এক বছরে বিচার হয়নি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হামলার, সরকারের আন্তরিকতার অভাবকেই দোষলেন সংস্কৃতিকর্মীরা
১২ জানুয়ারী। ২০১৬ সালের এই দিনে মাদ্রাসা ছাত্রের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় চালানো হয় তান্ডবলীলা। ভাংচুর করে আগুনে পুড়িয়ে দেয়া হয় সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁ সঙ্গীতাঙ্গন, রেলস্টেশনসহ বিভিন্ন সাহিত্য সংগঠনের কার্যালয়। এ হামলার এক বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত কাউকেই আইনের আওতায় আনতে পারেনি পুলিশ। তদন্ত কমিটি গুলোর প্রতিবেদনও আলোর মুখ দেখেনি। দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি চলছে বলেই এ ঘটনার কোন সুরাহা হয়নি বলে মতামত সংস্কৃতি কর্মীদের। এদিকে, কিছু সংগঠন ঘুরে দাড়াতে পারলেও প্রয়োজনীয় অর্থাভাবে চালু করা যায়নি কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রতিনিধি মনিরুজ্জামান পলাশের প্রতিবেদনে।
২০১৬ সালের ১১ জানুয়ারী সন্ধ্যায় মোবাইল বেচা কেনা নিয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জামিয়া ইউনুসিয়ার এক ছাত্রের সাথে বাদানুবাদ হয় জেলা পরিষদ মার্কেটের এক মোবাইল ব্যবসায়ীর। পরে এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে মাদ্রাসা ছাত্র ও মোবাইল ব্যবসায়ীর পক্ষে ছাত্রলীগ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। পুলিশ বাঁধা দিলে শুরু হয় ত্রিমুখী সংঘর্ষ। কয়েকদফা সংঘর্ষে এক মাদ্রাসা ছাত্রের মৃত্যু হলে পরিস্থিতি ঘোলাটে হতে থাকে। পরদিন ১২ জানুয়ারী সকালে মাদ্রাসা ছাত্ররা সহপাঠীর মৃত্যুর প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল ও রেলপথসহ রাস্তাঘাট অবরোধ করে রাখে। এতে বাধা দিলে শুরু হয় আবারো সংঘর্ষ। এরপরই হামলা চালানো শুরু হয় সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁ সঙ্গীতাঙ্গন, রেলস্টেশন, সাহিত্য একাডেমি, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পাঠাঘার, জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, ইন্ডাষ্ট্রিয়াল স্কুলসহ বিভিন্ন সাহিত্য সংগঠনের কার্যালয়ে। আগুনে পুড়িয়ে দেয়া উপমহাদেশে খ্যাতনামা সংঙ্গীত বিশারদ সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁর স্মৃতি জাদুঘর। হামলার পর বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে করা হয় একাধিক মামলা। তবে এক বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত কাউকেই আইনের আওতায় আনতে পারেনি পুলিশ। তদন্ত কমিটি গুলোর প্রতিবেদনও দেখেনি আলোর মুখ ।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আহবায়ক আব্দুন নুর বলেন, দেশে বিচারহীনতার সংস্কৃতি চলছে বলেই এ ঘটনার কোন সুরাহা হয়নি বলে মতামত সংস্কৃতি কর্মীদের। তিনি বলেন, এ বিষয়টি নিয়ে সরকার আন্তরিক নয় বলেই তারা বিচার পাননি। আর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঘটনার বিচার হলে নাসিরনগরের মত ঘটনার সৃষ্টি হতনা বলেও তার মত।
সাহিত্য একাডেমি সভাপতি জয়দুল হোসেন বলেন, এই বিচার না হওয়ার কারণে ভবিষ্যতে এ ধরনের আরো হামলা আশংকা রয়েছে। এ ঘটনার সাথে জড়িতদের দ্রুত খুঁজে বের করে বিচারের আওতায় আনার দাবি তার।
তবে পুলিশ বলছে, এ ঘটনায় দায়ের হওয়া ১৩টি মামলার আসামী বেশি হওয়ায় তদন্তে অধিক সময় লাগছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর মডেল থানার ওসি মঈনুর রহমান বলেন, তদন্ত প্রক্রিয়া শেষ পর্যায়ে। তারা দ্রুতই তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেবেন।
এদিকে, হামলার এক বছরে ঘুরে দাড়িয়েছে রেল ষ্টেশন ও ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁ সঙ্গীতাঙ্গনসহ সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলো।
সহকারী ষ্টেশন মাষ্টার সোয়েব মিয়া বলেন, এই হামলার পর ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলস্টেশন প্রথম শ্রেণী থেকে ডি শ্রেণীর স্টেশনে নেমে আসে। সিগন্যালিং ব্যবস্থা না থাকার কারণে দীর্ঘ একমাস যাত্রী সাধারণকে প্লাটফরম বিহীন উঠানামা করতে হয়েছে। ৬ মাস পরে মেরামত শেষে বর্তমানে কোন সমস্যা ছাড়াই কার্যক্রম চালানো যাচ্ছে।
এদিকে, ওস্তাদ আলাউদ্দীন খাঁ সঙ্গীতাঙ্গনের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মান্নান বলেন, হামলায় সমস্ত মালামাল বই-পত্র, যন্ত্রপাতি যা কিছু ছিল সবই পুড়িয়ে ছাড়খার করে দিয়েছিল। সে অবস্থা থেকে সংস্কৃতি বান্ধব সরকারের স্পন্দিত সাংসদ র. আ. ম উবায়দুল মোক্তাদির চৌধুরীর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় আমরা আবারো ঘুরে দাড়িয়েছি। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, তবে সেই স্মৃতি জাদুঘরের যন্ত্রপাতি আর ফিরে পাবো না আমরা।
অন্যদিকে, প্রয়োজনীয় অর্থাভাবে চালু করা যায়নি ইন্ডাষ্ট্রিয়াল স্কুলের বিভিন্ন ইউনিট।
ইন্ডাষ্ট্রিয়াল স্কুলের তত্তাবধায়ক জুলকারনাইন শিকদার চমন বলেন, ঘটনার পর আমরা বিভিন্ন সহযোগিতার আশ্বাস পেলেও স্থানীয় সাংসদের নগন অর্থ সহায়তা ছাড়া আমরা আর কিছুই পায়নি। তাই আমাদের বিভিন্ন ইউনিটে প্রশিক্ষণ বন্ধ রয়েছে।
তবে এ ঘটনায় বিএনপি জনতাকে যুক্ত করে স্বচ্ছ বিচারের দাবি জানিয়েছেন। জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জহিরুল হক খোকন বলেন, আমরা চাই এ ঘটনায় জড়িতদের ধরতে প্রজেক্টরের মাধ্যমে ভিডিও ফুটেজ দেখে জনগণের সামনে দোষিদের চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনা হোক। বিরোধীদলগুলোর নেতাকর্মীদের হয়রানিতে এসব মামলার অপব্যবহার না করার অনুরোধ ও তার।
জানুয়ারীতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শহরের বিভিন্ন স্থাপনায় হামলা, বছরের শেষ দিকে নাসিরনগরে হামলা। সব মিলিয়ে ২০১৬ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সম্প্রীতির নদীতে ভাটার টান পড়ে। সরকারের প্রয়োজনীয় পদক্ষেপই পাড়ে এমনসব হামলা রোধ করে সাংস্কৃতির রাজধানী খ্যাত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সেই পুরানো গৌরব ফিরিয়ে দিতে। এমটাই প্রতাশা ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসীর।