Main Menu

ফাহিম সালেহ: নিউইয়র্কে খুন হওয়া বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত টেক মিলিওনিয়ার অল্প বয়সেই সুপরিচিত ছিলেন উদ্যোক্তা জগতে

+100%-

বিবিসি বাংলা:: নিউইয়র্কে নিজের অ্যাপার্টমেন্টে নৃশংসভাবে খুন হওয়া ফাহিম সালেহ নিজের সম্পর্কে ওয়েবসাইটে লিখেছিলেন অন্ট্রেপ্রেনিওর, ইনভেস্টর, ড্রিমার অর্থাৎ উদ্যোক্তা, বিনিয়োগকারী, স্বপ্নবাজ।

ঢাকায় তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও সহকর্মী হুসেইন এম ইলিয়াস বলছিলেন যে সত্যিকার অর্থেই একজন স্বপ্নবাজ মানুষ ছিলেন ফাহিম সালেহ।’পাঠাও’ নামের যে রাইড শেয়ারিং অ্যাপ বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয়, তার প্রতিষ্ঠাতাদের একজন ছিলেন ফাহিম সালেহ। আরেকজন হলেন হুসেইন এম ইলিয়াস।

“খুব কম মানুষই এতো তাড়াতাড়ি কিংবা এতো অল্প বয়সে সফল হয়েছিলেন। এর কারণ হলো খুবই উদ্যমী ও পরিশ্রমী মানুষ ছিলেন তিনি,” বিবিসি বাংলাকে বলেন হুসেইন ইলিয়াস।”এক জায়গায় আটকে থাকতেন না তিনি। এজন্যই একটার পর একটা উদ্যোগ নিয়েছেন। কোনটায় সফল হয়েছেন, আবার কোনটায় হননি। কিন্তু হাল ছাড়েননি।”

ফাহিম সালেহ বাংলাদেশি বাবা-মায়ের সন্তান হলেও বাংলাদেশে খুব একটা থাকেননি। ইনফরমেশন সিস্টেম নিয়ে পড়াশোনা করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের বেন্টলি বিশ্ববিদ্যালয়ে।

মাত্র ৩৩-বছর বয়সে যে অ্যাপার্টমেন্টে খুন হন তিনি, তার দাম বাংলাদেশী মুদ্রায় প্রায় ২২ কোটি টাকা। নিজের কেনা অ্যাপার্টমেন্টে খুন হওয়া ফাহিম সালেহ বড় হয়েছেন নিউইয়র্কেই, এবং পেশায় ছিলেন ওয়েবসাইট ডেভেলপার।

সেখানকার গণমাধ্যম তাকে চিহ্নিত করেছে “টেক মিলিওনিয়ার” হিসেবে।

“খুব অল্প বয়সেই কাজ শুরু করেছিলেন তিনি। ১৫/১৬ বছর থেকে আমেরিকাতেই কাজ শুরু করেন – আইটি ফিল্ডেই। ফলে ২০১৪ সালে যখন ঢাকায় আসেন, তার আগেই প্রযুক্তির বিশ্বে তিনি পরিচিত ব্যক্তি, এবং সেটা তার কাজের জন্যই,” বলছিলেন মিস্টার ইলিয়াস।

পাঠাও প্রতিষ্ঠার আগেই ফাহিম সালেহ ঢাকায় দু’টি প্রতিষ্ঠান খুলেছিলেন, যার মধ্যে একটি ছিলো হ্যাকহাউজ – অফিস ছিলো বনানীতে।

এখানেই কাজ করতে এসে হুসেইন ইলিয়াস তার সঙ্গে পরিচিত হন এবং পরবর্তীতে তারা দু’জনসহ মোট তিনজন মিলে অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং প্রতিষ্ঠান পাঠাও চালুর কাজ শুরু করেন।

আগের দু’টি উদ্যোগে কাঙ্ক্ষিত সফলতা না এলেও ২০১৬ সালের শেষের দিকে চালুর পর পাঠাও দারুণ জনপ্রিয়তা পায় ২০১৭ সালে।

উদ্যোগ আর চিন্তা ছিলো নানা দেশে

তরুণদের জন্য ফাহিম সালেহ তৈরি করেছিলেন আইকনডুড ডটকম এবং এআইএমডুড ওয়েবসাইট। পনের বছর বয়স থেকেই কাজ শুরু করে উদ্যোক্তা জগতে বেশ খ্যাতি অর্জন করেছিলেন তিনি।

পাশাপাশি ছিলেন অ্যাডভেঞ্চার ক্যাপিটাল গ্লোবালেরও একজন উদ্যোক্তা।

মিস্টার ইলিয়াস বলেন, ফাহিম সালেহ সবসময়ই প্রযুক্তি-ভিত্তিক নতুন কিছু করার চিন্তা করতেন।

“এক সময় পাঠাওয়ের শেয়ার ছেড়ে দিলেন, কারণ তখন তিনি আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলোতে কী করা যায় তা নিয়ে বেশ উদ্যোগী হয়ে উঠেছিলেন”।

বাংলাদেশের প্রযুক্তি খাতের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) বলছে, ফাহিম সালেহ বাংলাদেশের রাইড শেয়ারিং সেবা পাঠাও ছাড়াও নাইজেরিয়াতে ‘গোকাডা’ নামক আরেকটি রাইড শেয়ারিং প্ল্যাটফরম চালু করেন।

