সৌদি আরবে ছয় দিক থেকে জীবন পাল্টাচ্ছে
‘তেলের প্রতি’ আসক্তি শেষ হওয়ার প্রেক্ষিতে মুসলমানদের পবিত্র ভূমি সৌদি আরব অর্থনৈতিক সংস্কারের দিকে যাচ্ছে। ফলে দেশটিতে চলতি ২০১৮ সালের শেষে অন্তত ছয় দিক থেকে জীবন পাল্টে যাচ্ছে।
সৌদি আরবে পরিবর্তনের গতি এখন দ্রুত। ২০১৬ সালে ক্ষমতায় আসার পর প্রিন্স মোহাম্মেদ বিন সালমান তার ভিশন ২০৩০ ঘোষণা করেছেন। এরই মধ্যে তিনি বেশ কিছু সংস্কার করেছেন।
বিশ্বজুড়ে সরকারকে পরামর্শ সেবা দেয়া প্রতিষ্ঠান মেনা ক্যাটালিস্টের প্রধান নির্বাহী স্যাম ব্ল্যাটেইস বলছেন, বিমানের গতিতে আগাচ্ছে সৌদি আরব। তবে এত দ্রুত পরিবর্তন সম্ভবত খুব একটা ভালো হচ্ছে না।
আগামী ১২ মাসে যেসব গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে সৌদি আরবে তার মধ্যে আছে:
১. জ্বালানির দাম বৃদ্ধি
দেশটির নাগরিকরা এরই মধ্যে বাড়তি টাকা খরচ করা শুরু করে দিয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে বড় তেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন সংস্থা আরামকো গত ১ জানুয়ারি দাম ১২৭ শতাংশ বাড়িয়েছে। এখন প্রিমিয়াম কোয়ালিটির তেল লিটার প্রতি ২.০৪ রিয়েলে বিক্রি হচ্ছে।
রিয়াদভিত্তিক পত্রিকা আল রাঝি বলেছে, দাম বাড়ানোয় তেলের ব্যবহার করবে। তবে তেল ছাড়া অন্য খাতের প্রবৃদ্ধির দিকে সরকারকে নজর দিতে হেবে।
তেল ছাড়াও অন্যান্য ভোগ্যপণ্য কিনতেও সৌদি নাগরিকদেরকে এখন বেশি খরচ করতে হচ্ছে। ১ জানুয়ারি থেকে প্রায় সব ধরনের পণ্যে ৫ শতাংশ বিক্রয় কর আরোপ হয়েছে। তেল ছাড়া অন্য উৎস থেকে সরকারের আয় বাড়াতেই এই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
২. ফিরে আসছে চলচ্চিত্র
সৌদি নাগরিকরা দল বেঁধে এখন সিনেমা উপভোগ করতে পারবে।
৩৫ বছরের নিষেধাজ্ঞা শেষে চলতি বছর থেকেই সরকার বাণিজ্যিক সিনেমা হলের লাইসেন্স দেয়া শুরু করেছে। মার্চের মধ্যেই এই হলগুলো চালু হওয়ার আশা করা হচ্ছে।
আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন ব্যবসায়িক গোষ্ঠী এই সুযোগ নিতে চাইছে। তিন কোটি মানুষের বাজার রয়েছে সেখানে। আর সৌদি আরবে সিনেমার বাজার বছরে ১০০ কোটি ডলার হতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।
৩. গাড়ি চালাবে নারীরা
নারীদের গাড়ি চালানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা আগামী জুনে উঠে যাচ্ছে। গত সেপ্টেম্বরে জারি করা আদেশে এই ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
বছরের পর বছর ধরে বহু নারী সেখানে এই অধিকারের দাবিতে লড়াই করে আসছিল। আর নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও বেশ কিছু নারী গাড়ি চালানো শুরু করে জরিমানাও গুণেছে।
সরকারের এই সিদ্ধান্ত অর্থনীতিতে নারীদের আরও বেশি ভূমিকা রাখার সুযোগ তৈরি করবে বলে আশা করা হচ্ছে। এখন পর্যন্ত দেশটিতে ২২ শতাংশ নারী শ্রমবাজারে অবদান রাখছে। ভিশন ২০৩০ তে সরকার এটিকে ৩০ শতাংশে নিয়ে যেতে চায়।
