শান্তি, সম্প্রীতি ও উন্নয়নের কান্ডারি কাতারের আমির
কোনো আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বিশ্বনেতারা যখন এক মঞ্চে সমতলে সবাই একসঙ্গে দাঁড়ান, তখন যার শির সবার চেয়ে উঁচু দেখা যায়, তিনি কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আলথানি। সদাহাস্যমুখ কাতারের এই আমির যেমন উচ্চতায় অন্য বিশ্বনেতাদের চেয়ে ভিন্ন, তেমনি নেতা হিসেবে তার দূরদর্শিতা ও দক্ষতা সমকালীন বিশ্বের অন্য শাসকদের তুলনায় অনন্য। এর প্রমাণ মেলে সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ব রাজনীতি ও অর্থনীতিতে কাতারের অব্যাহত সাফল্য এবং অর্জনে।
শুধুমাত্র উপসাগরীয় অঞ্চল অথবা মধ্যপ্রাচ্য নয়, বরং এশিয়া ও আফ্রিকাসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও অঞ্চলে নিজ যোগ্যতা ও দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন কাতারের আমির। বিশেষ করে সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে শান্তি, নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে আমির শেখ তামিমের আন্তরিক প্রয়াস বর্তমান অস্থির পৃথিবীতে বিরল বলা চলে।
২০১৪ সালে সিরিয়ার জাবহাতুন নুসরা গোষ্ঠীর হাতে অপহৃত লেবাননি ১৬ সেনা ফিরিয়ে আনতে ২০১৫ সালে কাতারের মধ্যস্থতা সফল হওয়ার পেছনে কাতারের আমিরের দূরদর্শিতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। একইসময়ে লিবিয়ায় বিবাদমান দুটি গোত্র তাবাও এবং তাওয়ারেকের মধ্যে সন্ধি স্থাপন করে দেয় কাতার। ২০১৫ সালের ২৩ নভেম্বর কাতারের রাজধানী দোহায় কয়েকদিনের সমঝোতা বৈঠক শেষে সন্ধিচুক্তিতে স্বাক্ষর করে দীর্ঘদিন ধরে হানাহানিতে ব্যস্ত দু পক্ষ।
আফ্রিকার দেশ সুদানের দারফুরে সরকার ও বিদ্রোহী গোষ্ঠীর মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনতে কাতারের উদ্যোগ সফল হওয়ায় শান্তি ফিরে আসে ওই অঞ্চলে। ২০১৩ সাল থেকে বেশ কয়েকবার ফিলিস্তিনের বিরোধপূর্ণ দুটি দল হামাস ও ফাতাহ কাতারের মধ্যস্থতায় দোহায় শান্তি আলোচনায় বসে। পাশাপাশি একই অঞ্চলের দুটি দেশ জিবুতি এবং ইরিত্রিয়ার সরকারের মধ্যে সীমান্ত সম্পর্কিত সংঘাত মিটিয়ে শান্তিচুক্তিতে স্বাক্ষর করার পেছনে কাতারের মধ্যস্থতা মূল ভূমিকা রাখে। পাশাপাশি আফগানিস্তানে তালেবান ও হামিদ কারজাইয়ের সরকার পক্ষের মধ্যে বৈঠক আয়োজনে কাতারের অবদান অনস্বীকার্য।
এভাবেই দেশে দেশে শান্তি, স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে আলাপ আলোচনা ও সমঝোতাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের এসব উদ্যোগের পেছনে কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদের ব্যক্তিগত আগ্রহ ও দূরদর্শিতা এবং দক্ষতা আজ বিশ্বজুড়ে সমাদৃত এবং প্রশংসনীয়। উপসাগরীয় অঞ্চলের অন্য পাঁচটি দেশের সঙ্গে কাতারের ভ্রাতৃত্ব ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক জোরদার করতে তাঁর আন্তরিকতা এবং উদারতা এ অঞ্চলের পারস্পরিক ঐক্য ও সহযোগিতামূলক সম্পর্ক আরও মজবুত করছে। সৌদিআরবের বর্তমান বাদশাহ সালমান বিন আব্দুল আজিজের কাতার সফর এর সাম্প্রতিক নমুনা বলা চলে।
ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে কাতারের শাসক হিসেবে এই দেশকে আধুনিকতা ও উন্নয়নের রাজপথে ক্রমান্বয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে নিতে যারা অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখেছিলেন, কাতারের ইতিহাসে তারা সবাই আজো চির স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন। ১৮৫০ সাল থেকে ১৮৭৮ সাল পর্যন্ত কাতার নামক এই ভূখন্ডের শাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন শেখ মুহাম্মদ বিন থানি। এরপর ১৮৭৮ সাল থেকে ১৯১৩ সাল পর্যন্ত এ দায়িত্ব পালন করেন শেখ জাসেম বিন মুহাম্মদ আলথানি। ১৯১৩ সালে কাতারের শাসনভার গ্রহণ করেন শেখ আব্দুল্লাহ বিন জাসেম আলথানি। তাঁর আমলেই কাতারে তেল আবিষ্কৃত হয়। ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত তিনি কাতারের নেতৃত্ব দেন। এরপর ১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৬০ সাল পর্যন্ত কাতারের শাসক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন শেখ আলি বিন আব্দুল্লাহ আলথানি। ১৯৬০ সাল থেকে ১৯৭২ সাল পর্যন্ত কাতারের আমির ছিলেন শেখ আহমদ বিন আলি আলথানি। সম্পূর্ণ স্বায়ত্ত্বশাসিত স্বাধীন কাতারের প্রথম আমির হিসেবে কাতারের শাসনকার্য পরিচালনা করেন শেখ খলিফা বিন হামাদ আলথানি। ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত তিনি কাতারের নেতৃত্বে ছিলেন। এরপর ১৯৯৫ সালে কাতারের আমির হিসেবে দায়িত্ব পালন শুরু করেন শেখ হামাদ বিন খলিফা আলথানি। ২০১৩ সালে তিনি ক্ষমতার ভার তুলে দেন পুত্র শেখ তামিম বিন হামাদ আলথানির কাঁধে।
