প্রাণের মদিনা, এই মদিনা সম্পর্কে জেনে নিন গুরুত্বপূর্ণ নানা তথ্য
ইসলাম ডেস্ক: মুসলমানদের প্রাণের ভূমি মদিনা। প্রিয়নবী (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামের বরকতময় স্মৃতিবিজড়িত পবিত্র শহর মদিনা। এই পুণ্যভূমিতেই সবুজ গম্বুজের ছায়ায় চিরনিদ্রায় শায়িত আছেন সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মানব, সায়্যিদুল মুরসালিন, রাহমাতুল্লিল আলামিন (সা.)।
তাঁর পবিত্র দেহ বুকে ধারণ করে মদিনা চিরধন্য। তাঁর নাম শোনামাত্রই হৃদয়ের আয়নায় ভেসে ওঠে এক স্বর্গীয় নগরীর ছবি। প্রেম, ভালোবাসা আর শ্রদ্ধাবোধে ভরে যায় মন। মুমিনের জীবনে আল্লাহর ঘর জিয়ারত ও প্রিয় হাবিবের রওজার পাশে দাঁড়িয়ে সালাম জানানোর চেয়ে বড় কোনো প্রাপ্তি হতে পারে না। মুসলমানদের প্রাণের মদিনা সম্পর্কে জেনে অতীব গুরুত্বপূর্ণ নানা তথ্য।
মদিনার মর্যাদা
মদিনা বরকতপূর্ণ নগরী। এর বরকতের জন্য প্রিয়নবী (সা.) আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলেন, ‘হে আল্লাহ! আপনি মক্কায় যে বরকত দান করেছেন, তার দ্বিগুণ বরকত মদিনায় দান করুন।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ৩৩৯২)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আমাকে এমন এক নগরীতে বসবাসের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যা মর্যাদায় সব শহরকে ছাড়িয়ে যাবে। মানুষ তাকে ইয়াসরিব বলে। তার নাম হলো মদিনা। তা মন্দ চরিত্রের লোকদের এমনভাবে দূর করে দেবে, যেমন কামারের ভাট্টি লোহার ময়লা দূর করে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৮৭১)
মদিনার প্রতি রাসুল (সা.)-এর ভালোবাসা
আয়েশা (রা.) বলেন, নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘হে আল্লাহ! তুমি মদিনাকে আমাদের কাছে এমনই প্রিয় করে দাও, যেমনি প্রিয় করেছ মক্কাকে। বরং তার চেয়েও বেশি প্রিয় করে দাও।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৬৩৭২)
আনাস (রা.) সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন কোনো সফর থেকে মদিনায় ফিরে আসতেন, তখন দূর থেকে মদিনার ঘরবাড়ি দেখেই তাঁর উটের গতি বাড়িয়ে দিতেন। অন্য কিছুতে আরোহিত থাকা অবস্থায় ভালোবাসার আতিশয্যে তা নাড়াচাড়া শুরু করে দিতেন। (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৮৮৬)
আবু হুমাইদ সায়েদি (রা.) বলেন, “আমরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে তাবুক যুদ্ধ থেকে ফিরে আসছিলাম। যখন আমরা মদিনার নিকটবর্তী হলাম, রাসুলুল্লাহ (সা.) বললেন, ‘এই তো পবিত্র ভূমি। এই তো ওহুদ পাহাড়, যে পাহাড় আমাদের ভালোবাসে, আমরাও তাকে ভালোবাসি’।” (সহিহ বুখারি, হাদিস : ৪৪২২)
মদিনাবাসীর ফজিলত
মদিনাবাসী আনসার সাহাবিদের সম্পর্কে আল্লাহ ইরশাদ করেন, ‘আর ওই সব লোক, যারা তাতে (মদিনায়) আগে থেকেই ইমানের সঙ্গে বসবাস করছে। যারা হিজরত করে তাদের কাছে আসে, তাদের তারা ভালোবাসে। আর যা কিছু তাদের (মুহাজিরদের) দেওয়া হয়, তার জন্য নিজেদের অন্তরে কোনো চাহিদা বোধ করে না। আর তাদের (মুহাজিরদের) তারা নিজেদের ওপর প্রাধান্য দেয়, যদিও তারা অভাব-অনটনে ভোগে।’ (সুরা : হাশর, আয়াত : ৯)
রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি মদিনার অধিবাসীদের কোনো ক্ষতি সাধন করতে চায়, আল্লাহ তাকে নিশ্চিহ্ন করে দেবেন, যেভাবে লবণ পানির মধ্যে মিশে যায়।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস : ১৩৮৬)
মদিনা ইমান ও নিরাপত্তার স্থান
মদিনা থেকেই ইমানের আলো সারা বিশ্বে বিচ্ছুরিত হয়েছিল। শেষ যুগে মানুষ যখন ইমান থেকে বিচ্যুত হতে থাকবে, তখন ইমান তার গৃহে তথা মদিনার দিকে ফিরে আসবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘ইমান মদিনার দিকে ফিরে আসবে, যেভাবে সাপ তার গর্তের দিকে ফিরে আসে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৮৭৬) দাজ্জালের আবির্ভাবে ফিতনা যখন বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়বে, পৃথিবীবাসী ভীত থাকবে। পৃথিবীর সর্বত্র বিচরণ করতে সক্ষম হলেও তখন সে পবিত্র মদিনায় প্রবেশ করতে পারবে না। হাদিস শরিফে আছে, ‘মক্কা ও মদিনা ছাড়া এমন কোনো শহর নেই, যা দাজ্জালের পদার্পণে বিপর্যস্ত হবে না। মক্কা-মদিনার প্রতিটি ফটকেই ফেরেশতারা সারিবদ্ধ হয়ে পাহারা দেবেন। তখন মদিনা তার অধিবাসীদেরসহ তিনবার কেঁপে উঠবে। আর সব কাফির ও মুনাফিক মদিনা ছেড়ে চলে যাবে।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১৮৮১)
মদিনায় মসজিদে নববী
মদিনার মসজিদের রয়েছে সবিশেষ গুরুত্ব। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘আমার এই মসজিদে নামাজ আদায় মক্কার মসজিদুল হারাম ছাড়া অন্য সব মসজিদে নামাজ অপেক্ষা এক হাজার গুণ বেশি সাওয়াব।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১১৯০)
আরেক বর্ণনায় রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমার এই মসজিদে লাগাতার ৪০ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেছে, এর মধ্যে কোনো নামাজ ছোটেনি, সে মোনাফেকি ও দোজখের আজাব থেকে নাজাত পাবে।’ (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ১২৫৮৩)
রাসুলুল্লাহ (সা.) আরো বলেন, ‘আমার মিম্বার ও ঘরের মাঝখানের অংশটুকু জান্নাতের বাগিচাসমূহের একটি বাগিচা।’ (সহিহ বুখারি, হাদিস : ১১৯৫)
মসজিদে নববীর পাশে আয়েশা (রা.)-এর হুজরায় অবস্থিত নবীজির রওজা শরিফ। তারই পাশে হজরত আবু বকর (রা.) ও উমর (রা.)-এর কবর। এর পাশে আরেকটি কবরের জায়গা খালি আছে, এখানে হজরত ঈসা (আ.)-এর সমাধি হবে। (তিরমিজি, হাদিস : ৩৬১৭)
রওজা শরিফের পশ্চিম দিকে রাসুল (সা.)-এর মিম্বার পর্যন্ত স্থানটুকুকে ‘রিয়াজুল জান্নাত’ বা বেহেশতের বাগিচা বলা হয়। এটি দুনিয়ায় একমাত্র জান্নাতের অংশ।
মসজিদে নববীর পূর্ব দিকে অবস্থিত ‘জান্নাতুল বাকি’ গোরস্তানে অসংখ্য সাহাবা, তাবেইন, আউলিয়া ও নেককার মুসলমানের কবর রয়েছে। এর মধ্যে হজরত উসমান, আলী, ইবনে মাসউদ, ফাতিমা, আয়েশা, রাসুল (সা.)-এর দুধমা হালিমা, চাচা আব্বাস, রাসুল (সা.)-এর ছেলে ইব্রাহিম, হাসান রাদিয়াল্লাহু আনহুমসহ অনেকের কবর আছে। রাসুল (সা.) প্রায়ই জান্নাতুল বাকিতে জিয়ারতে যেতেন।
