কেমন ছিলেন সাহাবীরা? আজকের পর্বে হযরত আবু বকর রাঃ
মদীনার মসজিদ। ফজরের সালাত শেষ হয়েছে। সাহাবীগণকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘তোমাদের মধ্যে আজ কে রোযা রেখেছে? কে ক্ষুধার্তকে খাবার খাইয়েছে? কে রোগী দেখতে গিয়েছে?’’ দেখা গেল, সবই আবু বকর করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: ‘‘একজন মানুষের মাঝে এত ভাল গুণ একত্রিত হতে পারে না সে জান্নাতী হওয়া ছাড়া।”
যখন মুসলিমগণ আটত্রিশ জনের একটি ছোট দল, আবু বকর চাইলেন প্রকাশ্যে ইসলাম প্রচার করতে। অনেক অনুরোধের পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রাজী হলেন। সকলে মিলে কা‘বায় প্রবেশ করলেন ও বিভিন্ন কোণে অবস্থান নিলেন। প্রথমেই আবু বকর উঠে দাঁড়ালেন, উপস্থিত লোকদের ইসলামের প্রতি ডাকলেন। তিনিই প্রকাশ্যে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি আহ্বানকারীদের প্রথম।
মুশরিকরা রেগে গিয়ে আবু বকর ও অন্যান্য মুসলিমদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, এলোপাথাড়ি মারতে লাগল, পাথর ছুঁড়তে লাগল। আবু বকরকে মেরে শুইয়ে ফেলল। অচেতন অবস্থায় পরিবারের লোকজন তাঁকে বাড়িতে নিয়ে গেল।
রাত্রে জ্ঞান ফিরে এলে প্রথমেই তিনি জানতে চাইলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেমন আছেন? তাঁর মা খাবার নিয়ে এলেও তিনি খেলেন না। নিজ চোখে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অবস্থা না দেখা পর্যন্ত তিনি খাবেন না বলে স্থির করলেন।
তখন তাঁকে দারুল আরকামে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে নিয়ে যাওয়া হল। তাঁর অবস্থা দেখে তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেঁদে ফেললেন।
আরো একবার, কা‘বার হারাম শরীফে সালাত আদায়ের সময় কুরাইশদের নেতৃস্থানীয় এক ব্যক্তি উকবা ইবন আবু মু‘ঈত্ব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের গলায় চাদর পেঁচিয়ে সজোরে টান দিল। শ্বাসরুদ্ধ হয়ে তিনি মাটিতে পড়ে গেলেন। আবু বকর দৌড়ে এসে তাঁর গলা থেকে চাদর খুলে দিলেন আর বললেন: ‘‘তুমি কি এমন একজন লোককে মেরে ফেলতে চাও, যিনি শুধু বলেন একমাত্র আল্লাহ ছাড়া সত্যিকার কোনো ইলাহ নেই?’’
ইনিই হচ্ছেন প্রথম প্রাপ্ত বয়স্ক মুসলিম, আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, নবুওয়াত লাভের পর প্রথম যাঁকে তিনি ইসলামের দিকে ডাকেন। ইসলামের দাওয়াত পাবার সাথে সাথে তিনি তা গ্রহণ করেন এবং মৃত্যু পর্যন্ত তাতে অবিচল ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: আমি যাকেই ইসলামের দাওয়াত দিয়েছি একমাত্র আবু বকর ছাড়া প্রত্যেকের মধ্যে কিছু না কিছু দ্বিধার ভাব লক্ষ্য করেছি।
পুরুষদের মধ্যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সবচেয়ে বেশি ভালবাসার পাত্র ছিলেন তিনি।
আবূ বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুর পরিচয়
তাঁর নাম আব্দুল্লাহ। কারও মতে আতিক, যাকে (জাহান্নাম থেকে) মুক্ত করা হয়েছে। তাঁর বংশধারা ছয় পুরুষ উপরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বংশধারার সাথে মিলিত হয়েছে। তিনি ব্যবসা করতেন, প্রচুর সম্পদের মালিক ছিলেন তিনি।
জাহিলিয়ার সময়ে তিনি কুরাইশদের একজন নেতা ছিলেন। পরামর্শ-দাতা, জনপ্রিয় এবং বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ- বিশেষ করে নসব বা বংশসংক্রান্ত জ্ঞানে তিনি পারদর্শী ছিলেন। তাঁর সম্পর্কে কুরাইশদের একজন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি ইবন আদ-দাগেনার মন্তব্য ছিল: আপনি আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করেন, সৎ, অভাবীদের সহায়তাকারী, অতিথি পরায়ণ, বিপদে সাহায্যকারী। সে এই মন্তব্য করেছিল যখন কুরাইশদের অত্যাচারে আবু বকর মক্কা ছেড়ে চলে যাচ্ছিলেন। ইবন আদ-দাগেনা তাঁকে যেতে দেয় নি, নিরাপত্তা দিয়ে ফিরিয়ে এনেছিল এই শর্তে যে তিনি প্রকাশ্যে সালাত আদায় করবেন না ও কুরআন তিলাওয়াত করবেন না। তাঁর মন ছিল অত্যন্ত নরম। সালাত ও কুর‘আন তিলাওয়াতের সময় তিনি কাঁদতেন, মুশরিকদের মহিলা ও শিশুরা তাতে আকৃষ্ট হতো। কিছুদিন শর্ত মনে চললেও পরে আবু বকর তার নিরাপত্তা প্রত্যাখ্যান করেন।
আবু বকর ছিলেন হালকা পাতলা গড়লের। তাঁর তিন কন্যা ও দুই পুত্র ছিল। ছোট মেয়ে আয়েশাকে তিনি বাল্যকালেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে বিয়ে দিয়েছিলেন। আর অন্য দুই কন্যা আসমা ও উম্ম কুলসুমের বিয়ে হয় জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দুই সাহাবী যুবায়ের ও তালহার সাথে-যাঁরা একসাথে থাকতেন ও একসাথে মারা যান।
আবু বকর কখনোই মূর্তিপূজা করেন নি, মদপান করেন নি। তিনি মনে করতেন এটা সম্ভ্রম ও বিবেচনাবিরোধী। সত্যের প্রতি তাঁর অন্তর আগে থেকেই উন্মুখ ছিল। ইসলাম আসার পর তিনি সবকিছুর উপর তা পছন্দ করলেন এবং সম্পূর্ণ ও পরিপূর্ণভাবে তাতে প্রবেশ করলেন।
তিনি ছিলেন সম্মানিত কুরাইশ ব্যক্তিবর্গের অন্যতম। জ্ঞান, মেধা, অভিজ্ঞতা, বুদ্ধি, বিচক্ষণতা ও সচ্চরিত্রতার জন্য আপামর মক্কাবাসীর শ্রদ্ধার পাত্র ছিলেন। জাহিলী যুগে মক্কাবাসীদের দিয়াত বা রক্তের ক্ষতিপূরণের সমুদয় অর্থ তাঁর কাছে জমা হতো। আরববাসীর নসব বা বংশ সংক্রান্ত জ্ঞানে তিনি ছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ বিশেষজ্ঞ। কাব্য প্রতিভাও ছিল। অত্যন্ত বিশুদ্ধ ও প্রাঞ্জল-ভাষী ছিলেন। বক্তৃতা ও বাগ্মিতার খোদাপ্রদত্ত যোগ্যতার অধিকারী ছিলেন।
