উত্তাল সহিংসতার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার, এক ঘটনার নানা গল্প
খালেদ মোশাররফ আর রনি আহম্মেদ। একজন মাদরাসা ছাত্র অন্যজন ব্যবসায়ী। এ দু-জনের বিরোধে জল গড়িয়েছে অনেক দূর। মেলা গল্প হয়েছে এক ঘটনার। জেলা পরিষদ মার্কেটে সেদিন একটি ঘটনা ঘটেছিল। যাকে কেন্দ্র করেই অশান্তির আগুন ছড়িয়ে পরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। মার্কেটের দোকানির সঙ্গে মাদরাসা ছাত্রের বিরোধ কি কারণে হয়েছিল তা নিয়ে কয়েক রকম বক্তব্য চলছে। কোনো কারণ ছাড়াই দোকানিরা মাদরাসা ছাত্রের ওপর হামলা চালিয়েছিল বলে অভিযোগ করছেন মাদরাসা কর্তৃপক্ষ। পরে মার্কেটে গিয়ে হামলা-ভাঙচুরের দায় তারা স্বীকার করছেন না। দু-দিনের ঘটনার সূত্রপাত হয় ১১ই জানুয়ারি বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে জেলা পরিষদ মার্কেটের সামনে। ঘটনার পরপর সাংবাদিকরা সেখানে গিয়ে জানতে পারেন- অটোরিকশার ভাড়া নিয়ে এক চালকের সঙ্গে মাদরাসা ছাত্রের বচসা হয়। এর জের ধরে মার্কেটে হামলা চালিয়ে দোকান ভাঙচুর করা হয়। মারধর করা হয় ঘটনার সূত্রপাত যার সঙ্গে সেই রনিসহ আরও ৫ ব্যবসায়ীকে। এরপরই মাদরাসার ছাত্রদের সঙ্গে তাদের ধাওয়া পালটা-ধাওয়া হয়। একপর্যায়ে ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি ছাত্রলীগ-যুবলীগও এ ঘটনায় জড়িত হয়। পুলিশও তাদের পক্ষ নেয়।
ঘটনার পরপর বিজয় টেলিকমের মালিক রনি আহম্মেদ সাংবাদিকদের জানান- মাদরাসার ছাত্ররা এক মুরব্বি অটোড্রাইভারকে মারধর করছিল। “তহন আমি ও হাদিস ভাই দোকান থেকে বের হয়ে মারধর থেকে বাঁচাই। তখন সে বারবার মোবাইল টিপতে থাকে। বলে তার টিম লইয়া আইতাছে। নিজের পরিচয় দেই, হে বলে কিয়ের সেক্রেটারি। আমি তহন বলি তুই যা। এরপর তর্ক করতে থাকে। আমি বেয়াদব বলে বকা দিই। এরপর সে চলে যায়। ২ ঘণ্টা পর দু-আড়াইশো মাদরাসা ছাত্র লইয়া আমার দোকান ভাঙচুর করছে। আমারে যারা বাঁচাইতে গেছে তারাও মার খাইছে। তবে জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদরাসায় মাস্টার্স শেষ পর্বে অধ্যয়নরত খালেদ মোশাররফ বলেছেন- তার ওপর পরিকল্পিত হামলা হয়েছে। নাসিরনগরে মাদরাসা বন্ধ করে দেয়ার প্রতিবাদে দু-দিন ধরে কাওমি ছাত্র ঐক্যপরিষদ আন্দোলন করছিল। সাধারণ সম্পাদক হওয়ায় সে এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সে কারণে তার প্রতি ক্ষোভ-আক্রোশ থেকে হামলা চালানো হয়। তিনি ঘটনার বর্ণনায় জানান- ১১ই জানুয়ারি মিছিল করার পর প্রেসবিজ্ঞপ্তি নিয়ে বিকালে কাউতলী যাচ্ছিলেন। সেখানে অপেক্ষায় থাকা তার এক ভাইকে নিয়ে সাংবাদিকদের কাছে যাওয়ার কথা ছিল। ফ্লাইওভারের কাজ চলার কারণে তিনি অটো থেকে জেলা পরিষদের সামনে নামেন। ঐ অটোতে আরও ২ জন হুজুর ছিলেন। ভাড়া নিয়ে চালকের সঙ্গে তাদের কথাকাটাকাটি হচ্ছিল। আমি ভাড়া মিটিয়ে যাওয়ার মুহূর্তে পেছন থেকে