বিশ্বখ্যাত সুর সস্রাট উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর ১৫৮ তম জন্ম বার্ষিকী আজ
মিঠু সূত্রধর পলাশ,নবীনগর প্রতিনিধি: আজ ৮ অক্টোবর বিশ্ব খ্যাত সুর সস্রাট উস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁর ১৫৮ তম জন্ম বার্ষিকী। সুর-সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ১৮৬২ সালের ৮ অক্টোবর নবীনগর উপজেলার শিবপুরে এক সংগীত পরিবারে জন্ম গ্রহন করেন। ১৯৭২ সালের ৬ই সেপ্টেম্বর সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ ভারতের মাইহার রাজ্যে মদীনা ভবনে ১১০ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। আজ ১৫৮ তম জন্মদিনেও তার জন্মভূমি নবীনগরের শিবপুরে তার স্মৃতিকে ধরে রাখতে কোন উদ্যোগ বাস্তবায়িত হয়নি। হয়নি কোন অডিটরিয়াম, সংগীতের স্কুলসহ অন্যান্য স্থাপনা।
পাক-ভারত উপমহাদেশের শাস্ত্রীয় সঙ্গীতকে ক্ষণজন্মা এই শিল্পী নিজ সাধনাবলে বিশ্ববাসীর দরবারে মহিমান্বিত রূপে তুলে ধরেন। তাঁর জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আজ ৮ অক্টোবর আলাউদ্দিন খাঁ স্মৃতি সংসদ এর উদ্যেগে উপজেলা সম্মেলন কক্ষেআলোচনা সভা ও সংগীতানুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন ।
শ্রদ্ধা আর ভালোবাসায় সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’র ১৫৮ তম জন্ম বার্ষিক ও গত ৬ সেপ্টেম্বর ৪৮ তম মৃত্যু বার্ষিকী অনুষ্ঠিত হলেও সংরক্ষণের অভাবে ওস্তাদের নিজ জন্মভূমি নবীনগর উপজেলার শিবপুর গ্রামে তার নিজ হাতে গড়া মসজিদ ও পিতা-মাতার কবর ধরে রাখার জন্য নেই তেমন কোন উদ্যোগ। অন্যদিকে সংগীত বিদ্যালয়, পর্যটন কেন্দ্র, অতিথি শালা, মিলনায়তন গড়ে তুলার জন্য দানকৃত নিধার্রিত জায়গাটি বর্তমানে পরিত্যাক্ত অবস্থায় পড়ে আছে। মহান এই গুণীজনের জন্মভূমিতে তাঁর স্মৃতিকে লালন করার জন্য সরকারী বা বে-সরকারি পযার্য়ে কোন উদ্যোগ বাস্তবায়িত হয়নি। প্রতিবছর জন্ম ও মৃত্যু বার্ষিকী বা এছাড়াও অনেক নামি দামী গুণীজনদের পদচারণা হয়ে থাকলেও বাস্তবায়িত হচ্ছেনা কোন কিছুই।
১৯১৮ সালে তিনি ভারতের মাইহারে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।সংগীতে হাতেখড়ি বড় ভাই ফকির আফতাবউদ্দিন খাঁর কাছে। পাঠশালার গতানুগতিক পাঠ তাঁকে একটুও আকর্ষণ করেনি। সংগীতের প্রতি প্রগাঢ় ভালোবাসায় একসময় স্কুল, বাড়ি – সব ছেড়ে পালিয়ে যোগ দিলেন যাত্রা দলে, ঘুরতে লাগলেন গ্রাম থেকে গ্রামে। পরবর্তীকালে কলকাতায় প্রখ্যাত সংগীত সাধক গোপালকৃষ্ণের শিষ্যত্ব লাভের সুযোগ হয়। এই সংগীত গুরুর কাছে আলাউদ্দিন খাঁ সাত বছর সরগম সাধনা করেন। এরপর আকৃষ্ট হন যন্ত্র সংগীতে। এ সময় তাঁর দীক্ষাগুরু ছিলেন অমৃতলাল দত্ত। দীর্ঘ ও একাগ্র সাধনার ফলে ধীরে ধীরে তিনি সব ধরনের যন্ত্র সংগীতেই দক্ষ হয়ে ওঠেন। তার পরেও থেমে থাকে না তাঁর পথচলা। দীর্ঘ ত্রিশ বছর তালিম নেন ওস্তাদ ওয়াজির খাঁর কাছে। এ উপমহাদেশের রাগ সংগীতকে তিনিই প্রথম পাশ্চাত্যে পরিচিত করান। মেঘ-বাহার, আরাধনা, হেমন্ত, দুর্গেশ্বরী, প্রভাতকেলী, বেহাগ প্রভৃতি রাগ-রাগিনীর স্রষ্টা ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ বেশ কিছু বাদ্যযন্ত্র উদ্ভাবনেও পরামর্শক হিসেবে কাজ করেছেন। মূলত সরোদ বাদক হলেও ধ্রুপদী সংগীতের নানা ক্ষেত্রে তিনি এক অনুসরণীয় গুরু।
