পুলিশের ধাওয়া ::ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আওয়ামী লীগ নেতার মৃত্যু
এক স্বতন্ত্র প্রার্থীকে সমর্থন করেছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার তালশহর পূর্ব ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি গোলাপ খান মানিক (৬৭)। এ সমর্থনই কাল হয়েছে তার জন্য। পুলিশের তাড়া খেয়ে পালাতে গিয়ে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বৃহস্পতিবার ভোররাতে মারা যান তিনি। পরিবারের অভিযোগ গত দুই সপ্তাহ ধরে পুলিশ হয়রানি করছিলো তাকে। গতকাল দুপুরে তেলীনগর মাদরাসা মাঠে মানিকের জানাজায় এলাকার মানুষ ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ছড়িয়ে পড়ে উত্তেজনা। নাটাই দক্ষিণ ইউনিয়নেও এমন আরেকটি মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার আরো কয়েকটি ইউনিয়নে নির্বাচনী প্রচার-প্রচারণার শুরু থেকে পুলিশি হয়রানির অভিযোগ রয়েছে। ভোটের দিন সংঘাত-সহিংসতার আশঙ্কা প্রবল হয়ে উঠেছে কোনো কোনো ইউনিয়নে। শহরতলীর নাটাই উত্তর ইউনিয়নের বিরাশার গ্রামে গত কয়েকদিন ধরে বাড়িঘর থেকে মালপত্র সরিয়ে নেয়া হচ্ছে। এখানে দুই সদস্য প্রার্থীর সমর্থকদের মধ্যে সংঘাত-সহিংসতার আশঙ্কা করা হচ্ছে। জোর করে ভোট কাটা হলে নাটাই দক্ষিণ ইউনিয়নেও রক্তারক্তির আশঙ্কা রয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের ১১টি ইউনিয়নের মধ্যে কয়েকটি ইউনিয়নে দুরবস্থায় আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা। অভিযোগ সেসব ইউনিয়নে শক্ত অবস্থানে থাকা দলের বিদ্রোহী ও স্বতন্ত্র প্রার্থীদের দমাতে পুলিশি অ্যাকশন চলছে। তালশহর পূর্ব ইউনিয়নে দলের জোরের চেয়ে আঞ্চলিকতার জোরে এগিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. মনিরুল ইসলাম। ইউনিয়নের ৭ গ্রামের মধ্যে ৬ গ্রামের ভোটাররা তাকে সমর্থন দিয়েছেন। এই ৬ গ্রামের একটি তেলীনগর। সেখানেই বাড়ি ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি গোলাপ খান মানিকের। আঞ্চলিকতার টানে তিনি সমর্থন দেন মনিরুলকে। তার ছেলে সালমান হায়দারকেও তাড়া করছিলো পুলিশ। সালমান রাতে এখানে-ওখানে আত্মগোপন করে থাকেন। সালমান বলেন- তার বাবা দলের মনোনয়ন চেয়েছিলেন। কিন্তু দল মনোনয়ন দেয়নি। অথচ তৃণমূলে তিনি সর্বোচ্চ ৯ ভোট পেয়েছিলেন। এরপর ৬ গ্রামের মানুষ আমার বাবাকে নির্বাচন করতে বলেছিলেন। তিনি বলেছিলেন আমি আওয়ামী লীগের বাইরে নির্বাচন করবো না। আঞ্চলিকতার টানেই আমার বাবা মনিরুলকে সমর্থন করেন। কিন্তু তিনি অসুস্থ হওয়ায় কোথাও যেতেন না। বাড়িতেই থাকতেন। আমাকে ধরার জন্য তারা আমার বাবাকে হয়রানি করা শুরু করে। তাদের উদ্দেশ্য আমাকে পুলিশ ধরে ফেললে বাবাকে কব্জা করা যাবে। ইউনিয়নের ১২০ জনের একটি তালিকা করে পুলিশ। তাতে নাম রয়েছে সালমানের। একটি তোরণ পুড়ানোর ঘটনায়ও তাকে জড়ানো হয়। সালমানকে ধরতে মঙ্গলবার রাতে পুলিশ তল্লাশি চালায় ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সভাপতি মানিক মিয়ার বাসায়। সেসময় পরিবারের লোকজনকে হয়রানিও করা হয়। ঘরের সব খাটের নিচে সালমানকে খুঁজে তারা। পরদিন বুধবার দিবাগত রাত ২টার দিকে আবার পুলিশ গেলে মেয়ে শাম্মীকে নিয়ে ছুটে পালানোর সময় বাড়ি থেকে কয়েক শ’ গজ দূরে পড়ে যান মানিক। সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেন। এরপর তাকে একটি সিএনজি অটোরিকশা এনে জেলা শহরে নিয়ে যাওয়ার পথে পুলিশ বাধা দেয় বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তার মেয়ে শাম্মী জাহান লিটা বলেন, রাত দুটোর দিকে আব্বা আমাকে নিয়ে ঘরের দরজা খুলে বসেছিলেন। তখনই পুলিশের গাড়িটি আসে। তারা আমাকে ও আব্বাকে লক্ষ্য করে লাইট মারে। আব্বা আমাকে জড়িয়ে ধরে আমাদের পুরাতন