Main Menu

সাম্প্রতিক ব্রাহ্মণবাড়িয়া: চাই মানবিকতার সার্বিক জাগরণ

+100%-

brahmanbariaপত্রিকার ভাষ্যমতে, ‘তুচ্ছ’ ঘটনাকে কেন্দ্র করে উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ, জাতীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল কুদ্দস মাখন, ফখরে বাঙাল তাজুল ইসলাম এবং বড় হুজুর সিরাজুল ইসলাম প্রমুখের পূণ্যভূমিতে তুলকালাম কাণ্ড ঘটে গেল। পত্র-পত্রিকা, ইলেক্ট্রনিক্স ও অনলাইন মিডিয়ায় এ-সবের সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশ পাচ্ছে। ঘটনার মূল সূত্রপাত নিয়ে নানামুখী তথ্য পাওয়া যায়: (ক) মোবাইল কেন্দ্রিক বচসা; (খ) অটোরিক্সাকেন্দ্রিক দ্বন্দ্ব; (গ) নাসিরনগর থানায় কওমি মাদরাসা বন্ধ করা; (ঘ) আগের দিন সুন্নি সমাবেশে আক্রমণের চেষ্টা। এর মাঝে কোনটা সত্যি, তা বলা মুশকিল। তবে একাধিক উপাদানও কাজ করে থাকতে পারে। আমার মতে, ভিন্ন একটি কারণও ফল্গুধারার মতো কাজ করে থাকতে পারে, এবং মূল আলোচনা একে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হবে। আবার দেখতে পাই, এটি ত্রিপক্ষীয় দ্বন্দ্ব: মাদরাসার ছাত্র, ছাত্রলীগ ও পুলিশ। মাদরাসার কর্তৃপক্ষসহ অন্য আরো অনেকের ভাষ্য মতে, এতে মুখোশপরা ভিন্ন কোনো শক্তিও জড়িত থাকতে পারে। এর কোনোটাই ফেলে দেওয়ার মতো নয়।

সামরিক স্বৈরতন্ত্রের পর তথাকথিত গণতন্ত্রে উত্তরণের দ্বিতীয় পর্বে তথা ১৯৯৬-তে যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে, তখন এর শেষের দিকে ফতোয়াকেন্দ্রিক হাইকোর্টের রায়ে কওমি ওলামায়ে কেরাম বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেন। আন্দোলনের এক পর্যায়ে মুফতি আমিনী গ্রেফতার হন। এর প্রতিক্রিয়ায় ব্রাহ্মণবাড়িয়া উত্তপ্ত হয়ে পড়ে। সেই উত্তপ্ত সময়ে একাধিক জনকে প্রাণ দিতে হয় এবং এর সবাই ইউনুসিয়া মাদরাসার ছাত্র। জামিয়া ইউনুসিয়া দেশের সুপ্রাচীন প্রতিষ্ঠানের একটি। এই-তো সম্প্রতি এর শতবর্ষপূর্তি সম্মেলন হয়ে গেল। শতায়ু এই প্রতিষ্ঠানে এই সময়ে এসে কেন তাহলে প্রাণবিসর্জনের মতো ঘটনা ঘটছে বা গোলযোগ সৃষ্টি হচ্ছে? এর উৎস কোথায়, এর সমাধানই বা কী? এ নিয়ে নিশ্চয় ভাবার আছে।

মাদরাসাটি দেওবন্দ ঘরানার বলে শুরু থেকেই আহমদিয়া তথা কাদিয়ানিদের সাথে এর বিরোধ জন্মবয়সী। কিন্তু প্রতিষ্ঠাতা সেই মাওলানা ইউনুস থেকে শুরু করে ফখরে বাঙাল পর্যন্ত প্রাণবিসর্জনের কোনো ঘটনা ঘটেনি। এমনকী পরবর্তীতে মাদরাসার প্রধান এবং বড় হুজুর সিরাজুল ইসলাম সাহেবের সময়েও এমন ঘটে নি। এখন তাহলে ঘটছে কেন? আমার মতে, এর দুটি কারণ হতে পারে: (ক) তখনকার পরিচালকগণ ছিলেন প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণে দক্ষ, তাদের প্রভাব ছিল সর্বব্যাপী। এখন সে দক্ষতায় ও প্রভাবে চিড় ধরেছে। (খ) তখনকার ছাত্ররা ছিল তুলনামূলক শান্ত। এখন সেই শান্ত মনোভাব আর নেই। হয়ত এ-দুটো কারণই এক সঙ্গে কাজ করে থাকতে পারে। আবার এককভাবেও এর কোনো একটি কাজ করে থাকতে পারে।jamia

