ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৩৫ বধ্যভূমি, গণপূর্ত বিভাগের তথ্যে ৩টি
মহান স্বাধীনতার পর ধাপে ধাপে উন্নয়ন-অগ্রযাত্রায় এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। কিন্তু যাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে, সেই তাদের রক্তমিশ্রিত গণকবর ও বধ্যভূমিগুলো আজও পড়ে আছে অযত্ন আর অবহেলায়। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৩৪৩টি গণহত্যা সংঘটিত হয়; ৩৫টি বধ্যভূমি ও ১৮০টি গণকবর এর সাক্ষী। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা ও গবেষকরা এসব তথ্য জানান। অথচ জেলা গণপূর্ত বিভাগ বলছে, তাদের কাছে মাত্র ৩টি বধ্যভূমির তথ্য রয়েছে।
সাবেক মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হারুনুর রশিদ বলেন, জেলার যে কয়টি বধ্যভূমি বা গণকবর সংরক্ষণ বা চিহ্নিত হয়েছে সেগুলো মুক্তিযোদ্ধারাই করেছে। এসব চিহ্নিত করতে সরকারি তেমন কোনো উদ্যোগ ছিল না। সরকারিভাবে দ্রুত সব বধ্যভূমি সংরক্ষণের দাবি জানাই।
গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সাকিউল আলম বলেন, আমাদের কাছে শুধু তিনটি বধ্যভূমির তথ্য রয়েছে। তাছাড়া বধ্যভূমি বা গণকবর সংরক্ষণে কোনো অর্থ আমাদের বরাদ্ধ দেওয়া হয়নি।
যুদ্ধকালীন কমান্ডার ও জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আল মামুন সরকার বলেন, সম্প্রতি আমি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। জেলা পরিষদ থেকে বধ্যভূমি ও গণকবরগুলো সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা যায় কিনা, তা নিয়ে আমরা আলোচনা করব। এ ছাড়া জেলা প্রশাসন বা সরকারের অন্য কোনো বিভাগ এ বিষয়ে উদ্যোগ নিলে জেলা পরিষদ থেকে সর্বাত্মক সহায়তা করা হবে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা প্রশাসক মো. শাহগীর আলম বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় সংগঠিত গণহত্যার বা বধ্যভূমির তেমন কোনো তথ্য জেলা প্রশাসনের কাছে নেই। নতুন তালিকা প্রণয়নের কাজ শুরু করেছি। তালিকা হওয়ার পর এগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হবে।
এদিকে মুক্তিযুদ্ধের গবেষক কবি জয়দুল হোসেন জানান, তার জানামতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় চারটি বধ্যভূমি সংরক্ষিত আছে। এগুলো হলো- সরাইলের বিটঘর, নবীনগরের খাড়ঘর, সদরের পৈরতলা ও আখাউড়ার গঙ্গাসাগর বধ্যভূমি। অথচ তৎকালীন ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহকুমায় ৩৪৩টি গণহত্যা সংগঠিত হয়। এখানে ৩৫টি বধ্যভূমি, ১৮০টি গণকবর রয়েছে। নির্যাতন চালানো হয় ৯২টি কেন্দ্রে।
জেলার বীর মুক্তিযোদ্ধা ও গবেষকরা জানান, মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অসংখ্য নির্যাতন-গণহত্যার ঘটনা ঘটে। প্রতিটি ঘটনা মর্মস্পর্শী। এর মধ্যে একটি হলো- ঢাকার সূত্রাপুর ও মুন্সীগঞ্জ থেকে প্রায় দেড়শো নারী-পুরুষ দুটি লঞ্চে করে
নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশে পালিয়ে যাওয়ার সময় ৭১-এর ১৭ জুলাই বাঞ্ছারামপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সোহরাব হোসেন তাদের আটক করে। এর পর পার্শ্ববর্তী হোমনা থানার পাকবাহিনীকে খবর দেয়। খবর পেয়ে একজন পাঞ্জাবি ক্যাপ্টেন, রাজাকারসহ একশো পাকিস্তানি সৈনিক বাঞ্ছারামপুরে পৌঁছে। শুরু হয় অমানবিক নির্যাতন। পুরুষদের থানায় আটকে রাখা হয়। হাসপাতাল ও বালিকা বিদ্যালয়ের ভেতর রাতভর নারীদের ওপর চলে পাশবিক নির্যাতন। পরদিন ১৮ জুলাই লঞ্চযোগে সবাইকে হোমনায় নিয়ে গিয়ে হত্যা করা হয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের মোড়াইলে খ্রিস্টান মিশন হাউসের ভেতর নির্জন স্থানে দিনের পর দিন গণহত্যার ঘটনা ঘটে। এলাকাটি একটি বৃহৎ বধ্যভূমিতে পরিণত হয়। মিশন হাউসের উত্তর পাশে ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজে ছিল পাকিস্তান বাহিনীর ক্যাম্প ও নির্যাতন কেন্দ্র। এখানে নির্যাতন শেষে মিশন হাউসের ওই নির্জনস্থানে নিয়ে হত্যা করে মাটিচাপা দেওয়া হতো। কয়েক দফায় এখানে সহস্রাধিক লোককে হত্যা করা হয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের পশ্চিম পাশে পৈরতলা এলাকায় একটি রেলব্রিজের দক্ষিণপাশে ১৬, ২০ ও ২১ নভেম্বর ৩ দিনে প্রায় ৫শ লোককে হত্যা করে মাটিচাপা দেওয়া হয়। অনেক লাশ ফেলে দেওয়া হয় পাগলা নদীতে।
এমনিভাবে সারা ব্রাহ্মণবাড়িয়াজুড়েই মুক্তিযুদ্ধের কয়েক মাসে বর্বরতার ছাপ রাখে পাক হানাদার ও তাদের দোসর রাজাকাররা। শহরের পৈরতলা রেলব্রিজ, কুরুলিয়ার খালের পাড়ে অগণিত এবং দাতিয়ারায় ১৩ জন, দারিয়াপুরে ৩ জনকে হত্যা করা ছাড়াও কারাগার থেকে বের করে অগণিত মানুষকে হত্যা করা হয়। এ ছাড়া বিজয়নগর উপজেলার বিষ্ণপুর, কালাছড়া, সিংগারবিল, কংকরবাজার, মেরাশানী, আউলিয়া বাজার, চান্দুরা, সদর উপজেলার মজলিশপুর, রামরাইল, বিজেশ্বর, আটলা এলাকায় গণহত্যার শিকার অগণিত মানুষের কবর রয়েছে। অনেক মানুষকে হত্যা করে তিতাস নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া হয়। কসবার মান্দারপুর, শিকারপুর, খাড়েরা, রাউৎহাট, চকচন্দ্রপুর, হরিয়াবহ, বিষ্ণাউড়ি, চ-িদ্বার, আকবপুর, আকছিনা, আড়াইবাড়ি, শাহপুর, চড়নাল, শান্তিপুর, মন্দভাগ, ছোট বায়েক, মাদলা, আখাউড়া উপজেলার উজানিসার ব্রিজ, ধরখার, মনিয়ন্ধ, গঙ্গাসাগর, নিলখাত, নারায়ণপুর, খালাজোড়া, জঙ্গাল, টানমান্দাইল পাকসেনাদের বর্বরতার সাক্ষী। আশুগঞ্জ উপজেলার ভবানীপুর, সাইলোর পশ্চিমপাশে মেঘনা নদী, আইজি এমএন স্টিমার কোম্পানির ঘাট, সোনারামপুর, লালপুর, নাসিরনগর থানার চাতলপাড়, কুলিকুন্ডা, দাউরা, নিশ্চিন্তপুর, গুতমা, বুরু-া, চিতনা, গুনিয়াউক, নবীনগর উপজেলার খারঘর, সেমন্তঘর, বিদ্যাকুট, জাঙ্গাল, লক্ষীপুর, দড়িলাপাং, আলীয়াবাদ, গোপালপুর, খাজানগর পাকবাহিনীর গণহত্যার নির্মম সাক্ষী। এ ছাড়া নবীনগর পাইলট স্কুলের মাঠ, থানাসংলগ্ন এলাকা, বাঘাউড়া, সরাইল উপজেলার বিটঘর, ধমতীর্থ, কুচনী-বুড্ডা, শাহবাজপুর তিতাস নদীর ব্রিজের পাশে, ওয়াপদা রেস্ট হাউসের দক্ষিণ পাশে, পানিশ্বর, কালিকচ্ছ, বাঞ্ছারামপুর বড় ভেলানগর ও রূপসদী গ্রামের বাড়ি ঘরে আগুন দেওয়া হয় এবং ১৩ জন নিরীহ মানুষকে ধরে নিয়ে হত্যা করা হয়। এ ছাড়া বাঞ্ছারামপুর থানা কম্পাউন্ড, থানাসংলগ্ন তিতাস নদী, হাসপাতাল ও বালিকা বিদ্যালয়সহ বিভিন্ন এলাকায় নারী নির্যাতন ও গণহত্যা হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বধ্যভূমিগুলো চিহ্নিত করে সেগুলো সংরক্ষণ ও স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের দাবি জানান মুক্তিযোদ্ধাসহ সচেতন মহল।সূত্র: আমাদের সময়