তারা আমার ওপর হামলা করে। এ সময় বলতে থাকে কার বিরুদ্ধে আন্দোলন করস, কি করস বুঝছ না। আরও বলে হেরে ধর, পুলিশে দিমু, জেএমবি’র মামলা দিমু। রাইফেল বের কর এসব বলতে থাকে। এরপর আমি দৌড়ে চলে আসি। পরে এ নিয়ে আমরা ছোটখাটো একটা মিছিল করি। যেহেতু আমার ওপর হামলা হয়েছে তখন ছাত্ররা হামলায় জড়িত রনিকে সামনে পেলে তার সঙ্গে হাতাহাতিতে লিপ্ত হয়। আমার ওপর হামলার সময় আমি রনিকে চিনতে পেরেছিলাম। পরে এটাকে কেন্দ্র করে জয়বাংলা স্লোগান দিয়ে তারা মাদরাসায় হামলা করে।
ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী আবুল মিয়া বলেন- হুজুর ও অটো ড্রাইভারের মধ্যে তর্কবিতর্ক হয়। দোকানের মালিক দাঁড়ানো ছিলো। তখন সে এগিয়ে গিয়ে বলে আপনি হুজুর মানুষ ৫ টাকা ভাড়া নিয়া তর্কবিতর্ক করতে যান কেন। তৃতীয়পক্ষ হিসেবে সেখানে গিয়ে হুজুরকে ধাক্কা দিয়ে সরাইয়া দেয়। তখন হুজুর আমি তোরে দেহামু বলে চলে যায়। এটুকুই আমি দেখেছি। গত ১৫ই জানুয়ারি জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদরাসা কর্তৃপক্ষের সংবাদ সম্মেলনে এ ঘটনার বিষয়ে তাদের লিখিত বক্তব্যে বলা হয়- নাসিরনগরে হজরত শাহজালাল (র.) মসজিদ ও কওমি মাদরাসা কমপ্লেক্স নির্মাণ কাজ স্থানীয় মন্ত্রী সায়েদুল হক বন্ধ করে দেয়ার প্রতিবাদে গত ১০ ও ১১ই জানুয়ারি কওমি ছাত্র ঐক্যপরিষদের উদ্যোগে জেলা জুড়ে প্রতিবাদ মিছিল-সমাবেশ হয়। ১১ই জানুয়ারি কওমি ছাত্র ঐক্যপরিষদের সেক্রেটারি মিছিল-সমাবেশের নিউজ নিয়ে কাউতলী যাওয়ার পথে ফ্লাইওভারের কাজের জন্য জেলা পরিষদের সামনে ভাড়া পরিশোধ করে ইজিবাঈক থেকে নেমে পড়ে। তখন অতর্কিতে বিজয় টেলিকমের মালিক রনিসহ আরও দুইজন অজ্ঞাত দুষ্কৃতকারী তার ওপর হামলা চালায়। তাকে গালাগাল করে। এই খবরটি কওমি ছাত্র ঐক্যপরিষদের কাছে এলে তারা বিচারের দাবিতে জেলা পরিষদে যায়। সেখানে কথাকাটাকাটির একপর্যায়ে উভয়পক্ষের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। ঘটনা শেষে তারা নিজ প্রতিষ্ঠানে চলে আসে এবং পড়ালেখায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আর মাদরাসা কর্তৃপক্ষ মাদরাসার মূল ফটক তালা দিয়ে দেয়। সদর মডেল থানা পুলিশের এক মামলার (মামলা নং-৩৬, তারিখ-১২.০১.১৬ ইং) এজাহাজারে এ ঘটনার বিষয়ে বলা হয়- ‘১১/০১/২০১৬ ইং তারিখ ১৮.৩০ ঘটিকার সময় (সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার) কান্দিপাড়া জামিয়া ইউনুছিয়া মাদরাসার এক ছাত্র জেলা পরিষদ মার্কেটের বিজয় টেলিকমে মোবাইল মেরামত করার জন্য দেয়। মোবাইল মেরামত শেষে ওই ছাত্র মোবাইলটি নেয়ার পর সম্পূর্ণ ঠিক হয়নি মর্মে দোকান মালিক শিমরাইলকান্দির সেলিম আহম্মেদের ছেলে রনি আহম্মেদকে বললে সে তাকে মোবাইল ঠিক করিয়া দিতে পারবে না বলিয়া দোকান থেকে বাহির করিয়া দেয়। উল্লিখিত ঘটনাটি মাদরাসার ছাত্র কান্দিপাড়া মাদরাসায় আসিয়া অন্যান্য ছাত্রদের জানাইলে উক্ত মাদরাসার ছাত্র-শিক্ষকগণ জেলা পরিষদ মার্কেটের ওই দোকানে গিয়া দোকানে আক্রমণ ও রনিকে মারধর করে। বিষয়টি জেলা পরিষদের ব্যবসায়ী ও মাদরাসা কর্তৃপক্ষের মধ্যে জানাজানি হইলে উত্তেজনার সৃষ্টি হয়”।