যতদূর জানা যায়, ফখরে বাঙালের মৃত্যুর পর মাদরাসায় রাজনৈতিক কোনো পুরুষ নেই, প্রকাশ্যে তেমন এর চর্চাও নেই। জাতীয় রাজনীতির যে কোনো মেরুকরণে তা নিরপেক্ষতা বজায় রাখার চেষ্টা করে। সকল দলের নেতা-কর্মীদের সাথে মাদরাসা-কর্তৃপক্ষের সমান যোগাযোগ। কিন্তু ছাত্ররা বোধহয় সেই প্রাতিষ্ঠানিক প্রবণতায় অভ্যস্ত নয়। তাই শোনা যায়, আশির দশকে ছাত্ররা মাদরাসার অমতেই হাফেজ্জি হুজুরের খেলাফত আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। নব্বইয়ের দশকে মুফতি আমিনীর ইসলামি মোর্চা বা ইসলামি ঐক্যজোটেও এদের অংশগ্রহণ মাদরাসার নিয়মনীতি বিরুদ্ধ। এই যে রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতাসহ প্রতিষ্ঠানের নিয়ম-বিরুদ্ধ নানা কাজে ছাত্ররা জড়িয়ে পড়ছে এবং তা বারবার। এ নিয়ে কর্তৃপক্ষ কতটা উদ্যোগী হয়েছে এবং এর পরিণতিটা কী, তা জানা নেই।

রাজনৈতিক সংগঠন ছাড়াও ভিন্ন ঘরানার ধর্মীয় সমাবেশ, ওয়াজ-নসিহত, র‌্যালির ব্যাপারে প্রাতিষ্ঠানিক ও শিক্ষকদের কী মনোভাব, তা অজানা। কিন্তু এসব ব্যাপারে ছাত্ররা অযথা অতিরিক্ত খবরদারি প্রবণতায় অভ্যস্ত। তাই দেখা যায় ওআইসি’র অন্তর্ভুক্ত প্রায় সকল দেশে অমুসলিম হিসাবে স্বীকৃত কাদিয়ানিদের ব্যাপারে যেমন এরা অসহিষ্ণু, ক্ষেত্রেবিশেষে সহিংসও। তেমনই মুসলিম হিসাবে স্বীকৃত কিন্তু ভিন্ন ঘরানার, তথা বেরেলি সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধেও এদের সমান এলার্জি। শহরের ভিতরে এবং বাইরে, এরা প্রায়ই এসব বিষয়ে গোলযোগের সৃষ্টি করে। পূর্বের এ সমস্ত বিষয়ে ইউনুসিয়া কর্তৃপক্ষের নজরদারি ও তদারকি যথাযথ ছিল বলে মনে পড়ে না।

হ্যাঁ, এ প্রসঙ্গে একটি কথা এখানে না বললেই নয়। এতে কেউ কেউ নাখোশ হতে পারেন। কিন্তু সত্য তো সব সময়ই তিতা। আর তা হল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ভেতরে ইউনুসিয়ার ছাত্রদের দ্বারা কখনো কখনো ভিন্ন ঘরানার ধর্মীয় রাজনৈতিক সভা-সমাবেশের বাধাগ্রস্তকরণে স্থানীয় রাজনীতিবিদদের মৌন ও নীরব সমর্থন ছিল এবং থাকত। এই সব প্রশ্রয়ই হয়ত অপরিপক্ব ছাত্র-মানসিকতায় প্রভাব সৃষ্টি করে থাকতে পারে এবং তা ক্রম-পরম্পরায় বজায় রয়েছে এখনো। এমনকি অভিযোগও আছে যে, অতীতে ঢাকার এক কাদিয়ানি-বিরোধী মহা-সমাবেশে ইউনুসিয়ার ছাত্রদের অংশগ্রহণে অর্থায়ন করেছে খোদ স্থানীয় আওয়ামী নেতারা। তাই ভোট ব্যাঙ্ক-রক্ষার নেশায় ঘটে যাওয়া সেই সব অপকর্মেরও পুনর্মূল্যায়ন জরুরি।

