“জুলাই বিপ্লবে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অবদান স্মরনীয়”-অ্যাড. মীর হালিম
পৃথিবীর ইতিহাসে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া ২০২৪ এর “জুলাই বিপ্লব” একটি গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়, বঞ্চিত মানুষের জন্য প্রেরণা। ছাত্র-জনতার জাগরণ, তারুণ্যের জীবন দান, অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে মহাকাব্যের চিত্রায়ন।
বাংলাদেশ রাষ্ট্র পরিচালনায় রন্দ্রে রন্ধ্রে বৈষম্য, অন্যায়, অত্যাচার ও অবিচারের বিরুদ্ধে নির্যাতিত ও নিপীড়িত কণ্ঠস্বরের মোহনার নাম ঐতিহাসিক ৩৬ জুলাই বিপ্লব। উসিলা হিসেবে বৈষম্যবিরোধী কোটা সংস্কার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে যে ছাত্র জাগরণের সূচনা হয়েছিল, তার ফলাফল পরিণত হয় স্বৈরাচার পলায়নের গণঅভ্যুত্থানে। এ বিপ্লব সাফল্যের পেছনে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্ব, মাহফুজ, আসিফ, সারজিস ও হাসনাত দের সমন্বয়, সাধারণ ছাত্র সমাজ, সকল শ্রেণীর পেশাজীবী, সকল ধর্মের মানুষ, দিনমজুর থেকে রিকশাচালক, দোকানী থেকে ব্যবসায়ীদের সাহসি ভূমিকা রয়েছে।
শহীদের রক্তে ভেজানো রাজপথ, স্বৈরাচারের অস্ত্রের ঝনঝনানী, সাহসী স্লোগানে মুখরিত ছাত্র-জনতা এবং এক নতুন সূর্যের প্রত্যাশা, এই বিপ্লবের প্রতিটি অধ্যায় আমাদের জাতীয় চেতনার অংশ। আরব বসন্ত, শ্রীলংকা ও আফগানিস্তানের জনতার বিজয়ের পর এই বাংলা বসন্ত দীর্ঘদিনের প্রত্যাশিত স্বপ্ন। সেদিন ৫ আগস্টে দেশের স্বার্থে সেনাবাহিনীর ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত, গণভবন অভিমুখে গণমিছিল, শেখ হাসিনার পদত্যাগ ও ভারত পলায়নের কারণে বাংলাদেশ নতুন যুগে প্রবেশ করে। শিক্ষার্থীদের অনুরোধে নোবেল শান্তি বিজয়ী প্রফেসর ড. মোঃ ইউনুস অন্তবর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব আসেন এবং নানা রকম সংস্কার কার্যক্রমের মাধ্যমে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্নে বিভোর হন।
“তুমি কে, আমি কে? রাজাকার, রাজাকার” কে বলেছে? কে বলেছে? স্বৈরাচার স্বৈরাচার! শ্লোগান যেমন উত্তাল করেছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজপথ, তেমনি রংপুরে আবু সাঈদের শাহাদাত তথা সহস্রাধিক শহীদদের আত্মত্যাগ প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে প্রেরণা দিয়ে যাবে। স্বৈরাচারী কারফিউর নিস্তব্ধ দিনগুলো, ইন্টারনেট বন্ধ করে আন্দোলন দমনের অপচেষ্টা এবং সাজোয়া যান থেকে ফেলে দেওয়া তরুণের মৃত্যু কিংবা ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সামনে কারবালার হাহাকারে পানি বিলিয়ে দেওয়া মীর মুগ্ধের মৃত্যুগুলি নির্মম অধ্যায়ের সাক্ষী।
সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে জুলাই গণঅভ্যুত্থানে স্বৈরাচারের গুলিতে নিহত শহীদদের তালিকা সম্বলিত সরকারি গেজেট প্রকাশিত হয়েছে। প্রাথমিক তালিকায় জুলাই গণ অভ্যুত্থানে শহীদের সংখ্যা ৮৩৪ জনের নাম ঠিকানা আছে। আহতদের তালিকা প্রকাশিত হয়নি, জুলাই গণ অভ্যুত্থানে কয়েক হাজার আহত হয়েছে। ‘জুলাই গণ অভ্যুত্থান অধিদপ্তর’ গঠন প্রক্রিয়া চলছে যারা শহীদ পরিবারকে সহায়তা ও ক্ষতিপূরণ, আহতদের চিকিৎসা ও পুনর্বাসনসহ গণ অভ্যুত্থানের স্মৃতি রক্ষার্থে প্রয়োজনীয় ভূমিকা পালন করবে।
৫ ই আগস্ট ২০২৪ ইং গণঅভ্যুত্থানের পর ১৫ আগস্টে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এই বিষয়ে একটি কমিটি গঠন করে। গত ২১ ডিসেম্বর ২৪ইং অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গণ অভ্যুত্থান-সংক্রান্ত বিশেষ সেল জুলাই গণ অভ্যুত্থানে ‘শহীদ’ ও আহত ব্যক্তিদের প্রথম ধাপের খসড়া তালিকা প্রকাশ করেছিল। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার জুলাই-আগস্টে নিহত ও আহতদের তালিকা তৈরি করতে যাচাই-বাছাই শেষে শহীদদের নাম প্রকাশ করে এই প্রথমবারের মত গেজেট প্রকাশ করল।
‘পানি লাগবে পানি?’ মনে পড়ে মীর মুগ্ধের সেই কালজয়ী পানি বিতরণের গল্প? সেই মায়া জড়ানো সোনালী চেহারার যুবকটির জন্মভূমি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়! সে ১৮ জুলাই কোটা আন্দোলন চলাকালীন পুলিশের গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করে। গেজেটে ৮৯ নম্বর তালিকায় তার বিবরণ আছে। জুলাই বিপ্লবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার অধিবাসীদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ঢাকা ছাড়াও স্থানীয়ভাবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা শহর সহ বিভিন্ন উপজেলা শহরে তারা প্রতিবাদ মিছিল ও বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে। প্রাথমিক তালিকায় ছাত্র জনতার জুলাই জাগরণে আমাদের ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ১৭ জন শহীদের নাম আছে। এদের মধ্যে বাঞ্ছারামপুরের ৪, নবীনগরের ৪, সরাইলের ৪, ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরে ১, কসবা ১, বিজয়নগরে ১ ও নাসিরনগর ১ জনের নাম উল্লেখ আছে। তারা সবাই ঢাকায় গণ আন্দোলনের সময় ১৫ জুলাই ২০২৪ থেকে ৫ই আগস্ট ২০২৪ এর মধ্যবর্তী সময়ে স্বৈরাচারী পুলিশের গুলিতে নিহত হন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ১৫ জানুয়ারি ২০২৫ ইং তারিখে শহীদ হিসেবে মর্যাদা দিয়ে গেজেট প্রকাশ করেন।
বাঞ্ছারামপুর এর ৪ জন যথাক্রমে গেজেট সিরিয়াল নং- ১৩০: শহীদ মোঃ তুহিন আহমেদ পিতা: ছগির মিয়া, মাতা: তাহমিনা বেগন, স্ত্রী: ঝুনু আক্তার, গ্রামঃ সোনারামপুর (মধ্যপাড়া), ইউনিয়ন: সোনারামপুর, উপজেলা: বাঞ্ছারামপুর জেলা: ব্রাহ্মণবাড়িয়া। গেজেট সিরিয়াল নং- ৪১৯: শহীদ মোঃ ইসমাইল সরকার পিতা: মোঃ ইব্রাহিম মিয়া , মাতা: সুফিয়া খাতুন গ্রাম: নতুন হাটি (বাঞ্ছারামপুর পৌরসভা) উপজেলা: বাঞ্ছারামপুর জেলা: ব্রাহ্মণবাড়িয়া। গেজেট সিরিয়াল নং- ৪২৬. শহীদ মোঃ ইমরান পিতা: মোঃ আলম, মাতা: জাহানারা বেগম গ্রাম: চরলহনীয়া (দক্ষিণপাড়া) ইউনিয়ন: ফরদাবাদ উপজেলা: বাঞ্ছারামপুর জেলা: ব্রাহ্মণবাড়িয়া। গেজেট সিরিয়াল নং- ৮২২: শহীদ আশিকুর রহমান পিতা: মোঃ কামাল মিয়া, মাতা: কুসুম বেগম ষষ্টগ্রাম: গকুলনগর, ইউনিয়ন: দরিকান্দি, উপজেলা:বাঞ্ছারামপুর ,জেলা: ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
