Main Menu

লিপিকা গোমেজ : হত্যা না আত্মহত্যা ?

+100%-

শামীম উন বাছির : লিপিকা গোমেজ-জীবন দিয়ে অত্যাচার থেকে  মুক্ত হলেও ঋণ  মুক্ত হয়েছেন কিনা, তা জানা যায়নি। মাত্র ৮০ হাজার টাকার জন্য হাসপাতাল ভবনের একটি কক্ষে দুই মাস ধরে বন্দি জীবনযাপন করছিলেন লিপিকা গোমেজ। বড় দিনের উৎসবেও যেতে পারেননি পরিবারের কাছে। মৃত্যুর কয়েক ঘণ্টা আগে মেয়েদের ফোনে বলেছিলেন টাকা দিয়ে তাকে এখান থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে যেতে। সে সুযোগ আর মিলেনি তার সন্তানদের। তার আগেই রহস্যজনক মৃত্যুর শিকার হন ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের খ্রীস্টিয়ান মেমোরিয়াল হাসপাতালের এ নারী কর্মকর্তা। তার মৃত্যুর পর হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলতে থাকে- পারিবারিক কলহের কারণে ৭তলা ওই হাসপাতাল ভবনের ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে সে আত্মহত্যা করেছে। তার কাছে অনেকে টাকা পেতো, ঋণের দায় মেটাতে তিনি জীবন দিয়েছে’- এমন কথাও বলতে থাকে হাসপাতালের মালিকপক্ষ। তবে লিপিকা আদৌ সাত তলার ছাদ থেকে লাফিয়ে আত্মহত্যা করেছে কি না কিংবা হত্যার পর ওপর থেকে তাকে ফেলে দেওয়া হয়েছে কি না- এ নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে।
৩ বছর আগে বণিক পাড়ার ৭তলা এ ভবনটির কয়েকটি ফ্লোর ভাড়া নিয়ে হাসপাতালটি চালু করেন ডা. ডিউক চৌধুরী ও তার স্ত্রী ডা. এঞ্জেলা চৌধুরী। শুরু থেকেই হাসপাতালের হিসাব বিভাগের সহকারী কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেন লিপিকা গোমেজ। এখানে তিনি একাই থাকতেন। হাসপাতালের মালিক ডিউক চৌধুরী থেকে পাওয়া লিপির একটি বৃত্তান্তে দেখা গেছে সেখানে তার নাম লিপিকা লরেন্স। স্বামীর নাম নরবাট লরেন্স। ঠিকানা ৪২০, কাওলার মধ্যপাড়া, ঢাকা রয়েছে। লিপিকা ১৯৮৪ সালে বগুড়ার জয়পুরহাট খঞ্জনপুর মিশন গার্লস হাইস্কুল থেকে এসএসসি পাশ করেন। ডিউক চৌধুরী জানান, অসহায় বলে একজন ফাদারের সুপারিশেই লিপিকাকে চাকরি দিয়েছিলেন তিনি। পুলিশ লিপিকার কক্ষ থেকে তার একটি পার্স (ছোট ব্যাগ), মোবাইল ফোন ও কিছু কাগজপত্র উদ্ধার করে।
লিপিকা গোমেজের  মৃত্যুর কারণ কিছুটা খোলাসা হয় তার স্বামী-সন্তানরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আসার পর। লিপিকার বড় মেয়ে জিনেট রিতা লরেন্স জানান, গত মঙ্গলবার দিনগত রাত অনুমান একটার দিকে মুঠোফোনে মায়ের সঙ্গে তার সর্বশেষ কথা হয়। লিপিকা তখন তাকে জানায়, টাকার জন্য হাসপাতাল থেকে ছুটি নিতে পারছেন না তিনি। মেয়েকে ৪০ হাজার টাকা ব্যবস্থা করে নিয়ে আসতে বলেন। তাকে ছুটি দিতে হাসপাতাল মালিক ডা. ডিউক চৌধুরীর কাছে অনুরোধ করতেও বলেন। জিনেটকে ছুটি নেয়ার কারণ হিসেবে তার এক বোন অসুস্থ হাসপাতাল মালিকের কাছে সেটি বলতে শিখিয়ে দেন মা লিপিকা। তারা আরও জানান, হাসপাতাল মালিকের টাকার চাপে লিপিকা ছিলেন দিশাহারা। টাকা পরিশোধ না করার কারণে হাসপাতাল ভবনেই ছিলেন তিনি বন্দি।  লিপিকার মেয়েদের বক্তব্যের পর সুর পাল্টে যায় ডা. ডিউকের। তখন তিনি নতুন গল্প ফাঁদেন।  বুধবার সকালের এ ঘটনার পর ঋণের চাপে লিপি আত্মহত্যা করেছেন তা প্রতিষ্ঠিত করতে একজন পাওনারদেরকেও সাংবাদিকদের সামনে হাজির করা হয়।সাংবাদিকদের বলেন, স্থানীয় দোকানদার, নৈশপ্রহরীসহ অন্য অনেকের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়েছে লিপিকা। ওই পাওনাদাররা টাকার জন্য তাকে প্রায়ই চাপ দিতো।এমন এক পাওনাদারকে নিয়ে আসা হয় সাংবাদিক ও তদন্তকারী পুলিশ কর্মকর্তার সামনে। তিনি হাসপাতালের নৈশপ্রহরী সদর উপজেলার চিলোকুট গ্রামের আবুল হোসেন। একটি ৫০ টাকার খালি স্ট্যাম্প নিয়ে হাজির হন আবুল। এ স্ট্যাম্পে স্বাক্ষর দিয়ে লিপিকা তার কাছ থেকে ৪০ হাজার টাকা ধার নিয়েছে বলে পুলিশ কর্মকর্তার কাছে দাবি করেন তিনি। এ সময় স্ট্যাম্পে থাকা স্বাক্ষর দেখে জিনেট রিতা লরেন্স এটি তার মায়ের স্বাক্ষর নয় বলে চ্যালেঞ্জ করেন।  জিনেট রিতা লরেন্স আরও জানান, তার মাকে গত ২৫শে ডিসেম্বর বড় দিনেও তাকে ছুটি দেয়া হয়নি। হাসপাতালের কয়েকজন কর্মচারী জানান, সম্প্রতি ওই হাসপাতালের কোষাগারে টাকা হেরফেরের ঘটনা ঘটে। কিন্তু এর জন্য লিপিকাকে দায়ী করে কর্তৃপক্ষ। হাসপাতালের মালিক ডা. ডিউক চৌধুরী তাকে ওই টাকা পরিশোধের জন্য চাপ দেন। মঙ্গলবার দিনগত রাতে ওই টাকার জন্য তাকে একটি কক্ষে রাতভর আটকে রাখা হয় বলেও শুনেছেন তারা। পরদিন সকালে আসে তার মৃত্যুর খবর।স্ট্যাম্পটিতে আড়াআড়ি স্বাক্ষর ছাড়া আর কোন লেখা ছিল না। ডা. ডিউক হাসপাতালের সঙ্গে লিপিকার দেনা-পাওনার কথা এড়িয়ে যান ।

