রহস্যঘেরা সাইফুল্লাহ ওজাকির :: ছিলেন জাপান প্রবাসী, ধর্মান্তরিত হয়েই যোগাযোগ বন্ধ



বিভিন্ন গণমাধ্যমে ‘নিখোঁজ’ হিসেবে উল্লেখ করে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়ে যে ১০ জনের ছবি প্রকাশিত ও প্রচারিত হচ্ছে এর মধ্যে সাইফুল্লাহ ওজাকির একজন। তাঁর বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলায়। স্কলারশিপ নিয়ে ২০১১ সালে তিনি জাপানে পাড়ি জমান।
সর্বশেষ বছরখানেক আগে তিনি গ্রামে এসে অন্যের বাড়িতে ঘণ্টাখানেক অবস্থান নিয়ে পরিবারের লোকজনের সঙ্গে দেখা করেন। অবশ্য সাত-আট মাস ধরে পরিবারের সঙ্গে তিনি আর যোগাযোগ করছেন না।
বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত সাইফুল্লাহর পরিবার। সাইফুল্লাহ নিখোঁজ হওয়া নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত ছবি সম্পর্কে গত মঙ্গলবার তারা সাংবাদিকদের মাধ্যমে অবগত হয়। সাইফুল্লাহর বাবা জনার্দন দেবনাথ মোবাইল ফোনে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এসব কিছুই আমি জানি না। তবে সাত-আট মাস ধরে আমাদের সঙ্গে সে কোনো যোগাযোগ করছে না। সে কোথায় আছে তা-ও আমরা জানি না।’
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, ঢাকার উত্তরা পশ্চিম থানার একটি মামলায় আসামি হিসেবে নাম-ঠিকানা যাচাইয়ের জন্য একটি চিঠি আসে। সেই সূত্রে তার নাম-ঠিকানা সঠিক আছে মর্মে চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে প্রতিবেদন পাঠায় নবীনগর থানার পুলিশ।
এলাকাবাসী ও পরিবারের লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নবীনগর উপজেলার জিনদপুর ইউনিয়নের কড়ইবাড়ী গ্রামের জনার্দন দেবনাথের ছেলে সজিত দেবনাথ ছিলেন খুব মেধাবী। জিনদপুরের হুরুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও লাউর ফতেহপুর কেজি উচ্চ বিদ্যালয়ে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখার পর তিনি ভর্তি হন সিলেট ক্যাডেট কলেজে। সজিত প্রাথমিকে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি লাভ করেন। অষ্টম শ্রেণি থেকে নবম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার সময় তিনি প্রথম স্থান লাভ করেন। সিলেট ক্যাডেট কলেজ থেকে মেধাতালিকায় দশম স্থান নিয়ে এসএসসি এবং ১১তম স্থান নিয়ে এইচএসসি পাস করেন সজিত। ২০০১ সালে জাপান সরকারের বৃত্তি নিয়ে দেশটিতে গিয়ে সেখানকার এশিয়া প্যাসিফিক ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন। পড়ালেখা শেষে জাপানের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে সজিত অধ্যাপনা শুরু করেন। এরই মধ্যে তিনি সেখানে এক জাপানি মেয়েকে বিয়ে করেন। তাঁর ঘরে রয়েছে তিন মেয়ে ও এক ছেলেসন্তান। স্ত্রীসহ ধর্মান্তরিত হওয়ার পর সজিত দেবনাথ তাঁর নাম পাল্টে রাখেন সাইফুল্লাহ ওজাকির। ধর্মান্তরিত হওয়ার পর থেকে পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ কমিয়ে দেন তিনি। পরিবারের সঙ্গে এ নিয়ে তাঁর মতবিরোধও দেখা দেয়। বছর দুয়েক পর পর তিনি একাই দেশে আসেন। একবার পরিবারকে নিয়েও আসেন বলে জানা গেছে। তবে গ্রামে আসেন একা। গ্রামে এলে খাওয়ার জন্য পানিও সঙ্গে নিয়ে আসতেন। ধর্মান্তরিত হওয়ার পর সাইফুল্লাহর স্ত্রী খুব পর্দানশিন হয়ে চলাফেরা করতেন বলে এলাকায় চাউর আছে। তবে কেউ তাঁর স্ত্রীর নাম নিশ্চিত করতে পারেনি।