ঘটনার ৫ দিন পর জেলা পরিষদ মার্কেট ব্যবসায়ীবৃন্দ এ বিষয়ে একটি সংবাদ সম্মেলন করে। তারা লিখিত বক্তব্যে বলেন- গত ১১ই জানুয়ারি সন্ধ্যার পর কতিপয় উচ্ছৃঙ্খল মাদরাসা ছাত্র অতর্কিতে টিএরোডস্থ জেলা পরিষদ মার্কেটে সশস্ত্র হামলা করে দোকানপাট ভাঙচুর ও ব্যবসায়ীদের প্রচণ্ডভাবে মারধর করে। ঘটনার বর্ণনায় বলা হয় আনুমানিক বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে ২ জন মাদরাসা ছাত্র একটি অটোরিকশা করে মাদরাসার সামনে আসে। তারা অতিশয় বয়স্ক অটোচালকের সঙ্গে তর্কাতর্কির একপর্যায়ে মারধর করতে উদ্ধত হয়। এই অবস্থায় রনি আহমেদসহ উপস্থিত পথচারীগণ ঘটনাটি মিটমাট করতে চাইলে ছাত্ররা তাদের সাথে উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করে। ঘটনাটি ক্ষুদ্র হওয়ায় তখন মার্কেটের অন্য ব্যবসায়ীদের নজরে আসেনি। পরে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টার দিকে ২/৩শ’ মাদরাসাছাত্র অতর্কিতে বিজয় টেলিকমে হামলা করে। তারা দোকান মালিক রনি আহমেদকে টেনেহিঁচড়ে ক্যাশ কাউন্টার থেকে বের করে রাস্তায় ফেলে বেদম মারধর করে। আসবাবপত্র ভাঙচুর করে দোকানের ব্যাপক ক্ষতি করে। দোকানের সুকেস থেকে আনুমানিক ৫ লাখ টাকার মোবাইল সামগ্রী ও নগদ ৪৫ হাজার টাকা ছিনিয়ে নেয়। এ সময় রনিকে বাঁচাতে এসে আরও কয়েকজন ব্যবসায়ী হামলার শিকার হয়। খবর পেয়ে পুলিশ ফোর্স সেখানে এলে পুলিশের সহায়তায় রনিকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে পাঠানো হয়। মার্কেট কমিটির সভাপতি ও পৌর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মো. জামাল খান বলেন- মোবাইল কেনাবেচা নিয়ে কোনো ঘটনা ঘটেনি। আমি ঘটনার সময় এক অনুষ্ঠানে ছিলাম। সেখান থেকে খবর পেয়ে ২০/২৫ মিনিট পরে এসে দেখি এই অবস্থা। মার্কেটের সাধারণ সম্পাদক আতাউর রহমান শাহিন বলেন- ছাত্ররা কোনো কিছু বুঝার আগেই মার্কেটে হামলা হয়। এ ঘটনায় আমাদের ৫ ব্যবসায়ী আহত হন। তারা হচ্ছেন রনি আহমেদ, আমান টেলিকমের আমান, এসবি টেলিকমের রিফাত মিয়া, ইউসুফ ও পার্থ রায়। বুধবার রাতে জমিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদরাসায় হেফাজতে ইসলামের মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরী সাংবাদিকদের বলেন- কওমি মাদরাসা ওয়ালারা সবসময়ই শান্তির পক্ষে। তারা ভাঙচুরে বিশ্বাস করে না। বাইরে কত কিছুই হবে। দোকানদারের সঙ্গে, কাস্টমার এর সঙ্গে বিরোধ হবে, কিন্তু যেখানে হবে সেখানেই এর সমাধান করতে হবে। এটাকে কেন্দ্র করে দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হামলা চালানো হবে কেন ?
সংবাদ সূত্র :: মানবজমিন