আতঙ্ক আর কান্নার নগর নিউইয়র্ক
নিউইয়র্কের সদা ব্যস্ত চেহারা একেবারে বদলে গেছে। আতঙ্কের মধ্যে আসছে শুধু সাইরেনের আওয়াজ। আর আছে অসহায় লোকজনের ফোনালাপ। স্বজন হারানোর কান্না।
গত মঙ্গলবার আরও পাঁচ প্রবাসী বাংলাদেশি মারা গেছেন। নিউইয়র্কে নগরে এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ১ হাজার ৯৬ জন। আর গোটা রাজ্যে মারা গেছেন ১৭১৪। আক্রান্তের সংখ্যা ৭৬ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। এখন এখানে হাসপাতালে মৃত্যুর পর বেশ কিছু আনুষ্ঠানিকতা পালন করতে হয়। করোনাভাইরাসে মারা যাওয়া লোকজনের মরদেহ দেওয়া হয় না পরিবারকে। ফোনে সমাহিত করার স্থান জানাতে হয়। তারপর বেশ কিছু আইনি আনুষ্ঠানিকতার পর মৃতদেহকে সরাসরি কবরস্থানে পাঠানো হয়। বেশ দূরত্ব রেখে একান্ত কিছু স্বজন জানাজায় অংশ নেওয়া বা শেষ বিদায় জানানোর আয়োজনে থাকতে পারছেন।
প্রথম আলো উত্তর আমেরিকার সহকর্মী শাহ সিরিল ঘুরে দেখেছেন প্রবাসী বাংলাদেশি অধ্যুষিত জ্যাকসন হাইটস। ওই এলাকা টানা ১০ দিনের লকডাউনে পর খাঁ খাঁ করছে। মোড়ের একমাত্র দোকান ‘জ্যাকসন হাইট ফার্মেসি’ খোলা পাওয়া গেল। কর্মরত স্বদেশি ওই নারী জানালেন, ফোনে সমানে ওষুধের অর্ডার আসছে। চিকিৎসকেরা প্রেসক্রিপশন পাঠাচ্ছেন অনলাইনে। দুই হাতে প্যাকেটবন্দী করার পর লোকজন এসে নিয়ে যাচ্ছেন। জরুরি স্বাস্থ্য সমস্যা না হলে বাংলাদেশি চিকিৎসকেরা চেম্বার বন্ধ রেখেছেন। টেলিফোনে ও অনলাইনে সেবা দিচ্ছেন। অধিকাংশই হাসপাতালে চিকিৎসার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন। জানা গেছে, বাংলাদেশি ডজন খানের চিকিৎসক নিজেরাই করোনাভাইরাস আক্রান্ত হয়েছেন। কেউ চিকিৎসা নিচ্ছেন ঘরে, কেউ হাসপাতালে। এর মধ্যেই সুখবর হচ্ছে, কমিউনিটির পরিচিত চিকিৎসক আতাউল ওসমানী নিজ ক্লিনিক থেকে সুস্থ হয়ে ঘরে ফিরেছেন।
ব্রডওয়েতে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান একদমই খোলা নেই। খোলা নেই ফেডেক্স বা ইউপিএস। মাস্ক পরা এক প্রবাসী কাঁদতে কাঁদতে যাচ্ছেন পূর্ব দিকে। ওই দিকে এলমাহার্স্ট হাসপাতাল। সেই হাসপাতালটি এখন যেন এক মৃত্যুপুরী। অনেক বাংলাদেশি এখানে মারা গেছেন। সামনে হাসপাতালের জরুরি সার্ভিসে কাজ করা একজন জানালেন, ভেতরের মেঝেতেও মরদেহ রাখা আছে।
ডাইভার্সিটি প্লাজায় মঙ্গলবার বিকেলে কোথাও কেউ নেই। অথচ সাধারণ সময়ে এখানে দক্ষিণ এশীয়দের ভিড়ে গমগম করে। দেখা গেল, মাস্ক পরে এক প্রবাসী মাইলখানেক হেঁটে এসেছেন ‘ইত্যাদি’তে বাজার করবেন বলে। দোকানের দরজা বন্ধ। ভেতর থেকে একজন পরিচ্ছন্নতাকর্মী জানালেন, গ্রোসারি কবে খোলা হবে, জানেন না। তিনিই একটু পরে যোগ করলেন, দেশ থেকে তাঁর মা ফোন করে বলছেন কাজ না করতে, ঘরে থাকতে।
নিউইয়র্কের একটি বড় চেইন হাসপাতালের প্রযুক্তি বিভাগের দায়িত্বে থাকা ইশতেহাক চৌধুরী জানালেন, মঙ্গলবারের ডেটা অনুযায়ী হাসপাতালে নতুন রোগী ভর্তির সংখ্যা গড়ে ২০ শতাংশ কম দেখাচ্ছে। এমন হতে পারে সামাজিক দূরত্ব পালনের ফলে ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া কিছুটা হলেও নিয়ন্ত্রিত হয়েছে। তিনি জানান, অবশ্য অন্য কারণেও হাসপাতালে ভর্তি কম হতে পারে। রোগীর শারীরিক অবস্থা নাজুক না হলে হাসপাতালে ভর্তি করা হচ্ছে না।
যদিও উৎকণ্ঠিত মেয়র ব্লাজিও মঙ্গলবার বলেছেন, ‘আসছে সপ্তাহে আমরা আক্রান্তের সংখ্যা অনেক বেশি হবে বলে আশঙ্কা করছি।’ মেয়রের আশঙ্কা, পরিস্থিতি মে মাস পর্যন্ত গড়াবে। নগরীর স্বাস্থ্য বিভাগের এক পরিসংখ্যান মতে, নিউইয়র্কে আক্রান্তদের অধিকাংশের বয়স ৪৫ বছরের ঊর্ধ্বে।
নিউইয়র্ক রাজ্যের গভর্নর অ্যান্ড্রু কুমোর ভাই করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। গভর্নর বলছেন, ‘আমাদের লড়াইয়ের লক্ষ্য দুটো। একটি হাসপাতালে, অন্যটি নগরবাসীকে ঘরে রাখার।’ নিউইয়র্কে জরুরি কাজ ছাড়া বাইরে যাওয়া, সমাবেশে যোগ দেওয়া, পার্টির আয়োজন করাকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।