পরিবারের লোকজন জানায়, ২০০৮ সালে একমাত্র বোনের বিয়ের সময় তিনি বাড়িতে আসেন। তখন তিনি মুখ কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখতেন। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলতেন, ‘মুখে ইনফেকশন হয়েছে।’
বিবিএতে সেরা হওয়ায় পুরস্কার পাওয়ার অনুষ্ঠান দেখতে ২০০৬ সালে বাবাকে জাপানে নিয়ে যান সজিত দেবনাথ। বাবা জনার্দন দেবনাথ সেখানে ২২ দিন অবস্থান করেন। প্রথম সন্তান মুসা জন্মলাভের সময় ২০০৯ সালে মাকে তিনি নিয়ে যান জাপানে। তবে মা অণিমা দেবনাথ সেখানে মাত্র তিন দিন অবস্থান করে ভালো না লাগার কথা বলে দেশে চলে আসেন।
পেশায় কাপড় ব্যবসায়ী জনার্দন দেবনাথ কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমার ছেলে ছিল খুব মেধাবী। জাপান যাওয়ার কয়েক বছর পর থেকেই সে পাল্টাতে থাকে। ধর্মান্তরিত ও বিয়ে করার পর তার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ কমে যায়। তবে সে বছর দুয়েক পর পর গ্রামে একাই আসত। সর্বশেষ বছরখানেক আগে এলাকার চেয়ারম্যানের বাড়িতে এলে আমরা সেখানে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করি। এর কিছুদিন পর থেকে তার সঙ্গে আমাদের কোনো যোগাযোগ নেই। সে কোথায় আছে সেটাও আমরা জানি না।’
মা অণিমা রানী দেবনাথ জানান, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে পুলিশ তদন্ত করতে এলে তখনই ছেলের সঙ্গে মোবাইল ফোনে তাঁদের সর্বশেষ যোগাযোগ হয়। তখন তিনি জানিয়েছিলেন, কোনো ধরনের সন্ত্রাসী ঘটনার সঙ্গে তিনি জড়িত নন। এর পর থেকে তাঁর মোবাইল ফোনটি বন্ধ রয়েছে। এ কারণে ওই সময় থেকে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। তিনি বলেন, ‘ছেলে ধর্মান্তরিত হওয়ায় তার বাবার রাগ ছিল। এ কারণে সে আমার সঙ্গে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করত। আমাদের সব সময়ের জন্য জাপানে নিয়ে যাওয়ার কথাও বলেছিল। আমি বিশ্বাস করি, আমার ছেলে কোনো সন্ত্রাসী কার্যক্রম কিংবা জঙ্গিবাদী কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত নয়।’
জিনদপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আব্দুর রউফ সাংবাদিকদের বলেন, ‘সজিত এলাকায় খুবই মেধাবী ও ভালো ছেলে হিসেবে পরিচিত ছিল। জাপানে গিয়ে সে বিয়ে করে এবং পরবর্তী সময়ে ধর্মান্তরিত হয় বলে জানতে পারি। মাঝেমধ্যে সে কিছু সময়ের জন্য গ্রামে আসত।’
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সহকারী পুলিশ সুপার (নবীনগর সার্কেল) মো. আলাউদ্দিন গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সাইফুল্লাহ ওজাকির ওরফে সজিতের বাড়ি নবীনগরে। সন্ত্রাস দমন আইনে ঢাকার উত্তরা থানায় হওয়া মামলায় আসামি হিসেবে নাম যাচাইয়ের জন্য একটি চিঠি এলে সত্যতা যাচাইয়ের পর তা ফেরত পাঠানো হয়। তবে কী ঘটনায় তাকে আসামি করা হয়েছিল তা আমাদের জানা নেই।’ সূত্র:: কালের কণ্ঠ