তিনি ছিলেন তাঁর গোত্রের অত্যন্ত জনপ্রিয়, বন্ধুবৎসল ও অমায়িক ব্যক্তি। তিনি ছিলেন ব্যবসায়ী, দানশীল ও চরিত্রবান। জাহিলী যুগেও কখনো শরাব পান করেননি। তাঁর অমায়িক মেলামেশা, পাণ্ডিত্য ও ব্যাবসায়িক দক্ষতার কারণে অনেকেই তাঁর সাথে বন্ধুত্ব ও সখ্যতা স্থাপন করতো। তাঁর বাড়ীতে প্রতিদিন মক্কার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়মিত বৈঠক বসতো।
হযরত আবু বকরের পিতা আবু কুহাফা কুরাইশদের মধ্যে যথেষ্ট মর্যাদাবান ব্যক্তি ছিলেন। তিনি ছিলেন বয়োঃবৃদ্ধ ও সচ্ছল। তাঁর গৃহ কেবল ব্যবসা বাণিজ্যের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল না, সামাজিক কর্মকাণ্ডেও তাঁর মতামত অত্যন্ত শ্রদ্ধার সাথে গ্রহণ করা হতো। মক্কা বিজয় পর্যন্ত ইসলামের প্রতি তিনি আকৃষ্ট না হলেও পুত্র আবু বকরকে ইসলাম থেকে ফিরিয়ে রাখার চেষ্টা করেছেন- এমন কোন প্রমাণ ইতিহাসে পাওয়া যায় না। অবশ্য হযরত আলীকে রা. তিনি দেখলে মাঝে মধ্যে বলতেনঃ ‘এই ছোকরারাই আমার ছেলেটিকে বিগড়ে দিয়েছে।’ মক্কা বিজয়ের দিন রাসূলুল্লাহর সা. খিদমতে হাজির হয়ে ইসলামের ঘোষণা দেন। হিজরী ১৪ সনে প্রায় এক শ’ বছর বয়সে ইনতিকাল করেন। শেষ বয়সে দৃষ্টিশক্তি হারিয়ে ফেলেছিলেন।
হযরত আবু বকরের মা উম্মুল খায়ের স্বামীর বহু পূর্বে মক্কায় ইসলামের প্রথম পর্যায়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। মক্কার ‘দারুল আরকামে’ ইসলাম গ্রহণকারীদের মধ্যে তিনি অন্যতম। স্বামীর মত তিনিও দীর্ঘজীবন লাভ করেন। প্রায় ৯০ বছর বয়সে ছেলেকে খিলাফতের পদে অধিষ্ঠিত রেখে ইহলোক ত্যাগ করেন।
আবু বকর ছিলেন পিতার একমাত্র পুত্র সন্তান। অত্যন্ত আদর যত্ন ও বিলাসিতার মধ্যে পালিত হন। শৈশব থেকে যৌবনের সূচনা পর্যন্ত পিতার উপর নির্ভরশীল ছিলেন। বিশ বছর বয়সে পিতার ব্যবসা বাণিজ্যের দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেন।
শৈশব থেকে রাসূলুল্লাহর সা. সংগে আবু বকরের বন্ধুত্ব ছিল। তিনি রাসূলুল্লাহর সা. অধিকাংশ বাণিজ্য সফরের সংগী ছিলেন। একবার রাসূলুল্লাহর সা. সংগে ব্যবসায় উপলক্ষে সিরিয়া যান। তখন তাঁর বয়স প্রায় আঠারো এবং রাসূলুল্লাহর সা. বয়স বিশ। তাঁরা যখন সিরিয়া সীমান্তে, বিশ্রামের জন্য রাসূল সা. একটি গাছের নীচে বসেন। আবু বকর একটু সামনে এগিয়ে এদিক ওদিক দেখতে লাগলেন। এক খৃস্টান পাদ্রীর সাথে তাঁর দেখা হয় এবং ধর্ম বিষয়ে কিছু কথাবার্তা হয়। আলাপের মাঝখানে পাদ্রী জিজ্ঞেস করে, ওখানে গাছের নীচে কে? আবু বকর বললেন, এক কুরাইশ যুবক, নাম মুহাম্মাদ বিন আবদিল্লাহ। পাদ্রী বলে উঠলো, এ ব্যক্তি আরবদের নবী হবেন। কথাটি আবু বকরের অন্তরে গেঁথে যায়। তখন থেকেই তাঁর অন্তরে রাসূলুল্লাহর সা. প্রকৃত নবী হওয়া সম্পর্কে প্রত্যয় দৃঢ় হতে থাকে। ইতিহাসে এ পাদ্রীর নাম ‘বুহাইরা’ বা ‘নাসতুরা’ বলে উল্লেখিত হয়েছে।
রাসূলুল্লাহর সা. নবুওয়াত লাভের ঘোষণায় মক্কায় হৈ চৈ পড়ে গেল। মক্কার প্রভাবশালী ধনী নেতৃবৃন্দ তাঁর বিরোধিতায় কোমর বেঁধে লেগে যায়। কেউবা তাঁকে মাথা খারাপ, কেউবা জীনে ধরা বলতে থাকে। নেতৃবৃন্দের ইংগিতে ও তাদের দেখাদেখি সাধারণ লোকেরাও ইসলাম থেকে দূরে সরে থাকে। কুরাইশদের ধনবান ও সম্মানী ব্যক্তিদের মধ্যে একমাত্র আবু বকর রাসূলুল্লাহকে সা. সংগ দেন, তাঁকে সাহস দেন এবং বিনা দ্বিধায় তাঁর নবুওয়াতের প্রতি ঈমান আনেন। এই প্রসংগে রাসূল সা. বলেছেনঃ ‘আমি যাকেই ইসলামের দাওয়াত দিয়েছি, একমাত্র আবু বকর ছাড়া প্রত্যেকের মধ্যে কিছু না কিছু দ্বিধার ভাব লক্ষ্য করেছি।’ এভাবে আবু বকর হলেন বয়স্ক আযাদ লোকদের মধ্যে প্রথম মুসলমান।
জান্নাতের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশজন সাহাবীর মধ্যে পাঁচজনই তাঁর আহ্বানে সাড়া দিয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন।
তাঁর দানশীলতা
ইসলামের জন্য তিনি তাঁর সমস্ত সম্পদ ওয়াকফ করে দিয়েছিলেন। তা ছিল চল্লিশ হাজার দিনার (মতান্তরে দিরহাম)। কুরাইশদের যেসব দাসদাসী ইসলাম গ্রহণের কারণে নির্যাতিত হচ্ছিল, এ অর্থ দিয়ে তিনি তাদের মুক্ত করে দেন। এদেরই একজন হলেন বিলাল রাদিয়াল্লাহু আনহু- ইসলামের প্রথম মুয়াযযিন।
বিলালকে তার মালিক উমাইয়া মরুভূমির তপ্ত বালুতে প্রখর রৌদ্রে চিৎ করে বুকে পাথর দিয়ে শুইয়ে রাখত। আর তিনি শুধু বলতেন: আহাদ, আহাদ।
আবু বকর পাঁচ উকিয়া স্বর্ণ দিয়ে তাকে কিনে নিয়ে মুক্ত করে দেন। আরো নানাভাবে আল্লাহর রাস্তায় তিনি তাঁর সম্পদ ব্যয় করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
‘‘আমি প্রতিটি মানুষের ইহসান পরিশোধ করেছি। কিন্তু আবু বকরের ইহসানসমূহ এমন যে তা পরিশোধ করতে আমি অক্ষম। তার প্রতিদান আল্লাহ দেবেন। তার অর্থ আমার উপকারে যেমন এসেছে, অন্য কারো অর্থ তেমন আসেনি।”
সাহাবাদের জন্য তিনি ছিলেন মুক্তহস্ত, উদার। তাবুকের যুদ্ধে তিনি তাঁর সমস্ত সম্পদ দান করেছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তাঁকে প্রশ্ন করেছিলেন:
“তোমার পরিবারের জন্য কি রেখে এসেছ?’’