পবিত্র রওজা জিয়ারত
মদিনা শরিফ যাওয়ার একমাত্র উদ্দেশ্যই হবে রওজাপাকের জিয়ারত। হাদিস ও ফিকাহ গ্রন্থগুলোতে এ বিষয়ে নির্দেশনা রয়েছে। মদিনায় যাওয়া নিছক কোনো ভ্রমণ নয়, বরং তা একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। আর তা হতে হবে রওজাপাকের জিয়ারতের নিয়তেই। আল্লামা সামহুদি (রহ.) বলেন, ওহুদের শহীদদের কবর জিয়ারতের উদ্দেশ্যে নবী করিম (সা.) তাশরিফ নিয়েছেন। দুনিয়ার সব কবরের মধ্যে সর্বোত্তম ও সবচেয়ে বেশি জিয়ারতের উপযুক্ত স্থান হলো রাসুল (সা.)-এর রওজা। তাই এর উদ্দেশে সফর করাও উত্তম। এ কথার ওপর পূর্বাপর সব উলামায়ে কেরামের ঐকমত্য রয়েছে। (ওয়াফাউল ওয়াফা : ৪/১৮৮)
হাদিস শরিফে রয়েছে, রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমার কবর জিয়ারত করল, তার জন্য আমার সুপারিশ অবধারিত।’ (সুনানে দারাকুতনি, হাদিস : ২৬৯৫, শুআবুল ইমান, হাদিস : ৩৮৬২) হাদিসটিকে ইমাম ইবনুস সাকান, আব্দুল হক ও তাকি উদ্দিন সুবকি (রহ.) সহিহ বলেছেন। (নায়লুল আওতার : ৫/৯৫) অন্য হাদিসে রয়েছে, রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি একমাত্র আমার জিয়ারতের উদ্দেশ্যে এবং এ ছাড়া অন্য কোনো উদ্দেশ্য ছাড়াই আমার জিয়ারতে আসবে, কিয়ামতের দিন তার সুপারিশ করা আমার ওপর জরুরি হয়ে পড়বে।’ (আল মুজামুল কাবির : হাদিস : ১৩১৪৯) হাদিসটিকে ইমাম ইবনুস সাকান ও ইরাকি (রহ.) সহিহ বলেছেন। (ওয়াফাউল ওয়াফা : ৪/১৭১, এলাউস সুনান : ৭/৩৬০৬)
অন্য হাদিসে রয়েছে, রাসুল (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি আমার মৃত্যুর পর আমার জিয়ারত করবে, সে যেন আমার জীবদ্দশায়ই আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করল।’ (সুনানে দারাকুতনি, হাদিস : ২৬৯৪, শুআবুল ইমান, হাদিস : ৩৮৫৫) ইমাম জাহাবি রহ.-এর মতে, হাদিসটির সূত্র ভালো (জাইয়্যেদ)। (ওয়াফাউল ওয়াফা : ৪/১৭১)
মদিনায় মৃত্যুর ফজিলত
প্রিয় নবী (সা.) তাঁর উম্মতকে মদিনায় আবাসস্থল বানাতে এবং এর মধ্যে মৃত্যু কামনা করতেও উৎসাহ দিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি একনিষ্ঠভাবে আমার কবর জিয়ারত করবে, কিয়ামতের দিন সে আমার পাশে থাকবে। আর যে মদিনায় বসবাস করবে এবং তার বিপদাপদের ওপর ধৈর্য ধারণ করবে, কিয়ামতের দিন আমি তার সাক্ষী ও সুপারিশকারী হব। আর যে ব্যক্তি দুই পবিত্র নগরীর (মক্কা-মদিনা) যেকোনো একটিতে মৃত্যুবরণ করবে, কিয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা তাকে নিশ্চিন্ত করে ওঠাবেন।’ (শুআবুল ইমান, হাদিস : ৩৮৫৬)
অন্য হাদিসে এসেছে : ‘তোমাদের মধ্যে যার পক্ষে সম্ভব হয়, সে যেন মদিনায় মৃত্যুবরণ করে। কেননা যে ব্যক্তি মদিনায় মৃত্যুবরণ করবে, আমি তার জন্য সুপারিশ করব।’ (তিরমিজি, হাদিস : ৩৯১৭)
আল্লাহ তাআলা আমাদের রাসুল (সা.)-এর রওজাপাক জিয়ারত ও মদিনায় মৃত্যু নসিব করুন। আমিন।
লেখক : ফতোয়া গবেষক, ইসলামিক রিচার্স সেন্টার, বাংলাদেশ