সরকারের টাকা ছয় নয়ে মল্লিকা গ্রুপ
লোভের মিছে ঘর : খালি জমি রেখে আঁকা-বাঁকা করে পাঁচ গ্রামের উপর দিয়ে চারলেনের নকশা করায় ক্ষোভ
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া-আগরতলা সড়কের গাজীর বাজার হয়ে দ্বিজয়পুর গ্রামে প্রবেশ করতেই চোখে পড়ে নতুন একটি নির্মাণাধীন ভবন। চার লেন সড়ক হবে জেনেও ওই স্থানে কেন ভবন নির্মাণ করছেন- এমন প্রশ্নের জবাবে জায়গার মালিক আব্দুল আজিজ জানালেন, মল্লিকা গ্রুপ নামে একটি কম্পানি তাঁর কাছ থেকে ২০ শতক জায়গা তিন বছরের জন্য ভাড়া নিয়েছেন এক লাখ ২০ হাজার টাকায়। শর্ত অনুসারে তিন বছর পর ঘরটি সরিয়ে নিবেন সংশ্লিষ্ট নির্মাণকারিরা। এর মধ্যে সরকার জমি অধিগ্রহণ করলে সংশ্লিষ্টরা পাবেন নির্মাণের ক্ষতিপূরণের টাকা।
দ্বিজয়পুর থেকে পশ্চিমে প্রায় এক কিলোমিটারের পথ সাতপাড়া গ্রামের শেষাংশ। সেখানে খামার আকারে কিছু একটা গড়ে তোলা হচ্ছে। এর পাশেই আরেকটি ভবন নির্মাণাধীন, যাতে ওই খামারে কর্মরত অবস্থান করবেন বলে বলা হচ্ছে। নির্মাণাধীন খামারের জায়গার মালিক হোসেন নামে এক ব্যক্তি। এর পাশেই ভবন তোলা হচ্ছে তোতা মিয়ার বাড়িতে। কথা হলে তোতা মিয়া জানালেন, মল্লিকা গ্রুপ নামে একটি কম্পানি এসব কাজ করছেন। তাঁদের কাছ থেকে তিন বছরের জন্য জমি ভাড়া হিসেবে নিয়েছেন চুক্তিপত্র করে।
সরজমিনে ঘুরে জানা গেছে, আখাউড়া উপজেলার ধরখার থেকে আখাউড়া স্থলবন্দর পর্যন্ত জাতীয় চার লেন মহাসড়ক নির্মাণের নকশা অনুযায়ি নতুন করে বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করা হচ্ছে সরকারের কাছ থেকে বাড়তি ক্ষতিপূরণের আশায়। রবিবার সকাল সাড়ে আটটা থেকে বেলা ১১ টা পর্যন্ত ঘুরে দেখা গেছে, উপজেলা দক্ষিণ ইউনিয়নের পাঁচটি গ্রামে নতুন করে ভবন, খামারের পাশাপাশি কিছু বিলবোর্ডও স্থাপন করা হচ্ছে। ক্ষতিপূরণ পেয়ে যাবেন- এমন আশায় যেনতেনভাবে কাজ করা হচ্ছে। বাড়তি টাকা আদায়ের আশায় ভবন নির্মাণে কিছু কৌশলও নেয়া হয়েছে। তোতা মিয়ার বাড়িতে ভবনের নিচতলায় ইটের পিলার দেয়া হলেও দ্বিতীয় তলার ছাদে কিছু রড বের করে রাখা হয়েছে, যেন শক্ত ভীতের কাজ বুঝা যায়।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আশুগঞ্জ নদীবন্দর-সরাইল-ধরখার-আখাউড়া স্থলবন্দর মহাসড়ককে জাতীয় চার লেন মহাসড়কে উন্নীত করা হবে। মূলত ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থার প্রসারে এ সড়কটি নির্মাণ করা হবে। আশুগঞ্জ নদীবন্দর থেকে সরাইল ও সরাইল থেকে ধরখার পর্যন্ত সড়ক নির্মাণে ইতিমধ্যেই সব ধরণের কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। ধরখার থেকে আখাউড়া স্থলবন্দর পর্যন্ত সড়ক নির্মাণে নকশা করাসহ প্রাথমিক কাজ শেষে মন্ত্রী পরিষদে অনুমোদনের জন্য পাঠানোর অপেক্ষায় রয়েছে। ওই অংশটি নির্মাণে প্রায় ৮০০ কোটি টাকার মতো ব্যয় ধরা হয়েছে। ভারতীয় অর্থায়নে সড়কটি নির্মাণ হবে। তবে জমি অধিগ্রহনসহ বাকি ক্ষতিপূরণ দিবে বাংলাদেশ সরকার।
এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কয়েক বছর আগে ওই অংশে নকশার কাজ করা হলেও তাঁরা বিষয়টি টের পান নি। তখন বলা হয়, গ্যাসের সন্ধানে কাজ করা হচ্ছে। সম্প্রতি নতুন নতুন ভবনসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ শুরু হলে অনেকের নজরে আসে। তখন তাঁরা নকশা সংগ্রহ করে দেখেন, গ্রামের মধ্য দিয়ে যাওয়া জমি বাদ দিয়ে বসতির উপর দিয়ে সড়ক নির্মাণ করা হবে। এর প্রতিবাদ জানিয়ে তাঁরা মানববন্ধনও করেন। বিষয়টি আইনমন্ত্রীসহ (স্থানীয় সংসদ সদস্য) ইউএনও ও স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানকে অবহিত করা হয়।
স্থানীয়দের দাবি, নকশা অনুযায়ি সড়ক হলে ওই ইউনিয়নের সাতপাড়া, আনন্দপুর, দ্বিজয়পুর, রহিমপুর, বঙ্গেরচর এলাকার দেড় শতাধিক বাড়িঘর বিলীন হয়ে যাবে। এছাড়া বঙ্গেরচর ও দ্বিজয়পুরের দুইটি মসজিদ, আনন্দপুরে দুইটি ও রহিমপুরে একটি কবরস্থান, বঙ্গেরচর মৌজার ধলেশ্বর ঈদগাহ ও একটি মাদরাসার আংশিক নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে।
এদিকে তোতা মিয়া, ফালু মিয়া, আব্দুল আজিজ, মো. হোসেন, শানু ভূঁইয়া, মঙ্গল মিয়াসহ আরো অনেকে নিজ নিজ জায়গা ভাড়া দিয়ে কিংবা নিজেরা নতুন ভবনসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করছেন। মঙ্গল মিয়ার বাড়িতে পুকুরের মধ্যেই ভবন নির্মাণ করতে দেখা যায়। এছাড়া ওই বাড়ির ছাদ ও নিচে তিনটি বিলবোর্ড স্থাপন করা হচ্ছে।
গাজীর বাজার এলাকার ব্যবসায়ি ইব্রাহিম ভূঁইয়া লিটন বলেন, ‘নিজেদের স্বার্থের কথা চিন্তা করে পাঁচটি গ্রামকে ধ্বংস করে দেয়া হচ্ছে। গ্রামের উপরের জমির উপর দিয়ে সড়ক নির্মাণ হলে একদিকে যেমন সড়কটি সোজা হতো তেমনিভাবে শত পরিববার ক্ষতি থেকে বেঁচে যেতো। আমরা এ নকশার প্রতিবাদ জানিয়ে ইতিমধ্যেই মানববন্ধন করেছি। প্রয়োজনে আবার আন্দোলনের ডাক দেয়া হবে। এখন একটি চক্র এলাকার লোকজনকে জমির দাম বেশি পাওয়ার লোভ দেখিয়ে জায়গা ভাড়া নিয়ে নতুন ভবন নির্মাণ করছেন। এতে সরকারের কোটি কোটি টাকা গচ্ছা যাবে। সবচেয়ে ভয়াবহ বিষয় হলো ভবনগুলোর কাজ খুবই নি¤œমানের করা হচ্ছে।’