তবে লিপি কি আত্মহত্যা করেছেন নাকি তাকে হত্যা করে ছাদ থেকে ফেলে দেয়া হয়েছে- এ প্রশ্নের উত্তর মিলেনি এখনও।   ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. আবদুর রব বলেছেন, ময়না তদন্তের রিপোর্ট পেলে এ রহস্যের কিনারা হবে।  পুলিশের সুরতহাল প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, নিহতের মাথা ও কপালে থেতলে যাওয়া জখম রয়েছে। তাছাড়া তার পা ভাঙার আলামত পাওয়া গেছে। বুধবার সকাল সাড়ে ৯টার দিকে ওই হাসপাতাল ভবনের পেছন দিকের একটি টিনশেড বাড়ির পেছনে পাওয়া গেছে তার মৃতদেহ। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ ঘটনার বিষয়ে পুলিশ ও সাংবাদিকদের জানায়, লিপিকা ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়েছে বলে তারা খবর পেয়ে তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নিয়ে যান। ঘটনার পর ওই হাসপাতাল ভবনে গিয়ে অনেকের সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, ঘটনাটি তারা শুনেছেন পরে। কেউ কেউ বলেন এ ব্যাপারে তারা কিছুই জানেন না। লিপিকা যে কক্ষটিতে থাকতেন সেখানে তার সঙ্গে থাকতেন হাসপাতালেরই আরেক স্টাফ স্নেহলতা । তিনি ঘটনার দিন ছিলেন ছুটিতে। পাশের ফ্ল্যাটের বাসিন্দা নাসরিন চৌধুরী জানান,মঙ্গলবার সন্ধ্যায় লিপিকার সঙ্গে তার দেখা হয়েছিল হাসপাতালের নিচে, তখন লিপিকার মন খারাপ দেখেন তিনি।
ঘটনার পরপর হাসপাতালের মালিক ডা. ডিউক চৌধুরী ও তার স্ত্রী ডা. এঞ্জেলা চৌধুরী পালিয়ে যান। ঘণ্টা দুয়েক পরে আবার ফিরে আসেন। ওই সময়ে সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবদুর রবের নেতৃত্বে সদর থানার কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা আসেন ঘটনাস্থল তদন্ত করতে। সে সময় ডা. ডিউক নিচতলায় নিজের চেম্বারে বসে নির্বিকারভাবে রোগী দেখতে থাকেন। হাসপাতালের স্টাফদের একজন তাকে পুলিশ আসার খবর দিলে সাংবাদিকদের সামনেই ডিউক বলেন পুলিশ সুপারের সঙ্গে কথা হয়েছে, জাহিদ (অতিরিক্ত পুলিশ সুপার) সাহেবকেও বলে রেখেছি। পদস্থ পুলিশ কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করার এ বক্তব্য ছড়ানোর পাশাপাশি দিনভর ঘটনা চাপা দিতে নানা তৎপরতা চালান হাসপাতালের এ মালিক।

