বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর হামলা: সুষমা স্বরাজের টুইট নিয়ে বিতর্ক
বিবিসি বাংলা:: বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দুদের বাড়িঘর ও মন্দিরে হামলা-ভাঙচুর অগ্নিসংযোগের পর ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের এক টুইটার বার্তায় ‘গভীর উদ্বেগ প্রকাশ’ এবং ‘ঢাকাস্থ হাইকমিশনারকে প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে বলার’ কথা জানানোর ঘটনা কূটনৈতিক মহলে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।
ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজের যে টুইট নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়েছে, সেটি করা হয়েছিল গতকাল রবিবার দুপুরে।
কী ছিল সেই টুইট বার্তায়?
টেম্পলট্রি১ হ্যান্ডল থেকে এক ব্যক্তি টুইটারে সুষমা স্বরাজের কাছে জানতে চেয়েছিলেন “বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর যে নির্যাতনের ঘটনা ঘটে চলেছে সে ব্যাপারে ভারত সরকার কী করছে?”
টুইটারে সম্পূর্ণ অপরিচিত ব্যক্তিদের করা প্রশ্ন বা আবেদনে খুব জলদি সাড়া দেওয়ার ব্যাপারে সুষমা স্বরাজের পরিচিতি আছে এবং এ ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম হয়নি।
মিস স্বরাজ প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দেন, “বাংলাদেশে নিযুক্ত ভারতের হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রীংলাকে তিনি নির্দেশ দিয়েছেন বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দেখা করার জন্য এবং বাংলাদেশে হিন্দুদের সুরক্ষা ও নিরাপত্তা নিয়ে ভারত যে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন, সেই বার্তা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্যও রাষ্ট্রদূতকে বলেছেন”।
এর মাত্র তিন দিন আগেই ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশে হিন্দুদের ওপর নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে যে বিবৃতি দিয়েছিল, তার তুলনায় সুষমা স্বরাজের এই বক্তব্য ছিল অনেক বেশি কঠোর।
কারণ তখন মুখপাত্র বিকাশ স্বরূপ যদিও বলেছিলেন যে হিন্দু নির্যাতনের বিষয়টি নিয়ে ভারতীয় দূতাবাস বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলছে, তিনি কিন্তু ‘কনসার্নড’ বা ‘উদ্বিগ্ন’ শব্দটি সচেতনভাবেই ব্যবহার করেননি।
টুইটারে সম্পূর্ণ অপরিচিত ব্যক্তিদের করা প্রশ্ন বা আবেদনে খুব জলদি সাড়া দেওয়ার ব্যাপারে সুষমা স্বরাজের পরিচিতি আছে
কিন্তু এর মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে হিন্দু মহল্লায় আরও এক দফা হামলা ও অগ্নিসংযোগের অভিযোগ ওঠে।
ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিজে তারপর যখন টুইট করলেন, তখন তিনি স্পষ্ট জানালেন যে ভারত এই ঘটনায় ‘গভীরভাবে উদ্বিগ্ন’ এবং শুধু তাই নয়, বিষয়টি নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের একেবারে সর্বোচ্চ পর্যায়ে তারা প্রতিকার দাবি করছেন।
সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলাপ করার কথা বলার বিষয়টিও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে।
গত চব্বিশ ঘন্টায় বাংলাদেশের একাধিক কূটনৈতিক সূত্রের সঙ্গে কথা হয়েছে এবং তারা কার্যত স্বীকারও করেছেন ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী যেভাবে তাদের রাষ্ট্রদূতকে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করার কথা বলেছেন, সেটাকে তারা কূটনৈতিক সৌজন্যের পরিপন্থী বলেই মনে করছেন।
একজন রাষ্ট্রদূত যে দেশে নিযুক্ত তিনি যখন সে দেশের সরকারের সঙ্গে কোনও বিষয়ে কথা বলতে চান, তখন তাকে সেটা করতে হয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমেই। এর বাইরে কখনও কখনও দুটো দেশের মধ্যে বিশেষ সম্পর্ক থাকতেই পারে, এমনকি কোনও রাষ্ট্রদূতের হয়তো স্বাগতিক দেশের সরকার প্রধানের কাছে সরাসরি যোগাযোগও থাকতে পারে – কিন্তু সেটা প্রকাশ্যে জানানো চলে না এমনটাই কূটনৈতিক রীতি বলে মনে করা হয়।
ঠিক এখানেই সুষমা স্বরাজের টুইট নিয়ে বাংলাদেশের আপত্তি, কারণ তিনি ঠিক সেই কথাটাই প্রকাশ্যে টুইট করে বলেছেন – যদিও দুই দেশের সুসম্পর্কের স্বার্থে ঢাকা বিষয়টি নিয়ে সরকারিভাবে কোনও প্রতিবাদ জানায়নি বা বিবৃতিও দেয়নি।
দ্বিতীয় দফায় রাতের আঁধারে এসে বাড়িতে-মন্দিরে আগুন লাগিয়ে দিয়ে যাবার পর নাসিরনগরের হিন্দুরা এখন বাড়ির মূল্যবান মালামাল নিরাপদে সরিয়ে রাখতে শুরু করেছেন।
আগামী মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রস্তাবিত ভারত সফর নিয়ে আলোচনার জন্য আগামীকাল মঙ্গলবার বাংলাদেশের পররাষ্ট্রসচিব শহীদুল হকের দিল্লি আসার কথা, ফলে তার আগে কোনও কূটনৈতিক মনোমালিন্যের সম্ভাবনাও দুপক্ষই এড়িয়ে চলতে চাইছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়াতে হামলার সাতদিন পর সুষমা স্বরাজ কেন এমন একটা বিবৃতি দিলেন – কী মনে করা হচ্ছে?
ভারতের বর্তমান বিজেপি সরকারের ঘোষিত নীতিই হলো, প্রতিবেশী দেশগুলোতে সংখ্যালঘু হিন্দুরা যদি নির্যাতিত হন তাহলে ভারত তাদের আশ্রয় দেবে, এমনকি কোনও কোনও ক্ষেত্রে নাগরিকত্বও দেবে।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও একাধিকবার বলেছেন, পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশে হিন্দুরা নির্যাতিত হলে তাদের আসার জায়গা একটাই – সেটা হলো ভারত।
ফলে বাংলাদেশে যখন হিন্দুদের ওপর হামলার ঘটনা ঘটছে, তখন ভারত সরকারের পক্ষে একেবারে নীরব থাকা সম্ভব নয় – যদিও শেখ হাসিনা সরকারের ওপর আস্থা রেখে তারা এ ব্যাপারে যতটা সম্ভব কূটনৈতিক সংযমও বজায় রাখতে চেয়েছে।
কিন্তু দিন সাতেক পরেও পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় মুখ খুলেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ।
যদিও সেটা করতে গিয়ে কূটনৈতিক প্রোটোকল ঠিকমতো রক্ষিত হয়নি – অভিযোগটা সেখানেই উঠেছে।