তিনি তখন উত্তর দিয়েছিলেন: ‘‘তাদের জন্য আল্লাহ ও তাঁর রাসূলই যথেষ্ট।”
আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণিত একটি হাদীসে এসেছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন:
‘‘যে ব্যক্তি আল্লাহর রাস্তায় কোনো বস্তুর এক জোড়া দান করবে, তাকে জান্নাতের কোনো একটি দরজা থেকে ডাকে হবে, ‘হে আল্লাহর বান্দা, এটি উত্তম।’ সালাত আদায়কারীকে সালাতের দরজা থেকে ডাকা হবে, জিহাদকারীকে জিহাদের দরজা থেকে ডাকা হবে, সাদাকাকারীকে সাদাকার দরজা থেকে ডাকা হবে এবং সিয়াম পালনকারীকে সিয়ামের দরজা থেকে ডাকা হবে। আবু বকর জিজ্ঞেস করলেন: কাউকে কি সব কয়টি দরজা থেকে ডাকা হবে, ইয়া রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম!’’
‘‘হ্যাঁ, এবং আমি আশা করি তুমি তাদের একজন, হে আবু বকর।”
আখিরাতের কল্যাণের কাজে, আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের ব্যাপারে আবু বকর ছিলেন অগ্রগামী।
ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন : ঈমানের ক্ষেত্রে আবু বকরের ঈমান অন্য সকল উম্মাতের ঈমান একত্রিত করলে যা হয়, তার চেয়ে বেশি।
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বর্ণিত একটি হাদীসে এসেছে যে, আবু বকর হবেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উম্মতের মধ্যে প্রথম জান্নাতে প্রবেশকারী।
আবু বকরের বীরত্ব
আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন যে, শ্রেষ্ঠ বীর হচ্ছেন আবু বকর রাদিয়াল্লাহু আনহু। বদরের যুদ্ধে তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে ছিলেন, উন্মুক্ত তলোয়ার নিয়ে তাঁকে পাহারা দিয়েছেন। সে সময় কাফিরদের বাহিনী ছিল মুসলিমদের তিনগুণ। এই যুদ্ধে যখন মুসলিম বাহিনী কাফির সেনাদলের মুখোমুখি হয়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরামর্শ চাইলে প্রথমেই দাঁড়ান আবু বকর।
আবু বকরের পুত্র আবদুর রহমান ছিলেন কুরাইশদের পক্ষের যোদ্ধা। পরবর্তীতে মুসলিম হয়ে তিনি সেদিনের ঘটনা বলছিলেন। তিনি দূরে দূরে সরে থাকছিলেন যেন আবু বকর তাঁর সামনে না পড়েন। কিভাবে তিনি তাঁর পিতাকে আঘাত করবেন? আবু বকর শুনে বললেন: ‘‘আমি তো তোমাকে খুঁজছিলাম, সামনে পেলেই হত্যা করতাম।” তিনি এটাই বুঝিয়ে দিলেন যে একজন মুমিনের কাছে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও ভালবাসা সকল মানবিক স্নেহের উপরে।
যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুদের প্রতি কঠোর হলেও তিনি ছিলেন অত্যন্ত কোমল হৃদয়ের অধিকারী। সেজন্য বদরের যুদ্ধবন্দীদের ব্যাপারে মতামত চাওয়া হলে তিনি তাদের হত্যা না করে মুক্তিপণ নেওয়ার পক্ষে ছিলেন। মুসলিমদের তখনকার আর্থিক অবস্থাও তাঁর বিবেচনায় ছিল।
বলা হয়েছে-বদরের সাহাবীরা সর্বশ্রেষ্ঠ, আর বদরের ফেরেশতারা অন্য ফেরেশতাদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ। কারণ এই যুদ্ধ ছিল ইসলামের টিকে থাকার যুদ্ধ, সত্য থেকে মিথ্যাকে পৃথক করার যুদ্ধ।
ওহুদের যুদ্ধের এক পর্যায়ে সকলেই পালিয়ে গিয়েছিল। আবু বকরই প্রথম ফিরে এসেছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে। তিনি ছিলেন রাসূলের মুখপাত্র। তাঁর হয়ে বিভিন্ন গোত্র, প্রতিনিধি ইত্যাদির সাথে কথা বলতেন।
তাঁর জ্ঞান
সাহাবাদের মধ্যে কুরআনে সবচেয়ে বেশি জ্ঞান ছিল তাঁর। বিভিন্ন ঘটনায় আমরা এর প্রমাণ পাই -যার একটি হচ্ছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর পর বিভিন্ন গোত্রের যাকাত দিতে অস্বীকার করার ঘটনা। সে সময় তিনি বলেছিলেন: ‘আল্লাহর কসম, যে সালাত ও যাকাতের মধ্যে পার্থক্য করবে, আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো, যদি তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সময় দিত এমন একটি উটের গলার রশিও দিতে অস্বীকার করে।” অথচ তখন উমর রাদিয়াল্লাহু আনহুর মত সাহাবীরাও তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হতে ইতস্তত করছিলেন।
ইসলামকে তিনিই সব চেয়ে ভাল বুঝেছিলেন-এ ঘটনা তারই প্রমাণ। মৃত্যুর পূর্বে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছিলেন: আল্লাহ তাঁর এক বান্দাকে বেছে নেয়ার এখতিয়ার দিয়েছেন -দুনিয়া অথবা আল্লাহর কাছে যা আছে, সে আল্লাহর কাছে যা আছে তাকেই বেছে নিয়েছে। এ কথা যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর পূর্বাভাব, তা একমাত্র আবু বকরই বুঝতে পেরে কেঁদেছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরো বলেছিলেন:
“আমি যদি কাউকে আল্লাহ ছাড়া বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করতাম, তাহলে সে হত আবু বকর; কিন্তু এ ছাড়া ইসলামে রয়েছে ভ্রাতৃত্ব ও প্রীতির বন্ধন। আবু বকরের দরজা ছাড়া মসজিদে প্রবেশের আর সকল দরজা বন্ধ করে দাও।”
তিনি স্বপ্নের ব্যাখ্যা দেওয়ার বিষয়ে দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। তাঁর খুতবা ছিল সারগর্ভ, ভাষাশৈলী চমৎকার। মানুষকে কিভাবে তার বুদ্ধির স্তর অনুযায়ী আল্লাহর দিকে ডাকতে হবে সুন্দরভাবে, তাঁর কাছে সে শিক্ষা আমরা পেতে পারি।
হুদায়বিয়ার সন্ধির সময় সকল সাহাবা মনক্ষুন্ন ছিলেন আবু বকর ছাড়া। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের প্রতি পরিপূর্ণ বিশ্বাস ও নির্ভরা থেকে যেটা এসেছে। পরবর্তীতে আল্লাহ তা‘আলা সূরা ফাতহ -এ জানিয়েছিলেন যে, তা ছিল এক সুস্পষ্ট বিজয় এবং সকলেই পরে তা বুঝতে পেরেছেন।
মক্কা বিজয়ের পর নবম হিজরীতে প্রথম ইসলামী হজ্জ পালনের সময় তাঁকে হজ্জের আমীর হিসাবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
নবীরা যেখানে মারা যান, সেখানেই তাঁদের কবর দেওয়া হয় একথা আবু বকরই জানিয়েছেন এবং এভাবে কোথায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কবর হবে সে বিতর্কের অবসান ঘটেছে। আর নবীরা যা রেখে যান মৃত্যুর পর, তা সাদাকা, তা মীরাস হিসাবে বন্টিত হয় না-একথাও আবু বকরের কাছ থেকেই সবাই জেনেছে, যখন ফাতিমা রাদিয়াল্লাহু আনহা পিতার মৃত্যুর পর মীরাস দাবী করেছিলেন।
আবু বকরের জীবনের কিছু বৈশিষ্ট্য, যা তাঁকে অন্যদের চেয়ে আলাদা ভাবে চিনিয়ে দেয়:
মিরাজ
তায়েফ থেকে ফেরার পর এক রাত্রে আল্লাহর হুকুমে জিবরাইল আলাইহিস সালাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কা‘বা থেকে মসজিদুল আকসায় নিয়ে গেলেন বুরাক নামের এক বাহনে করে। সেখানে তিনি সকল নবীদের ইমাম হিসাবে দু’রাকাত সালাত আদায় করেন। তারপর তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় আসমানে উপরে। প্রতি আসমানে বিভিন্ন নবী রাসূলের সাথে তাঁর দেখা হয়। তারপর তাঁকে আল্লাহর কাছে নিয়ে যাওয়া হয়, সেখানে মুহাম্মাদের উম্মাতের উপর পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ফরয করে দেওয়া হয়। তাঁকে জান্নাত ও জাহান্নাম দেখানো হয়।
এমন এক সময় এ ঘটনাটি ঘটে যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সবচেয়ে বড় পৃষ্ঠপোষক চাচা আবু তালিব মারা গিয়েছেন এবং তার স্ত্রী খাদিজা মারা গিয়েছেন, মক্কাবাসীর অত্যাচার চরমে পৌঁছেছে। তায়েফবাসীর কাছেও তিনি কোনো রকম সাহায্য তো পানই না, বরং রক্তাক্ত, অপমানিত হয়েছেন। এটা আল্লাহর পক্ষ থেকে তাঁর রাসূলের জন্য মস্ত বড় এক অনুগ্রহ ছিল। যা তাঁর রাসূলের অন্তরকে প্রশান্ত ও শক্তিশালী করে তোলে।
পরদিন সকালে ঘটনাটি শুনে অনেকেরই দ্বিধা-দ্বন্দ দেখা দিল, অনেক মুসলিমই অবিশ্বাস করে কাফির হয়ে গেল। লোকেরা আবু বকরকে জিজ্ঞাসা করল: তুমি কি শুনেছ তোমার বন্ধু কি বলছে? সে বলছে যে সে গতরাতে কা‘বা থেকে জেরুজালেমের আল-আকসা মসজিদে গিয়েছে, সালাত আদায় করেছে, তারপর মক্কায় ফিরে এসেছে।
আবু বকর বললেন: উনি যদি একথা বলে থাকেন, তাহলে নিশ্চয়ই তা সত্য। আমি তো এর চেয়েও আশ্চর্য বিষয় বিশ্বাস করি যে তাঁর উপর আল্লাহর কাছ থেকে ওহী আসে।
তারপর তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে গিয়ে ব্যাপারটি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলেন। যখন তিনি জানতে পারলেন যে সত্যিই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে আল্লাহ বাইতুল মুকাদ্দাস ও সেখান থেকে নিজের কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন, আবু বকর বললেন: আপনি ঠিকই বলেছেন। আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি আপনি নিঃসন্দেহে আল্লাহর রাসূল। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন:
“আবু বকর, তুমি সিদ্দীক।”
এভাবেই আবু বকর ‘সিদ্দীক’ হিসাবে খ্যাতি লাভ করলেন। নবী রাসূলদের পরেই সিদ্দীকের মর্যাদা। রাসূলুল্লাহ যদি কিছু বলে থাকেন, তবে তা সত্যি-আবু বকরের কথা থেকে আমরা হাদীসে যাচাইয়ের এই মূলনীতিটি পাই।
হিজরত
আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেছেন যে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাধারণত সকালে বা সন্ধ্যায় তাঁদের বাড়ীতে আসতেন। একদিন তিনি দুপুরে এলেন এমন একটা সময়ে যে বোঝা যাচ্ছিল গুরুত্বপূর্ণ কিছু ঘটতে যাচ্ছে। আবু বকর দরজা খুললেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে জানালেন যে আল্লাহ তাঁকে মদীনায় হিজরত করার অনুমতি দিয়েছেন।
আবু বকর জিজ্ঞাসা করলেন: আমিও কি আপনার সাথে যেতে পারবো?