তার মৃত্যুর পর প্রকাশিত নানা খবরে বলা হচ্ছে যে তিনি কলম্বিয়াসহ ল্যাটিন আমেরিকার কয়েকটি দেশেও নানা ধরনের কার্যক্রম শুরু করেছিলেন।

“আসলে তিনি খুব উচ্চাভিলাষী চিন্তা করতেন এবং সেটি বাস্তবায়ন করতে পরিশ্রমও করতেন। ঝুঁকি নিতে পছন্দ করতেন তিনি। যখন বাংলাদেশে অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং ছিলো না, ই-কমার্স বলতে কিছু ছিলো না, তখন তিনি পাঠাওয়ে বিনিয়োগ করার ঝুঁকি নিয়েছিলেন”।

ঢাকায় এলে একাই বাসা ভাড়া করে থাকতেন ফাহিম সালেহ। ঢাকায় কী করছেন তা দেখাতে ২০১৮ সালের বাবা-মাকেও একবার নিয়ে এসেছিলেন আমেরিকা থেকে।

তবে বাংলাদেশে পাঠাওয়ের শেয়ার বিক্রি করে দিলেও অ্যাপভিত্তিক প্রতিষ্ঠান জোবাইক ও যাত্রীতে বিনিয়োগ করেছিলেন তিনি।

বিনিয়োগ ছিলো আলফাপটেটো নামের আরেকটি উদ্যোগেও।

নেপালের অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং প্লাটফরমেও বিনিয়োগ ছিল ফাহিম সালেহ’র।

কলম্বিয়াতে সবচেয়ে বড় মোটরসাইকেল রাইড শেয়ারিং কোম্পানি পিকাপ-এও বড় ধরণের বিনিয়োগ করেছিলেন তিনি।

অর্থকে অনুসরণ করো না, তাকেই তোমাকে অনুসরণ করতে দাও

নিজের ব্লগে ফাহিম সালেহ লিখেছিলেন, “ডোন্ট ফলো দা মানি, লেট ইট ফলো ইউ”।

তিনি লিখেন, যখন তিনি প্রথম ইন্টারনেট গেমস শুরু করেছিলেন, তখন তার লক্ষ্য ছিলো খরচ কমানো।

“কেন আমরা যুক্তরাষ্ট্র থেকে কাউকে ভাড়া করবো, যখন আউটসোর্সিংয়ের সুযোগ আছে! কেন প্রিমিয়াম সার্ভার কিনতে হবে, যেটা আছে সেটাই যখন ভালো কাজ করছে! কেন অফিস নিতে হবে, যখন বাসা থেকেই কাজ করা যাচ্ছে!

“কিন্তু যখন পেছন ফিরে তাকাই, তখন বুঝতে পারি যে আমরা আমাদের প্রবৃদ্ধিকে সীমিত করে ফেলেছি”।

নিজের প্রথম ওয়েবভেঞ্চার উইজটিন ইনক-এর প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন যে এটিকে সঠিকভাবে বাড়তে দিলে বিশ্বখ্যাত জিগনা বা স্লাইড-এর মতোই হতো। ২০০৫ সালে বেশ সম্ভাবনাময় হয়েছিলো অন্তত ১৫টি সাইটের নেটওয়ার্ক উইজটিন ইনক।

এরপর তিনি যে নীতি নিয়েছিলেন, তাও লিখেছেন তার ব্লগে।

“যতটা পারো কোম্পানিতে বিনিয়োগ করো, ঠিক যতটুকু দরকার ততটুকুই বেতন নাও, পরে আরও বিনিয়োগ করো … এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, অর্থকে অনুসরণ করো না, তাকেই তোমাকে অনুসরণ করতে দাও”।

প্রজেক্ট ও বিনিয়োগ

বিভিন্ন দেশে অ্যাপভিত্তিক রাইড শেয়ারিং কিংবা ওয়েবসাইট নেটওয়ার্কিং ছাড়াও তার ব্লগে যেসব প্রজেক্টের কথা তিনি উল্লেখ করেছন, সেগুলো হলো – প্রাংকডায়াল (এর মাধ্যমে বন্ধুদের কাছে ফানি কল পাঠানো হয়), ডলস্পট (বাচ্চাদের মোবাইল-ভিত্তিক গেমিং সাইট) এবং হ্যাকহাউজ (ঢাকা-ভিত্তিক উদ্যোগ)।

আরও বিনিয়োগ ছিল নিনজা ফিস স্টুডিওস-এ। এটি বাচ্চাদের মোবাইল গেমিং কোম্পানি।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেস (বেসিস) বলছে, ফাহিম সালেহ’র মৃত্যুতে দেশের আইটি ইন্ডাস্ট্রি কেবল একজন সফল উদ্যোক্তাকে হারায়নি, বরং দেশের তরুণ স্টার্টআপ উদ্যোক্তাগণ হারালো তাদের একজন অন্যতম অনুপ্রেরণাদাতা ও পথপ্রদর্শককে।

“তরুণদের মধ্যে স্টার্টআপস কমিউনিটি গড়ে তোলার যে উৎসাহ-উদ্দীপনা বিরাজ করছে, তাতে ফাহিম সালেহর এমন মৃত্যু নিঃসন্দেহে একটি বড় রকমের ধাক্কা হিসেবে প্রতিভাত হবে,” – এমনটিই বলা হয়েছে সংগঠনটির এক বিবৃতিতে ।






Shares