সরকার চাইছে মোট, দেশজ উৎপাদন বা জিডিপির ৬৫ শতাংশ আসুক বেসরকারি খাত থেকে। নারীদেরকে ঘরের বাইরে নিয়ে আসাকে লক্ষ্য অর্জনের একটি হাতিয়ার হিসেবে দেখছেন দেশটির নীতি নির্ধারকরা।
৪. স্টেডিয়ামেও যাবেন নারীরা
প্রধান শহরগুলোতে নারীদেরকে স্টেডিয়ামে গিয়ে খেলা দেখার সুযোগ তৈরি হচ্ছে।
চলতি বছরের শুরুতে সরকারি ক্রীড়া কর্তৃপক্ষ ঘোষণা দিয়েছে যে আগামী অক্টোবর থেকে দেশের তিনটি প্রধান স্টেডিয়ামে পরিবারের সদস্যদেরকে নিয়ে যাওয়া যাবে।
সৌদি আরবে প্রকাশ্যে নারী ও পুরুষদের মেলামেলা নিষিদ্ধ। তাদেরকে আলাদা এলাকায় অবস্থান করতে হয়। তবে এই নিষেধাজ্ঞাও ধীরে ধীরে শিথিল হতে শুরু করেছে। ২০১৭ সালে বেশ কিছু গনের কনসার্টে নারী এবং পুরুষরা একসঙ্গেই যোগ দিয়েছে।
সৌদি আমেরিকান পাবলিক রিলেশন এফেয়ার্স কমিটির প্রেসিডেন্ট সালমান আল আনসারি বলছেন, চলতি বছর সবচেয়ে বড় দৃষ্টিগ্রাহ্য পরিবর্তন আনতে যাচ্ছে নারী অধিকারের দিক থেকে। তিনি বলেন, ‘এমনকি মন্ত্রী হিসেবে নারীদের নিয়োগ দেয়া হলেও আমি অবাক হব না।’
৫. চালু হচ্ছে পর্যটন ভিসা
প্রথমবারের মতো পর্যটক হিসেবে সৌদি আরব ঘুরতে যাওয়ার সুযোগ তৈরি হচ্ছে।
সৌদি পর্যটন ও জাতীয় ঐহিত্য বিষয় কমিশনের প্রধান রাজপুত্র সুলতান বিন সালমান যুক্তরাষ্ট্রের গণমাধ্যম সিএনএনকে জানিয়েছেন, ২০১৮ সালেই তারা প্রথমবারের মতো পর্যটন ভিসা দিতে যাচ্ছেন।
এতদিন পর্যন্ত দেশটিতে পবিত্র নগরী হিসেবে স্বীকৃতি এলাকা এবং চাকরির জন্য ভিসা দেয়া হতো।
সৌদি রাজ পর্যটন খাতকে গুরুত্ব দিয়ে নানা পরিকল্পনাও হাতে নিয়েছে। রেড সির বালুকাময় সৈকত এলাকায় এরই মধ্যে বেশ কিছু রিসোর্ট বা বিনোদনকেন্দ্র গড়ে তোলার প্রকল্প ঘোষণা করা হয়েছে। ২০৩০ সালে এই খাত থেকে ৩০ বিলিয়ন ডলার আয়ের আশা করছে দেশটি। ২০১৬ সালে এই আয় ছিল ১৮ মিলিয়ন ডলার।
৬. রাষ্ট্রীয় তেল কোম্পানি আরামকোর শেয়ার বিক্রি
সৌদি কর্তৃপক্ষ এরই মধ্যে একাধিকবার জানিয়েছে যে, তারা আরামকোর কিছু শেয়ার বিক্রির পরিকল্পনা করছে। এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে এটি দেশটির পুঁজিবাজারের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় তালিকাভুক্তি হতে যাচ্ছে।
কর্মকর্তারা বলছেন, তারা আরামকোর শেয়ার বিক্রি করে দুই ত্রিলিয়ন বা ১০ হাজার কোটি ডলার আয়ের আশা করছেন। পুঁজিবাজার কর্তৃপক্ষ একমত হলে পাঁচ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করলেই আয় হবে ১০০ বিলিয়ন ডলার।
তবে পুঁজিবাজারে করে থেকে আরামকোর প্রাথমিক গণপ্রস্তাব বা আইপিওর আকার এবং কবে এটি ঘোষণা করা হবে, সেটি অবশ্য এখনও নিশ্চিত নয়। তবে তারা শুরুতে কৌশলগত বিনিয়োগকারীদের কাছে এই শেয়ার বিক্রি করছে।