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: হ্যাঁ, তুমিও যেতে পারবে। আনন্দে আবু বকর কেঁদে ফেললেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গী হবেন এটাই ছিল তাঁর আনন্দ, অথচ হিজরতের কাজটি ছিল অত্যন্ত বিপজ্জনক, ধরা পড়লে অবধারিত মৃত্যু। আগেই আবু বকর হিজরতের জন্য দুটো উট তৈরী করে রেখেছিলেন। এ আগে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে হিজরতের অনুমতি দেন নি, অপেক্ষা করতে বলেছিলেন।
সে রাতেই তাঁরা বেরিয়ে পড়লেন মদীনার পথে। মক্কার অদূরে সাওর পর্বতের গুহায় আশ্রয় নিলেন, সাথে ছিল আবু বকরের কন্যা আসমার বেঁধে দেওয়া কিছু খাবার।
তিনিদিন তাঁরা ঐ গুহায় থাকলেন। রাত্রে আবু বকরের ছেলে খাবার নিয়ে সেখানে যেতেন ও মক্কার সব খবর দিতেন। আবু বকরের রাখাল ভেড়ার পাল চরিয়ে রাত্রে ঐ পথে ফিরতো, পায়ের সব দাগ মুছে দিয়ে।
কুরাইশরা এ কয়দিন চারিদিকে তাঁদের খুঁজেছে, এক সময় তারা গুহার খুব কাছে এসে পড়ল। এমনটি নিচের দিক তাকালেই তাঁদের দেখে ফেলতো। আবু বকর চিন্তায় অস্থির হয়ে বললেন: আমাদের কিইবা করার আছে, আমরা মাত্র দুজন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: না, তুমি ভুল বলেছ, আমরা তিনজন, আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন।
সত্যিই তারা তাঁদের খুঁজে পেল না, ফিরে গেল। কুরআনে সূরা তওবার ৪০ নম্বর আয়াতে এই ঘটনার উল্লেখ রয়েছে, যেখানে আল্লাহ আবু বকরকে ‘সাহিব’ সাথী হিসাবে বর্ণনা করেছেন, বলেছেন যে তিনি হচ্ছেন ‘দুজনের দ্বিতীয়’।
এরপর তাঁরা একজন বিশ্বস্ত পথপ্রদর্শক নিয়ে যাত্রা করলেন মদীনার পথে। পথে কেউ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরিচয় জিজ্ঞাসা করলে আবু বকর বলেছেন: ইনি আমর পথ প্রদর্শক। তাঁর এ কথায় কোনো ভুল ছিল না, কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের সকলের দুনিয়া ও আখিরাতের পথ প্রদর্শক।
হিজরতের দিনগুলোতে আবু বকর ছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘনিষ্ঠ সাহচর্যে- আবু বকরের দ্বীনের জ্ঞান ও বুঝ সকলের চেয়ে বেশি ও পূর্ণ হওয়ার কারণ এটাই।
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের জীবদ্দশায় সালাতের ইমামতি
মৃত্যুর পূর্বে চরম অসুস্থতার সময়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন সালাতের ইমামতি করতে পারেন নি, তখন তাঁর নির্দেশে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু জামাতে সালাতের ইমামতি করেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর পরের সময়
রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃত্যুর সংবাদে সাহাবীগণ গভীর দুঃখ ও শোকে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েন।
ওসমান রাদিয়াল্লাহু আনহু ঘরে ছিলেন। আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু জানাযার প্রস্তুতিতে ব্যস্ত ছিলেন। উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু খোলা তলোয়ার নিয়ে ঘুরছিলেন, বলছিলেন: মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মারা যান নি। তিনি মূসার আলাইহিস সালামের মত তাঁর রবের কাছে গিয়েছেন এবং আবার ফিরে আসবেন। যারা তাঁকে মৃত বলবে, ফিরে এসে তিনি তাদের সবাইকে হত্যা করবেন।
কেউ কেউ মসজিদে বসে কাঁদছিলেন। মৃত্যুর খবর শুনে আবু বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘরে এলেন। তাঁর মুখের চাদর সরিয়ে কপালে চুমু দিলেন। বললেন: জীবনে এবং মৃত্যুতে আপনি অনুগ্রহপ্রাপ্ত। তারপর বাইরে এসে সব দেখে-শুনে সমবেত লোকদের বললেন: যদি কেউ মুহাম্মাদের ইবাদত করে থাক, তবে জেনে রাখ মুহাম্মাদ মারা গেছেন। আর যে লোক আল্লাহর ইবাদত করে সে যেন জেনে রাখে যে আল্লাহ চিরঞ্জীব, তিনি কখনো মৃত্যুবরণ করবেন না।
তারপর তিনি সূরা আলে ইমরানের ১৪৪ নম্বর আয়াত তিলাওয়াত করেন:
﴿أَفَإِيْن مَّاتَ أَوۡ قُتِلَ ٱنقَلَبۡتُمۡ عَلَىٰٓ أَعۡقَٰبِكُمۡۚ وَمَن يَنقَلِبۡ عَلَىٰ عَقِبَيۡهِ ﴾ [ال عمران: ١٤٤]
“যদি রাসূলুল্লাহ নিহত হয় বা মারা যায়, তাহলে তোমরা কি উল্টাপায়ে ফিরে যাবে?’’ [সূরা আল-বাকারা: ১৪৪]
লোকেরা তাঁর কথায় সম্বিত ফিরে পেল। উমর রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেছেন: আমি যখন আয়াতটি শুনলাম, হাঁটু ভেঙ্গে আমি মাটিতে বসে পড়লাম। আমি বুঝতে পারলাম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সত্যিই মারা গেছেন।
এভাবেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর মত বিরাট একটি ঘটনার যে সংকট দেখা দিয়েছিল, আবু বকরের দৃঢ়তায় তার পরিসমাপ্তি ঘটে।
খিলাফত
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মৃত্যুর পর তাঁর দাফন শেষ হওয়ার আগেই পরবর্তী খলিফা নির্বাচন নিয়ে সমস্যা দেখা দিল। মদীনার আনসাররা সাকীফা বনু সায়িদায় একত্রিত হন। সেখানে কিছু সংখ্যক মুহাজিরও ছিলেন। আনসাররা অভিমত দিলেন যে পরবর্তী খলিফা তাঁদের মধ্য থেকেই নির্বাচিত হোক। মুহাজিররা এর প্রতিবাদ জানালেন। দু পক্ষ থেকে দুজন খলিফা নির্বাচনের দাবীও কেউ কেউ জানালেন। এভাবে একটি গুরুতর পরিস্থিতির সৃষ্টি হল।