উল্লেখ্য, ডা. ডিউক পূর্বে খ্রীস্টিয়ান মেমোরিয়াল সেন্টারে কর্মরত ছিলেন। অনিয়ম, দুর্নীতি এবং বিভিন্ন অভিযোগের কারনে তাকে ওখান থেকে চলে আসতে হয়। তার মালিকানাধীন ক্লিনিকে যারা চিকিৎসা নিয়েছেন, তারা সবাই তাকে ‘কসাই’ বলে অভিহিত করে। সিজারিয়ান অপারেশনে এখানে গুনতে হয় নূন্যতম ২৫০০০/= টকা। কেউ প্রতিবাদ করলে পালিত মাস্তান বাহিনী দিয়ে তাকে শাসানো হত। তাছাড়া ডিউকের রহেছে এক বিশাল দালাল বাহিনী। এ দালাল বাহিনীতে রিক্সাওয়ালা থেকে শুরু করে বিভিন্ন গ্রামীন হাতুড়ে ডাক্তাররাও রয়েছে। এসব কাজ করে উনি কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। কিছুদিন পূর্বে উনি ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের বাগানবাড়ি এলাকায় কোটি টাকা দিয়ে জায়গা ক্রয় করেছেন। ক্লিনিকের ভিতর চলছে অনুমোদনহীন  ফার্মেসী। যেখান থেকে রোগীদের উচ্চ মূল্যে ঔষধ ক্রয় করতে হয়। সাংবাদিকদের কাছে ডা: ডিউক নিজেকে একুশে টিভি দর্শক ফোরামের সভাপতি বলে পরিচয় দিতেন। এই হাসপাতালে অপারেশনের জন্য সরকারি অনুমোদন নেই। পরীক্ষা-নিরীক্ষার সময় নেয়া হচ্ছে সরকারি মূল্যের কয়েকগুণ বেশি টাকা। এমনকি পরীক্ষা-নিরীক্ষা যারা করায়, তাদের সরকারি সনদপত্র না থাকার অভিযোগ রয়েছে।
তদন্তকারী কর্মকর্তা সদর থানার উপ পরিদর্শক (এসআই) রফিকুল ইসলাম  জানান, এ ঘটনায় বুধবার রাতে একটি অপমৃত্যুর (ইউডি) মামলা দায়ের হয়েছে।  মৃত্যুর রহস্য উদঘাটনের জন্য তদন্ত চলছে।






Shares