২০১৩ সালের ২৫ জুন বাবা শেখ হামাদ বিন খলিফা আলথানির কাছ থেকে কাতারের আমির হিসেবে যখন শাসনভার গ্রহণ করেন শেখ তামিম বিন হামাদ আলথানি, তখন তাঁর বয়স মাত্র ৩৩ বছর। এর মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের সর্বকনিষ্ঠ শাসক হিসেবে তিনি বিশ্ব রাজনীতির মঞ্চে আর্বিভূত হন। সেই থেকে আজ অবধি উন্নয়ন, শান্তি ও নিরাপত্তার অগ্রযাত্রায় কাতারকে দক্ষ নেতৃতেএ এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন এই তরুণ আমির।
কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আলথানি কাতারের রাজধানী দোহায় জন্মগ্রহণ করেন ১৯৮০ সালের ৩ জুন। ১৯৯৭ সালে ব্রিটেনের শেরবর্ন স্কুল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। এরপর ব্রিটেনের রয়েল মিলিটারি একাডেমি স্যান্ডহার্সট থেকে ¯œাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ব্রিটেনে উচ্চ শিক্ষা শেষে তিনি কাতারে ফিরে আসেন এবং দেশের শাসনকাজে বাবার সঙ্গে থেকে নিজেকে প্রতিনিয়ত যোগ্য করে তোলেন।
মাতৃভাষা আরবির পাশাপাশি তিনি ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় পারদর্শী। ২০০৩ সালের ৫ আগস্ট তিনি কাতারের যুবরাজ হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। তাঁর আগে যুবরাজ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলেন তাঁর ভাই শেখ জাসেম বিন হামাদ আলথানি।
একটি দেশকে এগিয়ে নিতে অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নের পাশপাশি খেলাধুলার প্রতি কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আলথানি সবসময় বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকেন। বিশেষ করে ফুটবলের উন্নয়নে তিনি সবসময় ঈর্ষণীয় ভূমিকা রাখছেন। ২০০৫ সালে তিনি ফুটবলজগতে বিনিয়োগের জন্য একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। এই প্রতিষ্ঠান পরবর্তীতে ফ্রান্সের ফুটবল দল প্যারিস সেন্ট জার্মান কিনে নেয়। একইসঙ্গে বার্সালোনা ফুটবল দলেও এ প্রতিষ্ঠানটির অংশ রয়েছে।
২০০৬ সালের এশিয়ান গেমস এবং ২০১৪ সালের বিশ্ব সাঁতার চ্যাম্পিয়নশীপ আয়োজন সফল করার পেছনে কাতারের আমির শেখ তামিমের নেতৃত্ব এবং দিকনির্দেশনা মূল ভূমিকা রাখে। আগামী ২০২০ সালের অলিম্পিক আয়োজক কমিটির প্রধান হিসেবে এবং ২০২২ সালে অনুষ্ঠিতব্য ফুটবল বিশ্বকাপ আয়োজনেও তাঁর আগ্রহ ও সহযোগিতা এবং সর্বোপরি নেতৃত্ব কাতারকে বিশ্ব ক্রীড়াঙ্গণে প্রতিনিয়ত শক্তিশালী অবস্থানে নিয়ে যাচ্ছে।
খেলাধুলার পাশাপাশি কাতারের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি চর্চা ও এর বিকাশে কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদের আগ্রহ প্রশংসনীয়। তাঁর নেতৃত্ব এবং দিকনির্দেশনায় কাতারে একে একে গড়ে উঠেছে অ্যাস্পায়ার জোন, কাতারাসহ আন্তর্জাতিক মানের বিভিন্ন বিশেষ অঞ্চল ও প্রতিষ্ঠান।
কেবল রাষ্ট্র হিসেবে নয়, বরং কাতার বিশ্বজুড়ে আজ শান্তি, নিরাপত্তা, উন্নয়নের এক গৌরবময় প্রতীক। আর এর পেছনে কান্ডারির ভূমিকায় থেকে সব প্রতিকূলতা উপেক্ষা করে যিনি এ দেশকে নিয়ে যাচ্ছেন উন্নতির শেখরে, তিনি আজকের বর্তমান আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আলথানি। তার সফল নেতৃত্বের ফলে কাতারের নাগরিকরা যেমন অর্থনৈতিকভাবে আজ পৃথিবীর অন্যতম শীর্ষ ধনী জাতিতে পরিণত হয়েছে, তেমনিভাবে কাতারজুড়ে চলমান নির্মাণযজ্ঞের বদৌলতে লাখো বিদেশি অভিবাসীর মুখে আজ স্বস্তির হাসি ফুটছে। নাগরিক ও বিদেশি অভিবাসীসহ ২৫ লাখ জনসংখ্যার এই দেশ কাতার এভাবেই বিশ্বময় শান্তি, সম্প্রীতি ও উন্নয়নের বার্তাবাহক কান্ডারি হয়ে থাকুক, এ প্রত্যাশা সবার।