দক্ষিণ ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. জাহের মিয়া বলেন, ‘আমাদের ইউনিয়নের চার হাজার মানুষের বসতভিটা বিলীন হয়ে যাবে এ নকশার কারণে। অথচ গ্রামের মধ্যেই থাকা জমি দিয়ে সড়ক করলে এ ক্ষতি থেকে সবাই বেঁচে যেত।’ সরকারের কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ হিসেবে বাড়তি টাকা পাওয়ার আশায় অন্তত ২০-২৫টি ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।
আখাউড়া দক্ষিণ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. শামছুল হক ভূইয়া বলেন, ‘জমির উপর দিয়ে সোজাসুজি সড়ক নির্মাণ করা হলে আমারও বেশ কিছু জমি পড়বে। তবুও আমি চাই আগের নকশা বাতিল করা হোক। নইলে শতাধিক বাড়িঘরের পাশাপাশি ধর্র্মীয় প্রতিষ্ঠাগুলো রক্ষা করা যাবে না। সোজা পথে জমি দিয়ে সড়ক হলে
সরকারের অধিগ্রহন খরচও কমবে। এছাড়া যেভাবে নতুন করে ঘর নির্মাণ করা হচ্ছে সেগুলোর ক্ষতিপূরণও দিতে হবে না সরকারকে।’
আখাউড়া দক্ষিণ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান মো. জালাল উদ্দিন বলেন, ‘জাতীয় ওই মহাসড়কের কারণে আমার ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের মানুষ ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ হবে। শতাধিক বাড়ির পাশাপাশি মসজিদ, মাদরাসা, ঈদগাহ, কবরস্থান ভাঙ্গা পড়বে। অথচ এসব স্থাপনার পাশ ঘেঁষে যাওয়া জমি দিয়ে সড়কটি হলে লোকজনের ক্ষতি একে বারেই হতো না। পাশাপাশি সড়কটিও সোজা হতো। আমার মনে হচ্ছে, সার্ভে করতে আসাসহ সংশ্লিষ্টরা একটি সিন্ডিকেট করে এভাবে নকশা করেছে নিজেদের স্বার্থের জন্য। আর যেভাবে বিল্ডিং করা হচ্ছে তাতে ঝুঁকিও রয়েছে। এ বিষয়ে আমি জায়গার তিনজন মালিককে নোটিশ দিলেও তাঁরা কর্ণপাত করছেন না। বাকিদেরও নোটিশ দেয়া হবে। বিষয়টি আইনমন্ত্রী মহোদয়কে অবহিত করা হয়েছে। তিনি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের আশ্বাসও দিয়েছেন।’
আখাউড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) তাহমিনা আক্তার রেইনা বলেন, ‘সড়ক করার উপযোগি অংশ নিয়ে নকশা করা হয়েছে বলে আমাকে জানানো হয়েছে। জমির উপর দিয়ে নিলে সড়ক নির্মাণে ঝুঁকি থাকতো বলে সংশ্লিষ্টরা বলেছেন।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সড়কের নকশা অনুুযায়ি জায়গায় ঘর নির্মাণ না করতে মৌখিকভাবে নিষেধ করা হয়েছে। কিন্তু ঘর নির্মাণ চলছেই বলে জানতে পেরেছি। যারা ঘর নির্মাণ করছেন তাঁদের দায়িত্বশীল কাউকে পাওয়া যাচ্ছে না। কর্মরত শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে কোনো লাভ হচ্ছে না।’
আশুগঞ্জ নদীবন্দর-সরাইল-ধরখার-আখাউড়া স্থলবন্দর মহাসড়ককে চার লেন জাতীয় মহাসড়কে উন্নীতকরণ প্রকল্প-৩ (ধরখার-আখাউড়া স্থলবন্দর) এর প্রকল্প ব্যবস্থাপকের অতিরিক্ত দায়িত্বে থাকা মো. শাহরুল আমীন কালের কণ্ঠকে জানান, ২০১৫ সালে ওই সড়কের নকশা হয়। অনেক দিক বিবেচনা করেই ওই নকশা করা হয়েছে। কেউ ইচ্ছে করলেই নতুন স্থাপনা তুলে টাকা নিতে পারবে না। আমরা অভিজ্ঞদের সঙ্গে নিয়ে দেখবো আসলেই স্থাপনটা কি উদ্দেশ্যে তোলা হয়েছে। সেই মোতাবেক আমাদের প্রস্তাবনা অনুযায়ি জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের মাধ্যমে ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে।’
সোজা পথে সড়ক নির্মাণের দাবি
শতাধিক বসতবাড়ি ও ছয়টি ধর্মীয় স্থাপনা রক্ষা করে চার লেন সড়ক নির্মাণের বাস্তবায়নের দাবি জানানো হয়েছে। বুধবার সকালে উপজেলার দক্ষিণ ইউনিয়নের গাজীর বাজার এলাকায় হওয়া সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানানো হয়।
এ সময় বলা হয়, গ্রামের ভিতর দিকে আঁকাবাঁকা ভাবে না করে সোজা পথে সড়ক নির্মাণ হলে একদিকে যেমন এলাকাবাসী ক্ষতি থেকে রক্ষা পাবে তেমনিভাবে সরকারি টাকার অপচয়ও রোধ হবে। বাঁকা সড়কের কারণে প্রায় দুই থেকে তিন কিলোমিটার সড়ক বেশি নির্মাণ করতে হবে বলে দাবি করা হয়।
সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্যে অ্যাডভোকেট আকছির এম. চৌধুরী জানান, আশুগঞ্জ নদীবন্দর থেকে আখাউড়া স্থলবন্দর পর্যন্ত চার লেন মহাসড়ক নির্মাণ করার জন্য ভূমি মাপঝোঁক করা হয়েছে। কিন্তু জমি ও ফাঁকা জায়গা থাকা সত্বেও সড়কটি দক্ষিণ ইউনিয়নের সাতপাড়া দিয়ে ঢোকার পর উদ্দেশ্যমূলকভাবে আঁকাবাঁকা করা হয়েছে। এতে পাঁচটি গ্রামের মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হবে।
এ সময় উপস্থিত দক্ষিণ ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শামসুল হক, আনন্দপুর মাদ্রাসার সভাপতি হাজি আবুল কাসেম, ব্যবসায়ী মো. তাজুল ইসলাম, শিক্ষক মো. শাহীন মোল্লা, আওয়ামী লীগ নেতা মো. জাহের মিয়া, কৃষক মো. নজরুল ইসলাম, দক্ষিণ ইউনিয়ন ছাত্রলীগের সাবেক আহবায়ক ইব্রাহিম ভূইয়া লিটনসহ অন্যান্যরা সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব দেন। তাঁরা জানান, এলাকার মানুষ সড়ক নির্মাণে কোনোধরনের বিরোধিতা করছে না। তবে তাঁদের আপত্তি সড়কের নকশা নিয়ে।
আশুগঞ্জ নদীবন্দর-সরাইল-ধরখার-আখাউড়া স্থলবন্দর মহাসড়ককে জাতীয় মহাসড়কে উন্নীতকরণ প্রকল্পের প্রকল্প ব্যবস্থাপক (২ ও ৩ এর অতিক্তি দায়িত্ব) মো. শাহরুল আমীন জানান, ২০১৫ সালেই অনেক যাচাই-বাছাই করে নকশা করা হয়। ধরখার থেকে বন্দর পর্যন্ত ১১ কিলোমিটার সড়ক হবে। চারলেনের পাশাপাশি কম গতির গাড়ির জন্য আরো দুই লেন হবে। তবে এ সড়কের নকশা পরিবর্তন করার এখতিয়ার তাঁদের হাতে নাই। তবে প্রয়োজনের সরজমিনে গিয়ে দেখা হবে।
প্রতিবেদনটি কালের কন্ঠে প্রকাশিত