ইউনুসিয়ার ছাত্রদের প্রভাব-প্রতিপত্তি শুধু নিজ ঘরানার প্রতিপক্ষদের দলন করা নয়। এরা জাতীয় ও দেশীয় নানা উৎসব-পার্বণেও বাড়াবাড়ি রকমের আচরণ করে। হ্যাঁ, ধর্মের বিধি-নিষেধ অবশ্যই মান্য। কিন্তু গণতান্ত্রিক ধারাসহ যে-কোনো শাসনতন্ত্রে নিজের হাতে বিচারের ভার তুলে নেওয়া গুরুতর অপরাধ। ইসলামি ফিকহেও এই সব বাড়াবাড়ির সমর্থন মেলে না। কিন্তু ইউনুসিয়ার ছাত্ররা এ সব বিষয়ে খুব একটা গা করে না। জানেও না বোধহয়।

এই অসচেতনতা ও উচ্ছৃঙ্খলতার মূল অনেক গভীরে। এ মুহূর্তে মাদরাসার ছাত্র-কর্তৃপক্ষ ও এলাকাবাসীকে সেই গভীরেই হাত দিতে হবে। আত্মবিশ্লেষণ, আত্মমূল্যায়নের পথে এগিয়ে যেতে হবে। তখনই মূলত ভবিষ্যৎ নির্দেশনা মিলতে পারে এবং এসব ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধ হতে পারে।

সাম্প্রতিক ঘটনার মূল হেতু ছিল জেলারই ভেতরে। হয়ত ছাত্ররা এতে সরাসরি জড়িত। তাই তাদের প্রাণক্ষয়ের একটি খেলো অজুহাত দাঁড় করানো যায়। কিন্তু ঢাকায় গ্রেফতার হওয়া এক মাওলানা বা মুফতির জন্য একাধিক শিক্ষার্থীর প্রাণ দেওয়ার কি কোনো যুক্তি আছে? তাদের এই প্রাণদান ব্যক্তিগত জীবনে, পরিবারে, সমাজে, রাষ্ট্রে; সর্বোপরি সার্বিক ইসলামের গতিধারায় ইতিবাচক কোনো ভূমিকা রাখতে পেরেছে কি? প্রশ্নটি আরো সংক্ষিপ্তভাবে বললে, তা দাঁড়ায়: মুফতি আমিনীর জন্য ছাত্ররা প্রাণ বিসর্জন দিল। তিনি বিতর্কিত হলেও, জ্ঞানতাত্ত্বিক জগতে এমন বিকল্প আমিনী তাদের মাঝে আর তৈরি হতে পেরেছে কি? এবং এর সম্ভাবনা ইউনুসিয়া মাদরাসাসহ বা পুরো ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কোনো মাদরাসায়ও খোলা আছে কি? ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আলেম-ওলামা বুকে হাত দিয়ে এ কথাটি একটু ভাবুন তো! এ প্রশ্নটা আমি আরো পিছিয়ে নিতে চাই। নবুয়তের দরোজা বন্ধ, তাই কোনো নবির আগমন হবেনা। কিন্তু বেলায়েতের দরোজাও কি বন্ধ? তাহলে ফখরে বাঙালের মতো, বড় হুজুরের মতো সর্বজন মান্য, দেশবরেণ্য কোনো পুরুষের জন্ম হচ্ছে না কেন এই জেলায়? প্রশ্নটা জাতীয় পর্যায়েই সীমিত রাখলাম। কারণ, বিশ্বপর্যায়ে পদার্পণের যে সদর রাস্তা, তাতে পা ফেলার যোগ্যতা ও প্রস্তুতি আমাদের দেশের কোনো আলিমেরই নেই। বিশেষত কওমি মাদরাসায় বৈশ্বিক চিন্তার লালন-পালন একেবারেই হয় না।

বাংলাদেশের কোনো কওমি মাদরাসা, ইউনুসিয়াও এর অন্তর্ভুক্ত, আর্থিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। দশজনের সহায়-সাহায্যেই তা পরিচালিত হয়। কোথাও-বা দেশের বাইরের সাহায্য-বদান্যতায় পরিচালিত। তাই যারা সাহায্য করেন, আল্লাহ-রাসুলের বাক্সে দান করেই তাদের তৃপ্তির ঢেকুর তোলার সুযোগ নেই। আবার এর ছাত্ররা বেয়াড়া বলে এর থেকে হাত-মুখ ফিরিয়ে নেওয়ারও উপায় নেই। কারণ, বিগত ইতিহাসের কোনো এক অনিবার্য পর্বে এই মাদরাসাগুলোর জন্ম হয়েছিল এবং মুসলিম জনতার অকুণ্ঠ সাহায্য-সমর্থনেই। কিন্তু নদীর স্রোত অনেক গড়িয়ে গেলেও সেই স্রোতের কোনো স্পর্শ এই সব প্রাচীন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে সামান্যও লাগে নি। আমরাও শুধু দান-দক্ষিণা দিয়ে অন্য দিকে মনোনিবেশ করে দিন কাটাই। ব্রিটিশ-যুগে বিধর্মী বলে প্রশাসনকে এড়িয়ে চলার যেই মানসিকতা গড়ে উঠেছে তাদের মাঝে, কালপরম্পরায় এখনো সমানভাবে তা জাগ্রত। অথচ এখন বিদেশি নয়, দেশি শাসক। এই বোধটুকু তাদের ভেতর জাগিয়ে তুলতে হবে। শাসককেও তাই আরো সদয় হতে হবে। একইভাবে কালের স্রোতের সঙ্গে এর শিক্ষাপদ্ধতি সমন্বয়ের জন্য উৎসাহী করতে হবে, উদ্যোগ নিতে হবে। আর তখনই এগুলোকে জাতীয় জাগরণের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার করা সহজ হবে। বিশৃঙ্খলা নয়, তখনই মূলত শান্তির পরিবেশ তৈরি হবে। আবার বিক্ষিপ্ত ও বিচ্ছিন্ন ছাত্র-আচরণের জন্য ব্যাপকভাবে প্রতিষ্ঠানের ওপর চড়াও হওয়া যুক্তিযুক্ত তো নয়ই, বরং তা ভীষণ অমানবিক।

দ্বন্দ্বের সূচনায় হয়ত-বা ছাত্ররা। কিন্তু পরবর্তীতে সংঘটিত সকল ভাঙচুরের জন্য বিচার-বিবেচনাহীনভাবে শুধু এদের দায়ী করা খুব স্বাভাবিকীকরণ হয়ে যায়, তা পূর্বেই বলেছি। ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানে আক্রমণের এবং ধ্বংসলীলার যে চিহ্ন মিডিয়ায় উঠে এসেছে, তাতে মনে হয়, এ ছিল উপলক্ষ্য মাত্র। অজুহাতের বা পরিস্থিতির অপেক্ষায় কোনো গোষ্ঠী ওঁত পেতে ছিল হয়ত। অপরিণামদর্শী ছাত্রদের বাধভাঙা বিস্ফোরণ সে সুযোগে ঘি ঢেলে দিল মাত্র। আবার অন্যদিকে, যখন সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে দাঙা-পরিস্থিতি, ছাত্রদের কাছে পরিচিত প্রভাবশালী মুখদের নিয়ে উপস্থিত হলেই তা দ্রুত নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হত। কিন্তু এজন্য কেউ এগিয়ে আসেন নি।

এতো গেল একদিক। অন্যদিকে পুলিশের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে কিন্তু নানা বক্তব্য আসছে। বেড়ায় যদি ক্ষেত খায়, তাহলে সমাজ-প্রতিপালন কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। রাস্তায় সংঘটিত বচসার জন্য প্রতিষ্ঠানে ঢুকে অপরাধী ও নিরপরাধ বাছ-বিচার না করে সকল শিক্ষার্থীকে বেধড়ক মারধর, খুন-জখম ও হত্যা ঘৃণ্য কাপুরুষতার পরিচায়ক। উস্তাদ আলউদ্দিন খাঁর সঙ্গীতভবনসহ অপরাপর স্থাপনায় ভাঙচুর যেমন বিশ্বব্যাপী ধর্মোন্মাদনার বদনাম কুড়াবে, তেমনই গেটের তালা ভেঙে ছাত্র হত্যার মতো পাশবিক কাজের বদনামও জেলাবাসীর কাঁধে এসে বর্তাবে।

তাই আর উন্মাদনা নয়, প্রত্যেককেই নিজ অবস্থানে বসে আপন কৃতকর্মের মুখোমুখি দাঁড়ানো উচিত এবং আজই। ভবিষ্যৎ-শান্তি ও মুক্তির জন্য এর কোনো বিকল্প নেই। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। আমিন।রওশন জমির






Shares