খবর পেয়ে আবু বকর, উমর ও আরো কয়েকজন মুহাজির সেখানে গেলেন। আবু বকর একটি চমৎকার ভাষণ দিলেন। তাঁর ধীরতা ও যুক্তি-প্রমাণের কাছে সবাই নতি স্বীকার করল।
ওমর রাদিয়াল্লাহু আনহু খলিফা হিসাবে আবু বকরের নাম প্রস্তাব করলেন ও প্রথমেই তাঁর হাতে বাইয়াত নিলেন। এরপর সকলেই বাইয়াত নিলেন। এভাবে ইসলামের প্রথম খলিফা নির্বাচিত হলেন আবু বকর।
এরপর তিনি একটি সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন, যাতে একজন খলিফার দায়িত্ব এবং জনগণের দায়িত্ব অত্যন্ত স্পষ্টভাবে ফুঠে উঠেছে।
ভাষণ: হে লোকসকল, আমাকে তোমাদের উপর কর্তৃত্ব দেওয়া হয়েছে, কিন্তু আমি তোমাদের সর্বোত্তম নই। সুতরাং যদি আমি সঠিক কাজ করি তবে আমাকে সাহায্য কর এবং যদি আমি ভুল করি তবে আমাকে সংশোধন করে দিও। সততা একটি পবিত্র আমানত এবং মিথ্যা হচ্ছে বিশ্বাসঘাতকতা। তোমাদের দুর্বলরা ততক্ষণ পর্যন্ত সবল যতক্ষণ পযন্ত আমি তাকে তার অধিকার আদায় করে দেই ইনশাআল্লাহ এবং তোমাদের শক্তিশালীরা ততক্ষণ পর্যন্ত দুর্বল যতক্ষণ পর্যন্ত আমি তাদের কাছে থেকে পাওনা আদায় করে দেই ইনশাআল্লাহ। কোনো জাতি জিহাদ ত্যাগ করলে আল্লাহ তাকে লাঞ্ছিত না করে ছাড়বেন না। না কোনো জাতির মধ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়বে আর আল্লাহ তাকে পরীক্ষায় ফেলবেন না। আমাকে ততক্ষণ মেনে চল যতক্ষণ আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে মেনে চলি এবং যদি আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে মেনে না চলি, তাহলে আমার প্রতি তোমাদের আনুগত্যের কোনো বাধ্যবাধকতা থাকবে না। সালাতের জন্য দাঁড়াও। আল্লাহ তোমাদের উপর রহম করুন। (আনাস ইবন মালিক বর্ণিত)।
আবু বকর খলিফা হওয়ার আগে মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্বে ছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। একজন নবীর নেতৃত্ব ও মানুষের নেতৃত্বের মাঝে পার্থক্য আছে। নবীর প্রদর্শিত পথে একজন সাধারণ মানুষ কিভাবে নেতৃত্ব দেবে তা দেখিয়ে গেছেন আবু বকর। যে সব মূলনীতি তাঁর ভাষণের মধ্য থেকে বেরিয়ে আসে, তা উম্মাহর জন্য অনুসরণীয়।
আবু বকর স্পষ্টতই বুঝিয়ে দিলেন যে শরীয়তের উৎস কুরআন ও সুন্নাহ। আনুগত্য ততক্ষণ, যতক্ষণ কেউ আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের আনুগত্য করবে।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নেতৃত্ব ছিল প্রশ্নাতীত, কারণ আল্লাহ নিজে তাঁকে নির্দেশ দিয়েছেন ও সংশোধন করেছেন। মুসলিম নেতা জবাবদিহি করবে উম্মাহর কাছে- উম্মাহর দায়িত্ব ইমামকে সঠিক পথে চালানো। সুবিচার ও সমতা হবে ইসলামী রাষ্ট্রের ভিত্তি। নেতা ও উম্মাহর মাঝে সম্পর্ক হবে সততা ও বিশ্বস্ততার।
যে জাতি আল্লাহর পথে জিহাদ করে না, আল্লাহ তাকে লাঞ্ছিত করবেন এটাই আল্লাহর নিয়ম বা রীতি। যে জাতির মধ্যে প্রকাশ্যে অশ্লীলতা ছড়িয়ে পড়ে, তারা বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়, সে জাতি হয় দুর্বল।
খলিফা হওয়ার পর তাঁর জীবন
খলিফা হওয়ার পরদিনই আবু বকর কাপড়ের গাঁঠরী মাথায় নিয়ে বাজারের পথে রওয়ানা হলেন। তিনি ছিলেন কাপড়ের ব্যবসায়ী। এতেই তাঁর সংসার চলত। কিন্তু উম্মাহর প্রতি খিলাফতের দায়িত্ব পালনের যুক্তিতে উমর তাঁকে ব্যবসার ব্যাপারে নিরুৎসাহিত করলেন। তিনি তাকে আবু ওবায়দার কাছে নিয়ে গেলেন। বায়তুল মাল থেকে তাঁর জন্য প্রতিদিন অর্ধেক ভেড়া ও বাৎসরিক ২০০০ দীনার বেতন নির্ধারণ করা হলো। এছাড়া শীতের ও গ্রীষ্মের কাপড়।
পরবতীতে এ বেতন বাড়িয়ে দৈনিক একটি ভেড়া ও বাৎসরিক ৩০০০ দীনার করা হল, এটি তাঁর প্রয়োজন ছিল। মিম্বরে দাঁড়িয়ে এ ব্যাপারে তিনি উম্মাহর সম্মতি নিলেন। তাঁদের খাবার ছিল রুটি, গোশত আর তিনি ছিলেন অত্যন্ত অতিথিপরায়ণ। মৃত্যুর সময় তিনি যা রেখে গিয়েছিলেন তা হচ্ছে একটি দাস, একটি গামলা, একটি চাদর, তা তিনি পরবর্তী খালিফাকে ফিরিয়ে দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। আর তাঁর যা কিছু স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ছিল, তা বিক্রি করে বাইতুল মাল থেকে যা নিয়েছিলেন, তা ফেরৎ দিতে বলে গিয়েছিলেন। একথা শুনে উমর কেঁদে বলেছিলেন: আবু বকর তাঁর পরবর্তীদের জন্য কঠিন দৃষ্টান্ত রেখে গেলেন।
খলিফা হওয়ার পরও তিনি আগে যা করতেন, তাই করেছেন। প্রতিবেশী ছোট ছোট মেয়েদের দুধ দোয়ানোর কাজে আগের মতই সাহায্য করতেন। উমর এক বৃদ্ধার বাড়িতে প্রতিদিন ভোরে যেতেন ও তার কাজ করে দিতেন। একদিন গিয়ে দেখলেন, কে যেন আগেই কাজগুলি করে দিয়ে গেছেন। রোজই এমন হতে থাকল। তারপর একদিন উমর দেখতে পেলেন, কাজ শেষ করে যিনি বেরিয়ে আসছেন, তিনি হচ্ছেন আবু বকর।
আবু বকরের খিলাফত জীবনের কর্মকাণ্ড:
১. ইমাম হিসাবে তাঁর দায়িত্ব ছিল সকলের দেখাশুনা করা, শিক্ষা দেয়া, সৎকাজের আদেশ ও মন্দকাজের নিষেধ করা। তাঁর নিয়মিত কাজের মধ্যে ছিল: সালাতের ইমামতি, জুমুআর খুতবা দেওয়া-যার মাধ্যমে জনগণকে শিক্ষা দেওয়া হয়, গুরুত্বপূর্ণ বিষয় জানানো হয় ও মতামত গ্রহণ করা হয়।
২. সেনাবাহিনীকে বিভিন্ন যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠানো, নিয়োগ, জিহাদের বিভিন্ন আর্থিক দায়িত্ব, শত্রুদের সাথে সন্ধি ইত্যাদি।
৩. বিচারক, যাকাত সংগ্রহকারী, জিযিয়া সংগ্রহকারী নিয়োগ।
৪. বাইয়্যাত গ্রহণকারী নিয়োগ।
৫. হুদুদ প্রতিষ্ঠা করা, ইজতিহাদ করা।
৬. মসজিদে শিক্ষার ব্যবস্থা করা।
ঊসামার বাহিনী
মৃত্যুর পূর্বে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উসামার নেতৃত্বে রোমানদের বিরুদ্ধে এক সেনাবাহিনী প্রেরণের সব ব্যবস্থা সম্পন্ন করেন। মুসলিমদের অধিকাংশ লোক এবং নেতৃস্থানীয় সকলেই এই বাহিনীতে ছিলেন। মদীনার বাইরে আল জুরফ-এ ক্যাম্প করে এই বাহিনী অবস্থান করছিল। সকলে একত্রিত হয়ে সেখান থেকে অভিযান শুরুর কথা ছিল। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অসুস্থ ছিলেন। যাত্রার আদেশ দেওয়ার পরই তিনি মারা যান। রোমানদের বিরুদ্ধে যায়েদ রাদিয়াল্লাহু আনহুর সেনাবাহিনী পরাজিত হয়েছিল, যায়েদসহ অনেক বড় বড় সাহাবী শহীদ হয়েছিলেন। পরের বৎসর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে সৈন্য নিয়ে তাবুক গিয়েছিলেন। তার পরের বছরই উসামার নেতৃত্বে এই অভিযানের আদেশ দিয়েছিলেন তিনি।
কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর পরই আরবের কিছু গোত্রে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। মদীনার ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পরিবারের নিরাপত্তার কথা ভেবে এ সময়ে উসামার বাহিনীকে অভিযানে না পাঠানোর জন্য নেতৃস্থানীয় সাহাবীগণ পরামর্শ দেন খলিফাকে। কিন্তু তিনি অত্যন্ত কঠোরভাবে এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নেওয়া কোনো সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করার সমস্ত সম্ভাবনা তিনি উড়িয়ে দেন। খলিফাকে অবশ্যই নবীর পদক্ষেপ অনুসরণ করতে হবে এটাই তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
এমনকি উসামার মত অল্পবয়স্ক সাহাবীকে সেনাপতিত্ব থেকে সরিয়ে অন্য কোনো বয়স্ক সাহাবীকে সেনাপতি নিযুক্ত করার প্রস্তাব করা হলে তিনি রেগে গিয়ে বলেছিলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যাকে নিয়োগ দিয়েছেন আবু বকর তাকে অপসারণ করবে? আবু বকর একাই সকলের বিরুদ্ধে মত দিয়েছিলেন এবং সেটাই ছিল সঠিক। সংখ্যাগরিষ্ঠের মতই যে সবসময় সঠিক ও গ্রহণযোগ্য তা নয়। এই দূরদর্শিতা, জ্ঞান, ইয়াকীন, বিশুদ্ধ ঈমান রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাথে আবু বকরের ঘনিষ্ঠতার ফল।
উসামা রওয়ানা হয়ে ঘোড়ায় চড়ে যাচ্ছিলেন। খলিফা পাশে পাশে পায়ে হঁটে চলছিলেন। বিভিন্ন বিষয়ে উপদেশ-নির্দেশ দিচ্ছিলেন। উসামার শত অনুরোধেও তিনি ঘোড়ায় চড়তে রাজী হননি, তাকেও নেমে তাঁর পাশে হেঁটে চলতে দেননি। বলেছিলেন: আমার পা যদি আল্লাহর রাস্তায় ধূলি-ধূসরিত হয় কিছু দূর, তাতে ক্ষতি কি? ওমরকে তিনি তাঁর কাজের জন্য উসামার কাছ থেকে চেয়ে নিলেন।
যুদ্ধের কিছু নিয়মনীতি স্পষ্টভাবে তিনি জানিয়ে দিলেন। যেমন:
১. বিশ্বসঘাতকতা না করা,
২. চুরি না করা,
৩. বিশ্বস্ত থাকা,
৪. শিশু, বৃদ্ধ ও নারীদের হত্যা না করা,
৫. ফলবান গাছ না কাটা,
৬. বিধর্মী পুরোহিতদের বিরক্ত না করা,
৭. বিসমিল্লাহ বলে কোনো খাবার খাওয়া,
৮. প্রতারণা না করা,
৯. লাশ বিকৃত না করা।
আরব গোত্রগুলির মধ্যে যারা বিদ্রোহ করেছিল, এই বাহিনী তাদের মাঝে ভীতি ও বিস্ময়ের সৃষ্টি করেছিল। কারণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর মাত্র তিনদিন পরেই এ বাহিনী পাঠানো হয়েছিল তখনকার সবচেয়ে শক্তিধর রোমানদের বিরুদ্ধে।
সম্রাট হিরাক্লিয়াস মদীনার ঘটনাগুলি পর্যবেক্ষণ করার জন্য এন্টওয়ার্পে অবস্থান নিল-সে অত্যন্ত উদ্বিগ্ন ছিল। একই দিনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৃত্যুর খবর ও উসামার অভিযানের খবর তার কাছে পৌঁছাল। সে আর কোনো বাহিনী পাঠাল না।
উসামা রোমান ভূমিতে গেলেন, জিযিয়া গ্রহণ করলেন, সন্ধিচুক্তি করলেন এবং নিরাপদে ফিরে এলেন। এভাবেই আল্লাহর উপর নির্ভরতা ও দৃঢ় বিশ্বাসের ফলাফল আসে।
মুরতাদদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সময় দশম হিজরীতে রিদ্দা শুরু হয়েছিল। তখন অনেকেই ইসলামের শক্তিতে ভীত হয়ে ইসলাম গ্রহণ করেছিল।
মুরতাদ তারাই যারা নিয়ত, কথা ও কাজের মাধ্যমে ইসলামকে পরিত্যাগ করে। ভন্ড নবীদের আবির্ভাব রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সময়েই হয়। তাঁর মৃত্যুর সাথে সাথে কিছুসংখ্যক লোক মূর্তি পূজায় ফিরে যায়। কিছু গোত্র যাকাত দিতে অস্বীকার করে। তাদের যুক্তি ছিল, এখন যেহেতু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নেই, যাকাত দেবারও প্রয়োজন নেই।
