক্যবদ্ধ থেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কৃষ্টি, সভ্যতা, ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করেছেন। তাঁকে আজ সকলেই কৃতজ্ঞ চিত্তে গভীর শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির বন্ধন ও ভ্রাতৃত্ববোধে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধনকে সুদৃঢ় রাখার প্রয়াসে জনাব মাখনের প্রচেষ্টা ছিল নিরন্তর। হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দের সাথে তিনি সর্বদাই চমৎকার সম্পর্ক বজায় রেখেছেন। উভয় সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দের মাঝে সব সময়ই যেন মধুর ও চমৎকার সম্পর্ক বজায় থাকে সে বিষয়টি নিশ্চিতকরণে সর্বদাই তৎপর ছিলেন। হিন্দু সম্প্রদায়ের বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির চেতনাকে উজ্জীবিত করেছেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হিন্দু-মুসলিমসহ সকল সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দের অগাধ আস্থা ও পরিপূর্ণ বিশ্বাস ছিল জনাব মাখনের প্রতি। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সভ্যতা ও সংস্কৃতির ঐতিহ্যকে ধারণ করে মানবতার সুদৃঢ় বন্ধনে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে যথাযথভাবে বজায় রাখার জন্য তিনি সবসময় সচেষ্ট ও দৃঢ় প্রত্যয়ী ছিলেন।
তাঁর মাঝে কখনো কোন হিংসা- বিদ্বেষ পরিলক্ষিত হয়নি। রাজনৈতিক ভিন্নতা সত্ত্বেও সামাজিক জীবনে সৌহার্দ্যময় শান্তিপূর্ণ অবস্থান বজায় রাখার ব্যাপারে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। তিনি ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অন্তঃপ্রাণ। তাঁর কাছে ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষের স্থান ছিল সবার উপরে। দলমত নির্বিশেষে ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসীরাও তাঁকে মনে প্রাণে ভালবাসতেন। জনাব মাখন ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি সাহস ও শক্তি, একটি আস্থা ও বিশ্বাস এবং একজন নির্ভরযোগ্য অকৃত্রিম বন্ধু।
জনাব মাখন একজন জীবন সংগ্রামী মানুষ। কোন প্রকার লোভ-লালসা তাঁকে তাঁর আদর্শ বা নীতি থেকে কখনো বিচ্যুত করতে পারেনি। তিনি নিঃস্বার্থভাবে জনগণের কাজ করেছেন। তাঁর রাজনীতি ছিল জনগণের কল্যাণে কাজ করা। দেশের সেবা করা। দেশ ও জাতির কল্যাণে তিনি আজীবন সংগ্রাম করে গিয়েছেন। তিনি এ দেশের সব শ্রেণী পেশার মানুষের একজন অতি প্রিয়জন ব্যক্তি। তিনি এ দেশের জনগণের অধিকার আদায়ের আন্দোলন ও সংগ্রামে এবং সর্বোপরি, মহান মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র-সমাজ ও জাতিকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের একজন অন্যতম নেতা হিসাবে তাঁর অবদান দেশ ও জাতি শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। এ দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যতদিন থাকবে ততদিনই জাতীয় বীর আবদুল কুদ্দুস মাখনের নাম বাংলাদেশের ইতিহাসে এবং বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে অমর, অক্ষয় ও অম্লান হয়ে থাকবে।
জাতীয় বীর আবদুল কুদ্দুস মাখন আমাদের গর্ব, আমাদের অহংকার। আমরা তোমায় ভুলব না।
লেখক: মিজানুর রহমান,সাবেক সচিব,গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার