আলোর ফেরিওয়ালা স্বপন মিয়া



মিঠু সূত্রধর পলাশ,নবীনগর প্রতিনিধি: নিজেকে বই মজুর পরিচয় দিতেই ভালোবাসেন স্বপন মিয়া। সারা জীবন বইয়ের জন্যে কামলা খাটতে চান। এলাকায় ঘুরে ঘুরে বই সংগ্রহ, পাঠকের কাছে পৌঁছে দেয়া, সপ্তাহ শেষে ফেরত আনা। এই মজুরিটাই পছন্দ তার।
পরিবারের চরম দূরাবস্থা। নুন আনতে পানতা ফুরায়। নিয়মিত খাবার সংস্থান নেই। পড়াশুনার তো উপায়ও নেই। মাথাগুজার ঠাঁই নেই। এমনি অবস্থাতেও একটি পাঠাগার গড়ে তোলার স্বপ্ন বাসা বাধে স্বপনের মনে। ১৪ বছরে নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে স্বপনের পাঠাগার ‘গুঞ্জন’ এখন মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। ছড়াচ্ছে আলো। শিক্ষার্থীদের অনেকের জ্ঞান আহরনে সহায়ক হয়ে উঠেছে পাঠাগার। বই পাঠ ছাড়াও পাঠাগারটির রয়েছে সাপ্তাহিক পাঠচক্র, মাসিক পরীক্ষা, ষান্মানিক পরীক্ষা, দারিদ্র ও মেধাবী সম্মাননা ও শিক্ষা সামগ্রী প্রদান কার্যক্রম। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শিক্ষার্থীদের নিয়ে ক্যারিয়ার আড্ডা, বৃক্ষরোপণ, পিঠা উৎসব, ঘুড়ি উৎসব, কম্পিউটা প্রশিক্ষণসহ নানা কাজ হচ্ছে গুঞ্জনের ব্যানারে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের পৌর এলাকার সুহাতা গ্রামের এক দরিদ্র ঘরের সন্তান স্বপন। অভাব-অনটনে জর্জরিত পরিবারের এই যুবক পাঠাগার গড়ার যুদ্ধে জয়ী হয়ে এখন আলোচনায়।
মাত্র তিনটি বই আর একটি বাঁশের থাক (রেক) দিয়ে ২০০৪ সালের ৩০ মার্চ যাত্রা শুরু করে স্বপনের ‘গুঞ্জন পাঠাগার’। এরজন্যে ঋণ করতে হয় ৮ হাজার টাকা। প্রায় ১৫ বছরে এই পাঠাগার এখন প্রতিষ্ঠিত। বর্তমানে চার হাজারের অধিক বই রয়েছে। এক চালা, দু’চালা থেকে পেরিয়ে সুসজ্জিত দ্বি-তল ভবনে প্রবেশের অপেক্ষায় ‘গুঞ্জন পাঠাগার’। শুরুর গল্প বলতে গিয়ে স্বপন জানান, ছোট বেলাতে বই পড়ার প্রবল ইচ্ছে ছিলো তার। কিন্তু পড়ার জন্যে বই পেতেননা। বই কিনতে পারতেননা। অন্যের কাছ থেকে বই এনে পড়তেন। স্বপন বলেন, তখন মনে হয়েছে আমার মতো অনেক গরীব মানুষ আছে যারা আমার মতো বই পড়তে পারেননা। সেই চিন্তা থেকেই পাঠাগার গড়ার পথে যাত্রা শুরু করি।
মাত্র দেড় বছর বয়সে বাবাকে হারান স্বপন। তার পিতা হারুন মিয়া ছিলেন গবাদী পশু চিকিৎসক। তার মৃত্যুর পর তিন সন্তানকে নিয়ে অকূল সাগরে পরেন মা রাজিয়া খাতুন। তাদের লালন-পালনে রাস্তার মাটি কাটার শুরু করেন রাজিয়া। সংসারের অভাব মেটাতে স্বপনের বড় দুই ভাই রিক্সা চালাতে শুরু করেন। এমনি বাস্তবতাতেও স্বপন বিভোর তার স্বপ্ন বাস্তবায়নে।
প্রথমে এলাকায় ঘুরে ঘুরে বই সংগ্রহ করতে শুরু করেন। এরপর তা পাঠকের নিকট পৌঁছানো, সপ্তাহ শেষে ফেরত আনা-এসব কাজ করতে থাকেন । কারো নিরুৎসাহে, কারো সমালোচনায় গোপনে গোপনে চলতে থাকে স্বপনের এই কাজ । ‘ভাই রিক্সা চালায়, হে করে পাঠাগার! এমন তীর্যক মন্তব্য শুনতে হয়েছে তাকে অনেক। স্বপন জানান, পাঠাগারের জন্য ২০০৭ সালে ভেঙ্গে যায় পরিবার। পৃথক হন দুই ভাই। মা, খালা, নানীসহ ছয় জনের দায়িত্ব পড়ে তার কাঁধে। অর্থাভাবে দুইবার ঝরে পড়া স্বপন তখন উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে এস.এস.সি. পরীক্ষার্থী। টিউশন থেকে আয় দেড় হাজার টাকায় পরিবারের ভরন পোষনের পাশাপাশি চলে লেখাপড়া ও পাঠাগার। জীবিকার তাগিদে দিন মজুর, মাইকিং ক্যাম্পাস, হকারের কাজও করেছেন স্বপন। তবুও দমে যাননি। ২০০৯ সালে পাঠাগারটি দু’চালা করে দেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদুল ইসলাম মজুমদার। চলতি বছরে নবীনগর পৌর মেয়র মাঈনুদ্দিন মঈন’র উদ্যোগে শুরু হয়েছে পাঠাগারটির দ্বিতল ভবনের কাজ।
এখনো স্বেচ্ছাশ্রমে পাঠকের হাতে বই পৌছান স্বপন। কেউ কিছু দিতে চাইলে পাঠাগারের জন্য বই চেয়ে নেন। স্বপন জানান, প্রথমে অনেকে নিরুহসাহিত ও অবহেলা করলেও সবাই এখন পাঠাগারমুখী। প্রতিদিন বিকাল তিনটা থেকে ছয়টা পর্যন্ত চলে পাঠাগারের কর্ম। পাঠকের আনাগুনায় কলবর হয়ে উঠে পাঠাগার। শুক্রবার সাপ্তহিক পাঠচক্র ও ছুটির দিনে পাঠক সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। পাঠচক্রের এখন অনেকই পড়ছেন দেশসেরা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। পাঠক পল্লব এখন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র। পঞ্চম পাঠচক্রের এ সদস্য বলেন ‘পাঠাগারই প্রথম আমাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বপ্ন দেখায়। নাট্য ব্যক্তিত্ব আলী যাকের, সাবেক সচিব ও রাষ্ট্রদূত হুমায়ূন কবিরের মতো বরেণ্য অনেক মানুষ এসেছেন এই পাঠাগারে। নবীনগর সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবু মোছা বলেন, এই অবক্ষয়ের যুগে স্বপনের এ উদ্যোগ তরুণদের জন্য উদাহরণ। পাঠাগারে পাঠক মেডিকেলের ছাত্র সাদ্দাম হোসেন বলেন, পাঠাগারটি হওয়ায় বদলে যাচ্ছে আমাদের ও আশপাশের গ্রাম। শিক্ষা বিপ্লব চলছে পাঠাগারটির মাধ্যমে।
পাঠাগারের ভূমিদাতা স্বপনের মা রাজিয়া খাতুন বলেন, স্বপন অনেক কষ্টে করেছে পাঠাগারের জন্য। নাট্যব্যক্তিত্ব আলী যাকের বলেন, টিউশনীর টাকায় সংসার চালিয়ে পাঠাগার চালানো এটা বিরল ঘটনা। পৌর মেয়র মোহাম্মদ মাঈন উদ্দিন বলেন, স্বপনের মাধ্যমে পুরো এলাকা এখন আলোর মিছিল। এ মহতী উদ্যোগে অংশীদার থাকতে চাই’।
পাঠাগার প্রতিষ্ঠাতা স্বপন মিয়া বলেন, মায়ের পরে পাঠাগার আমার প্রথম ভালোবাসা। বিশ্বাস করি পৃথিবীকে বদলে দিতে পরমাণু যুদ্ধ নয়, জ্ঞান যুদ্ধ দরকার। পাঠাগারের মাধ্যমে সারা বিশ্বে জ্ঞান যুদ্ধ ছড়িয়ে দিতে চাই। উন্মুক্ত থেকে এস. এস. সি. ও এইচ. এস. সি. সম্পন্ন করা স্বপন ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজ থেকে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে বাংলায় অনার্স ও মাস্টার্স সম্পন্ন করেছেন। লেখালেখিতেও সুনাম কুড়িয়েছে স্বপন। ইতিমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর লেখা ও সম্পাদিত সাতটি গ্রন্থ।