নবীনগর উপজেলার ৪ জন, গেজেট সিরিয়াল নং-২৪৪. শহীদ জাহিদুজ্জামান তানভীন, পিতা: মোঃ সামসুজ্জামান, সাং-ভিটিবিশাড়া, রতনপুর, নবীনগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া। গেজেট সিরিয়াল নং-৪১৫ শহীদ তানজিল মাহমুদ সুজয়, পিতা: মো: শফিকুল ইসলাম, ৬নং ওয়ার্ড, বিটঘর, নবীনগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া। গেজেট সিরিয়াল নং-৪৪৭ শহীদ রফিকুল ইসলাম, পিতা: মৃত মোহাম্মদ মমিন সাং-দয়ালনগর, নতুন থোল্লাকান্দি গ্রাম, বড়িকান্দি ইউনিয়ন, উপজেলা: নবীনগর, জেলা: ব্রাহ্মণবাড়িয়া। গেজেট সিরিয়াল নং-৬৯৬ শহীদ মোঃ জাহিদ হোসেন, পিতা: মোঃ জাহাংগীর আলম গ্রাম-ইসলামপুর, ডাকঘর-শিবপুর, নবীনগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
সরাইল উপজেলার ৪ জন, গেজেট সিরিয়াল নং-২০৮. শহীদ মোঃ মোবারক হোসাইন, পিতা: রমজান আলী গ্রাম-মোলাইশ, পশ্চিমপাড়া, উপজেলা-সরাইল, জেলা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া। গেজেট সিরিয়াল নং-২১৪. শহীদ মাহমুদুল হাসান, পিতা: আব্দুস সাত্তার সাং-মাস্টার বাড়ি, পাকশিমুল, ফতেহপুর, অরুয়াইল, থানা-সরাইল জেলা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া। গেজেট সিরিয়াল নং-২৮৫. শহীদ রায়হান উদ্দিন পিতা: ফারুক উদ্দিন গ্রাম: গাঙ্গোল হাটি, তালিকান্দি, উপজেলা-সরাইল, জেলা-ব্রাহ্মণবাড়িযা। গেজেট সিরিয়াল নং-৪১১. শহীদ জসিম, পিতা: জরুন মিয়া সাং-বারপাইকা,ইউপি-অরুয়াইল,থানা-সরাইল,জেলা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদরের ১ জন, গেজেট সিরিয়াল নং- ৪৩০ শহীদ মো: হোসাইন পিতা: মো: মানিক মিয়া সাং-বরিশল পশ্চিমপাড়া,বাসুদেব ইউনিয়ন, থানা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর, জেলা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
আখাউড়া উপজেলার ১ জন, গেজেট সিরিয়াল নং- ৪০৬, শহীদ জাবির ইব্রাহীম, পিতা: কবির হোসেন ঠিকানা: তুলাই শিমুল, মনিয়ন্দ, উপজেলা: আখাউড়া, জেলা: ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
কসবা উপজেলার ১ জন, গেজেট সিরিয়াল নং- ৪৩৯, শহীদ জোবায়ের ওমর খাঁন, পিতা: এড: জাহাঙ্গীর আহমেদ খাঁন সাং-সৈয়দাবাদ,(দক্ষিণপাড়া), ২নং ওয়ার্ড, কসবা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
বিজয়নগর উপজেলার ১ জন, গেজেট সিরিয়াল নং- ৭২৭, শহীদ মোহাম্মদ সাজিদুর রহমান ওমর, পিতা: মোঃ শাহজাহান সাং-পাট্টান, বিজয়নগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