বাড়ির দিকে ছুটতে থাকেন। অল্প কিছুদূর যাওয়ার পরই পড়ে যান। আমি আব্বাকে বলছিলাম আর দৌড়ায়েন না। কিন্তু আব্বা ভয়ে থামেননি। সালমান জানান, গত ১৫ দিন ধরে নিয়মিত পুলিশ আসতো তাদের বাড়িতে। রাতে ভয়ে তার বাবা ঘুমাতেন না। আওয়ামী লীগের নেতারাও চাপ দিতেন তার বাবাকে দলের নির্বাচন করার জন্য। সালমান বলেন, তার বাবার মৃত্যুর জন্য আওয়ামী লীগই দায়ী। এখন রাজনীতি নেই, দুর্নীতি শুরু হয়েছে। তারা আমার আব্বার ওপর নির্যাতন করেছে। সেটা তাদের উচিত হয়নি। এখন আব্বা নেই। আব্বা থাকতেই আমাকে অনেক হেনস্থা করেছে। তাই আর মুখ খুলতে চাই না।
মানিক মিয়ার মৃত্যুতে গোটা ইউনিয়নের মানুষের মধ্যে দেখা দিয়েছে ক্ষোভ। জানাজার আগে বক্তৃতা দিতে গিয়ে সেই ক্ষোভ প্রকাশ করেন ইউনিয়নের বিশিষ্ট লোকজন। মুফতি ফজলুল হক নিজামী নামের একজন তার বক্তৃতায় বলেন-তিনি অনেক চাপের মধ্যে ছিলেন। আর সেকারণে তার স্ট্রোক করেছে। তিনি যে দলের জন্য তার জীবন উৎসর্গ করলেন সেই দলের লোকজন কেন তার সঙ্গে এমন করলো তা নিয়ে আজকে পরিবার ও গোটা ইউনিয়নের মানুষের মধ্যে ক্ষোভ।মানিক মিয়ার এক আত্মীয় শাহানা বেগম বলেন- গভীর রাতে পুলিশের থ্রেটে কোনো সুস্থ মানুষই ঠিক থাকতে পারে না। সেখানে একজন অসুস্থ মানুষ ঠিক থাকেন কি করে?
মানিক মিয়া ৪০ বছর ধরে আওয়ামী লীগের রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত। ঐ ইউনিয়নে আওয়ামী লীগকে প্রতিষ্ঠা করেন তিনি। গতকাল সকালে তার বাড়িতে গিয়ে পরিবারের সদস্যদের সান্ত্বনা দেন জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি র আ ম উবায়দুল মোক্তাদির চৌধুরী এমপি। নাটাই দক্ষিণ ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদেরও নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। বিলকেন্দুয়াই এলাকার আওয়ামী লীগ সভাপতি হুমায়ুন মেম্বারের ছেলে আহসান কবিরকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ একাধিক ডাকাতির মামলা দিয়ে জেলে পাঠায়। বিলকেন্দুয়াই গ্রামের নসর ও হুমায়ুন মেম্বারের গ্রুপটি সমর্থন করছে বিদ্রোহী প্রার্থীকে। আর আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে সমর্থন করছে নাজমুল ও আনোয়ারের গ্রুপ। গ্রামে আধিপত্য বিস্তারে বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থক হিসেবে নসর ও হুমায়ুন গ্রুপকে ঘায়েল করতে তৎপর নাজমুল ও আনোয়ার গ্রুপ। গ্রামের লোকজন জানান, বুধবার রাতে পুলিশের গাড়ি যায় গ্রামে। পেছনে ছিলো আরেকটি সাদা গাড়ি। ঐ গাড়ি থেকে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এই ঘটনায় ৫২ জনের বিরুদ্ধে একটি মামলা দেন আওয়ামী লীগ প্রার্থী নূরুল আমিন। তার মামলায় অভিযোগ করা হয় এমরান মিয়ার বাড়িস্থ নৌকা প্রতীকের অফিসে ককটেল মারা হয়েছে ও নৌকার গেইট পুড়ানো হয়। কিন্তু বিলকেন্দুয়াই গ্রামের নসর ও হুমায়ুন গ্রুপের লোকজন জানান, কোনো গেইট পুড়ানো হয়নি তাদের এখানে। তারপরও মামলা দেয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মো. শাহআলম বলেন- আওয়ামী লীগ প্রার্থীর তোরণ-গেইট আমাদের কাছে আতঙ্কের। এগুলো কোনো কিছু করে আমাদের ফাঁসিয়ে দেয়ার পথ বের করা হবে এই আতঙ্কে আমাদের লোকরা সেগুলো পাহারা দিয়ে রাখে। যাতে কেউ কিছু করতে না পারে। ইউনিয়নে বিদ্রোহী প্রার্থীর কর্মী সমর্থকদের বাড়ি বাড়ি যাচ্ছে পুলিশ।
তেলীনগর গ্রামের মানুষও অভিযোগ করেন রাতে কোনো মানুষ বাড়িতে থাকতে পারে না পুলিশের ভয়ে। বুধল,
রামরাইল ইউনিয়নেও আছে পুলিশের হয়রানি। দেয়া হয়েছে মামলা।
নাটাই দক্ষিণ ইউনিয়নের ২ নং ওয়ার্ডের সদস্য প্রার্থী আবুল কাশেম অভিযোগ করেন তার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী প্রকাশ্যে ভোট দেয়ার জন্য হুমকি দিচ্ছে।সূত্র:: মানব জমিন