আবু বকর খলিফা হওয়ার পর এই গোত্রগুলি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিনিধিদল পাঠান সমঝোতার জন্য। তাদের পক্ষে ওমরের মত সাহাবীও সুপারিশ করেছিলেন-কারণ তারা ছিল মুসলিম। কিন্তু আবু বকরের কথা ছিল: ‘‘আল্লাহর কসম, যে কেউ সালাত ও যাকাতের পার্থক্য করবে, আমি তার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবো। এমনকি যদি তারা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সময় দিয়ে থাকত এমন একটি উটের গলার রশিও না দেয়…..।”
তাঁর দৃঢ়তায় সকলে বুঝতে পারেন যে দ্বীনের মৌলিক ভিত্তিসমূহ প্রতিষ্ঠা করা কতখানি জরুরী। তাদের আক্রমণের আশংকা করে তিনি সকলকে মদীনা রক্ষার জন্য তৈরী হতে বললেন। বিভিন্ন প্রস্তুতি নিলেন। মসজিদে নববীতে
সকলকে জড়ো করলেন। মদীনার প্রবেশপথে বিভিন্ন সাহাবীর নেতৃত্বে সশস্ত্র বাহিনী নিয়োগ করলেন। মিত্র গোত্রগুলির সাহায্য চাইলেন।
তিন দিনের মধ্যেই বিদ্রোহী গোত্রগুলি আক্রমণ করল। প্রথম দিকে তারা কিছুটা সফল হলেও পরবর্তীতে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল। একই রাত্রে কিছু গোত্র যাকাত নিয়ে এল। একদিনেই পরিস্থিতি বদলে গেল। আরও যুদ্ধ হল, তিনটিতে আবু বকর নেতৃত্ব দিলেন।
বিভিন্ন গোত্র বিদ্রোহ করল ও যুদ্ধ শুরু করে দিল। আবু বকরের মত এত নির্বিকারভাবে এ সমস্ত সংবাদ গ্রহণ করতে কেউ দেখে নি। তিনি শুধুমাত্র হিজরতের সময় গুহায় অবস্থানকালে বিচলিত হয়েছিলেন, আর কখনো নয়।
বিভিন্ন জায়গায় তিনি ১১টি বাহিনী পাঠালেন। কোথাও কোনো সম্পূর্ণ গোত্র মুরতাদ হয়েছিল, কোথাও অধিকাংশ, কোথাও অল্পসংখ্যক। সেক্ষেত্রে তিনি তাদের মধ্য থেকেই মুরতাদদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে অনুপ্রাণিত করতেন। তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে ইসলাম ছাড়া আর কিছুই গ্রহণ করা হবে না।
এ সব কঠোর যুদ্ধ ইসলামকে শির্ক মিশ্রিত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা করেছে। আশংকা ছিল যে দ্বীন পরিবর্তিত হয়ে যাবে। আবু বকর বলেছিলেন: এখন জিবরীল ওহী নিয়ে আসবেন না এবং দ্বীন সম্পূর্ণ হয়েছে। এখন আমি একে কিছুতেই বিচ্যুত হতে দিতে পারি না।
তিনি নিশ্চিত করেছিলেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সময় যে ইসলাম ছিল, পরবর্তীতেও তাই থাকবে। সমগ্র আরব এটা বুঝে নিল।
সবার জন্য সমভাবে, পূর্ণভাবে, শির্কবিহীন ইসলাম প্রতিষ্ঠিত হল। যা পরবর্তীতে সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ল নিবেদিতপ্রাণ বিশ্বস্ত সাহাবীগণের মাধ্যমে। এসব সংস্কারের মধ্য দিয়ে পরীক্ষিত মুমিনরাই দুনিয়া জুড়ে ইসলামী সাম্রাজ্যের ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন।
আবু বকরের আগে সঠিক অর্থে রিদ্দা ছিল না তাদের বিরুদ্ধে সঠিক পদক্ষেপ কি হবে তিনি তা বুঝিয়ে দিলেন।
কুরআন লিপিবদ্ধকরণ
ইয়ামামার যুদ্ধে বহু হাফিযে কুরআন শহীদ হন। উমর তখন আবু বকরকে অনুরোধ করেন কুরআন পুস্তক আকারে লিপিবদ্ধ করার জন্য। তখনও কুরআন লিখিত অবস্থায় ছিল চামড়ায়, পাথরের টুকরায়, কাগজে। কিন্তু একত্রিত অবস্থায় ছিল না। প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পেরে আবু বকর কুরআনকে মাসহাফ আকারে লিপিবদ্ধ করার উদ্যোগ নেন।
আবু বকরের সময়ে রোম ও শাম আক্রমণ করা হয় এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী মুসলমানরা বিজয়ী হয়।
উম্মাহর স্বার্থে, ইবাদতের অংশ হিসাবেই এসব জিহাদ করা হয়েছিল-দ্বীন বাঁচানো ও প্রতিষ্ঠার জন্য, জুলুম থেকে মুক্তির জন্য।
দু’বছরের কিছু বেশী সময় আবু বকর খলিফা ছিলেন। তাঁর জীবন ও কর্ম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুসরণেই ছিল। সুন্নাহর অনুসরণে তিনি একনিষ্ঠ ছিলেন। কোনো বিলাসিতা, অপচয়, অবসর তাঁর জীবনে ছিল না। জিহাদ ও দাওয়া-এভাবেই তাঁর জীবন কেটেছে।
তিনি অল্পসংখ্যক হাদীস বর্ণনা করেছেন, কারণ এ ব্যাপারে তিনি অত্যন্ত সাবধানী ছিলেন।
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মত একই বয়সে, একই দিনে তিনি মারা যান। মৃত্যুর পূর্বে তিনি ওমরকে খলিফা নিযুক্ত করেন। উমর তাঁর জানাযার সালাত পড়ান।
তাঁর জীবনের ঘটনাগুলো আমরা যদি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করি, তবে অসাধারণ এক চরিত্র আমরা দেখতে পাব যা ছিল কোমলতা ও কঠোরতার এক অপূর্ব সমন্বয়। তাঁর এই চরিত্রই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পর এই দ্বীনকে এক দৃঢ় ভিত্তির উপর দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। কুরআন কিভাবে বুঝতে হবে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কিভাবে অনুসরণ করতে হবে? সে বিষয়ে তিনি আমাদের কাছে আদর্শ হয়ে আছেন।
হে আল্লাহ! আমাদেরকে এইসব মহাপুরুষদের পদাঙ্ক অনুসরণ করার তৌফিক দান করুন।
তথ্য সংযুক্তি:
১. দ্যা হিস্টোরি অব দি খালিফাহ’স
জালালুদ্দীন সুয়ূতী রহঃ
২. আসহাবে রাসূলের জীবনকথা-মুহাম্মাদ আবুদল মা‘বুদ।