নাসিরনগর উপজেলার ১ জন, গেজেট সিরিয়াল নং- ১৭৩, শহীদ ইমরান, পিতা: শোয়েব মিয়া সাং-গোয়ালনগর, নাসিরনগর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।
আহতদের তালিকার গেজেট প্রকাশিত হয়নি। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ডিসি বরাবরে বাঞ্ছারামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কর্তৃক প্রেরিত তালিকায় ২ জন আহতদের কথা উল্লেখ আছে। ১ নং নাম: আজিজুল হক, পিতার নাম: কামাল মিয়া, ঠিকানা:বাহেরচর পূর্বপাড়া,ইউনিয়ন তেজকালী,বাঞ্চারামপুর,ব্রাহ্মণবাড়িয়া। সে আলিমে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থী ছিল, আহত হয়ে দুটি চোখ অন্ধ হওয়ার পথে। ২ নং নাম: মোঃ রহমতুল্লাহ, পিতা-মৃত মাও: আবুল কাসেম মাতা-ফাতেমা বেগম। গ্রাম-কালিকাপুর ডাকঘর: উজানচর উপজেলা – বাঞ্চারামপুর জেলা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া। পায়ে ছররা গুলি লেগেছিল।
এই রকম অন্যান্য উপজেলা থেকেও পাঠানো হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার তালিকাভুক্ত আহতের সংখ্যা প্রায় ৪০/৫০ জনের মত হতে পারে। তালিকার বাইরে সাধারণ আহতদের সংখ্যা আনুমানিক হাজারেরও বেশি।
এই লেখা শুধু বিপ্লবের স্মৃতিচারণ নয়, এ জাতির ভবিষ্যৎ নির্মাণে প্রেরণা। “জুলাই বিপ্লব” আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন কীভাবে একটি জাতিকে পুনর্নির্মাণের পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। এই বিপ্লব স্মৃতি একটি মহাকাব্য, একটি আত্মপরিচয়ের আয়না, যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে গণতন্ত্র, স্বাধীনতা ও মানবিক মর্যাদা রক্ষার লড়াইয়ে শক্তি জোগাবে, প্রেরণা দিবে। রাষ্ট্র পরিচালনায় সকল বৈষম্যের বিরুদ্ধে আগামীর তরুণেরা সকল ফাগুনে দ্বিগুণ, বহুগুণ হবে! জুলাই ছাত্র-জনতার বিল্পবের কাংখিত স্বপ্ন পূরণে ঐক্যের বিকল্প নাই। জুলাই বিপ্লবের ঘোষণাপত্র বাস্তবায়নে কচ্ছপ গতি পরিহারে আমাদের সক্রিয় ভূমিকা প্রত্যাশিত।
সর্বশেষ, আমার মাতৃভূমি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় জন্মানো জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের সরকারি তালিকায় অন্তর্ভুক্তকরণ, সরকারি মর্যাদাদান, স্বৈরাচার ও দোসরদের বিচার, কবর ও স্মৃতি সংরক্ষণ, তাদের নামে রাস্তাঘাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও গুরুত্বপূর্ণ ভবনের নামকরণ, ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে সার্বিক সহায়তা প্রদান বা পুনর্বাসন নিশ্চিত করা আমাদের সকলের নৈতিক দায়িত্ব। আমরা যে যার অবস্থান থেকে এই কর্তব্য পালনে সচেতন থাকলে শহীদেরা রক্তের মর্যাদা পাবে আর আহতরা পাবে শান্তি। শহীদের রক্তের বদলে পাওয়া নতুন বাংলাদেশে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা হোক এই প্রত্যাশা করে বাউনবাইরার বীর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি জ্ঞাপন করি।