ব্রিটিশ সরকার তাঁকে ‘খাঁ সাহেব’ উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে ভারতের সঙ্গীত একাডেমি পুরস্কার পান। ১৯৫৪ খিষ্টাব্দে একাডেমির ফেলো নির্বাচিত হন। ১৯৫৮ খিস্টাব্দে ‘পদ্মভূষণ’ ও ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে ‘পদ্মবিভূষণ’এবং ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে তিনি বিশ্বভারতী কর্তৃক ‘দেশিকোত্তম’ উপাধিতে ভূষিত হন। ভারতের দিল্লি ও বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে আজীবন সদস্যপদ দান করেন। তিনি অসংখ্য গুণী শিষ্য রেখে গেছেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম পুত্র আলী আকবর খাঁ, জামাতা পন্ডিত রবিশংকর, কন্যা রওশন আরা ওরফে অন্নপুণ্যা , ভ্রাতুষ্পুত্র বাহাদুর খাঁ, তিমির বরণ, শ্যাম গাঙ্গুলী, নিখিল ব্যানার্জী, শরণ রাণী প্রমুখ।
ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’র পিতা সবদর হোসেন খাঁ এবং মাতা সুন্দরী খানম এর কবর দুটির পাকা করা হলেও চারদিকের সীমানা প্রাচীর করা হয়নি। অন্যদিকে ১৯১৯ সালে লক্ষাধিক টাকা ব্যায়ে ওস্তাদজ্বীর নিজ হাতে নির্মিত হয় সুদৃশ্য একটি মসজিদ। কারুকার্য মন্ডিত মসজিদটিতে ছোট-বড় ১৬টি মিনার আছে। মসজিদের পিছনে ঈদের নামাজের জন্য বড় পাকা মাঠ তৈরী করা হয়। অন্যদিকে ১৯৯১ সালে আলাউদ্দিন খাঁ’র দৌহিত্র মরহুম লাখু খাঁ সঙ্গীত বিদ্যালয়, পর্যটন কেন্দ্র, অতিথি শালা, মিলনায়তনে গড়ে তুলার জন্য তৎকালীন জেলা প্রশাসকের কাছে ২২.৫০ শতক জায়গা হস্তান্তর করেন। কিন্তু আজো তা বাস্তবায়িত হয়নি। আলাউদ্দিন খাঁর অনেক সম্পত্তি থাকলেও তা আজ কতিপয় ব্যাক্তির ভোগ দখলে। সরকার যদিও ৮০ দশকের গোড়ার দিকে সরকারী ভাবে ওস্তাদ আল্লাউদ্দিন খাঁ’র জন্মভূমিতে একটি সংগীত পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। পর্যটন কেন্দ্র বাস্তবায়নের জন্য সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় ৫ সদস্যের একটি কমিটিও গঠন করেছিল। কিন্তু আজ পর্যন্ত তা বাস্তবায়িত হয়নি। বর্তমানে সরকার ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’র স্মৃৃতি রক্ষার্থে বিষয়টি বাস্তবায়িত করার উদ্যোগ গ্রহণ করলেও এখনও আলোর মুখ দেখেনি বিভিন্ন আইনী জটিলতার কারণে। সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ’র পৈত্রিক সম্পত্তি জালিয়াতি করে নাল, ভিটি, পুকুর শ্রেণীর ৫০৫ শতক জমি নামমাত্র অর্থে বিক্রির অভিযোগ পাওয়া গেছে।
সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক শামীম আহমেদ বলেন- সুর সম্রাট এর স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য তার জন্মভূমি শিবপুরে কোনো উদ্যোগই সরকারি-বেসরকারি ভাবে গড়ে ওঠেনি। আমি সরকারের কাছে অনুরোধ রাখব সুর সম্রাটের স্মৃতি এবং তাকে নিয়ে নতুন প্রজন্ম যাতে জানতে পারে সেইজন্য শিবপুরে কিছু উদ্যোগ নেওয়ার জন্য।
এ ব্যাপারে সুর সম্রাট ওস্তাদ আলাউদ্দিন খাঁ স্মৃতি সংসদের সভাপতি শামীম রানা রতন বলেন – সুরসম্রাটের জন্মবার্ষিকী নবীনগর সদর উপজেলা পরিষদে পালন করব এখানে আলোচনা সভা এবং সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে সুর সম্রাট এর স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য সরকারিভাবে শিবপুর একটি অডিটোরিয়াম সহ বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য আমি জোর দাবি জানাচ্ছি।