আনন্দবাজার:: মোদী-মমতা সাম্প্রতিক সংঘাতে আটকে গিয়েছে ভারত-বাংলাদেশ তিস্তা চুক্তি। তবে জলের ভাগ নিয়ে চুক্তি এখনই করা না-গেলেও, তিস্তা সংক্রান্ত একটি উপহার শীঘ্রই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাতে তুলে দেওয়ার কথা ভাবছে নরেন্দ্র মোদী সরকার। উত্তর সিকিমের ‘তিস্তা-৩’ জলবিদ্যুৎ প্রকল্পটি প্রায় শেষ হওয়ার মুখে। মার্চে বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু হতে পারে এই প্রকল্পের। কূটনৈতিক সূত্রে খবর, ১২০০ মেগাওয়াটের এই প্রকল্পটি থেকে ন্যূনতম শুল্কে একটি বড় অংশ বাংলাদেশকে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ভারত।
সিকিমের জলবিদ্যুৎ প্রকল্পগুলি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আপত্তি রয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিযোগ, সিকিমে পর পর জলবিদ্যুৎ প্রকল্প হওয়ায় শুখা মরসুমে তিস্তায় জল মেলে না। আবার বর্ষায় বাঁধ বাঁচানোর জন্য সিকিম বেপরোয়া জল ছাড়ায় উত্তরবঙ্গ ডুবছে। ঘরোয়া মহলে মমতা ক্ষোব প্রকাশ করে জানিয়েছেন, সিকিম ও বাংলার মুখ্যমন্ত্রীকে এক সঙ্গে বসিয়ে তিস্তার জল নিয়ে একটি আলোচনা প্রক্রিয়া শুরুর কথা তিনি প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীকে বার বার বললেও কোনও উদ্যোগ নেননি তিনি। এ ভাবে ঘরোয়া বিষয়গুলির সুরাহা না-করেই তাড়াহুড়ো করে প্রধানমন্ত্রী যে ভাবে তিস্তার জল বণ্টন নিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে চুক্তি করতে চাইছেন, তা মেনে নেওয়া যায় না।
তবে বিদেশ মন্ত্রকের এক কর্তার অভিযোগ, তিস্তার জলের ভাগ নিয়ে কথা বলার জন্য রাজ্যকে বার বার চিঠি দিয়েও কোনও জবাব মেলেনি। ওই কর্তার কথায়, সিকিমের জলবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে প্রতিবেশী দেশকে বিদ্যুৎ দেওয়া হলে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের আপত্তির কারণ থাকতে পারে না। কারণ মমতাও চান বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ হোক। সম্প্রতি বিজয় দিবস উপলক্ষে কলকাতায় ‘বাংলাদেশ উৎসব’-এর সূচনায় তিনি নিজে উপস্থিত ছিলেন।
ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে হাসিনার দিল্লি সফরের কথা এক রকম চূড়ান্তই হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ‘অনিবার্য’ কারণ দেখিয়ে ঢাকা সে সফর পিছিয়ে দেয়। সূত্রের খবর, নানা কারণের মধ্যে তিস্তা চুক্তি নিয়ে দিল্লির অগোছালো অবস্থাও এই সফর পিছিয়ে যাওয়ার কারণ। এর পরে বিদেশ প্রতিমন্ত্রী এম জে আকবর তড়িঘড়ি ঢাকায় গিয়ে প্রধানমন্ত্রী হাসিনার সঙ্গে কথা বলেন। সে বৈঠকের পর ঘোষণা করা হয়, ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে দিল্লি আসছেন হাসিনা। সাউথ ব্লক সূত্রের খবর, এই মুহূর্তে বাংলাদেশকে অখুশি করাটা মোদী সরকারের অভিপ্রেত নয়। বরং দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তা পরিস্থিতি এবং পাকিস্তানের সঙ্গে চলতি উত্তেজনার পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকাকে সঙ্গে নিয়ে চলাটাই দিল্লির অগ্রাধিকারের মধ্যে পড়ে। সরকারি এক কর্তার কথায়, ‘‘ভারত এর আগেও বাংলাদেশকে জলবিদ্যুৎ প্রকল্পে সামিল করেছে। ভবিষ্যতেও করবে।
তিস্তা নিয়ে কোনও উন্নয়নমূলক প্রকল্পে ঢাকাকে অংশীদার করা গেলে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে তা ইতিবাচকই হবে।’’ তাঁর কথায়, যত দিন না তিস্তার জলবণ্টন নিয়ে চুক্তি হচ্ছে, তিস্তা প্রকল্প থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎ পাওয়াটা বাংলাদেশের মানুষের জন্য কম লাভজনক নয়।
তিস্তার জলের ভাগ নিয়ে বাংলাদেশে যে আবেগ এবং প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে, সে ব্যাপারে বিদেশ মন্ত্রক অবহিত। মনমোহন সিংহের আমল থেকেই ঢাকার সঙ্গে বহু বার এই নিয়ে কথা হয়েছে দিল্লির। ঢাকার পক্ষ থেকে সর্বশেষ দাবি ছিল— পশ্চিমবঙ্গ সরকারের কিছু বক্তব্য থাকতেই পারে। কিন্তু একটি সময়সীমা নির্দিষ্ট করে একটা আলোচনা প্রক্রিয়া অন্তত শুরু করুক দুই দেশ। যৌথ নদী কমিশন স্তরেও এই আলোচনা করা যেতে পারে। ঢাকা চায়, শুধু আশ্বাসের বদলে জলের ভাগ কী হবে, তা নিয়ে আলোচনাটুকু অন্তত চলুক। ঘরোয়া রাজনীতিতে সেটা অগ্রগতি হিসেবে দেখাতে পারবে বাংলাদেশ সরকার।
নয়াদিল্লি অবশ্য মনে করে, তিস্তাকে রাজনৈতিক পর্যায়ে এতটা উচ্চগ্রামে নিয়ে যাওয়ায় আখেরে লাভের থেকে ক্ষতিই হয়েছে বেশি। বিষয়টিকে নিয়ে পাহাড়প্রমাণ প্রত্যাশা তৈরি না-হলে হয়তো ঢাকার পক্ষেও অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে কিছুটা সুবিধা হতো। সব মিলিয়ে বিষয়টি এখন কেন্দ্রের পক্ষে অস্বস্তিকর।
জল চুক্তি না হোক, জলবিদ্যুৎ দিয়ে সেই অস্বস্তি কতটা কাটতে পারে সেটাই এখন দেখার।