তিন পুরুষ বাসের পরও ব্রিটেন ছাড়তে হচ্ছে এক বাংলাদেশিকে
সৈয়দ আনাস পাশা :: চার বছর বয়সে মা-বাবার সঙ্গে তার ব্রিটেনে আসা। দাদা-দাদী, বাবা-চাচা, ফুফুসহ বৃহত্তর পরিবারের প্রায় সবারই বসবাস ব্রিটেনে অনেক আগ থেকেই।
কিন্তু পরিবারের তিন প্রজন্মের ধারাবাহিক বসবাস সত্ত্বেও ২৯ বছর বয়সী এক বাংলাদেশি যুবককে ব্রিটেন ছাড়তে হচ্ছে।
ষাটের দশকের মধ্যভাগ থেকে ব্রিটেনে বসবাস করেও মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ছেলেটির বাবা বাংলাদেশকে হৃদয়ে এমনভাবে ধারণ করতেন যে, নিজের বা সন্তানদের ব্রিটিশ সিটিজেনশীপ গ্রহণে বরাবরই অনাগ্রহ ছিল তার।
ব্রিটিশ ও বাংলাদেশের অর্থনীতির সমৃদ্ধিতেও এই পরিবারের রয়েছে বিরাট অবদান। ছেলেটির বাবাই শুধু নন, তার দাদাও ছিলেন নিজ জন্মভূমি প্রেমিক। অবসর জীবনে চলে যাওয়ার পর বাংলাদেশে গিয়ে নিজের পাসপোর্টটি তিনি ছিঁড়ে ফেলেছিলেন এই ভয়ে যে, ছেলেরা যদি আবার তাকে ব্রিটেন ফিরিয়ে নিতে চায়। নিজ জন্মভূমি প্রেমিক হলেও ব্রিটিশ অর্থনীতির সমৃদ্ধিতে ছেলেটির দাদা ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। ব্রিটিশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল রেভ্যুলিউশনকে সফলতার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যেতে তিনি তার পায়ের কয়েকটি আঙ্গুল পর্যন্ত বিসর্জন দিয়েছিলেন। ফ্যাক্টরি ওয়ার্কার এই বাংলাদেশি কর্মরত থাকা অবস্থায় দুর্ঘটনা কবলিত হয়ে তার পায়ের তিনটি আঙ্গুল হারিয়েছিলেন। ব্রিটিশ সোসাইটির উন্নয়নে এত অবদান রাখা এই বংশেরই তৃতীয় প্রজন্ম একটি ছেলেকে এখন দেশ থেকে বের করে দিচ্ছে ব্রিটিশ হোম অফিস।
পরিবারের অনুরোধে লন্ডনের কোন এক শহরের কারাগারে ৮ বছরের সাজা ভোগরত ছেলেটির নাম-পরিচয় এই প্রতিবেদনে উল্লেখ করা যাচ্ছে না। পাঠকের সুবিধার্থে ছদ্মনাম ‘অসহায়’ ব্যবহার করেই প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন প্রতিবেদক। সহজ সরল এই যুবকটির সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে এই প্রতিবেদকও পরিচিত। ৮ বছরের সাজাপ্রাপ্ত ‘অসহায়’র সাজার মেয়াদ চলতি বছরের আগস্টে শেষ হলেও, সাজা শেষের আনন্দ নেই তার বিধবা মা বা বোনদের মধ্যে। কারণ সাজা শেষেই ‘অসহায়’কে বাংলাদেশে ফেরৎ চলে যেতে হবে, আদালত এমনই রায় দিয়েছেন।
বাংলাদেশের কোন এক প্রান্তিক জেলায় ‘অসহায়’র পূর্বপুরুষের বসবাস। পঞ্চাশের দশকের শেষ দিকে তার দাদা প্রথম ব্রিটেন আসেন। এরপর একে একে দাদি, বাবা, চাচা ও ফুফুসহ সবাই। ব্রিটেনেই এখন ‘অসহায়’-এর বিশাল পরিবারের (বৃহত্তর) বসবাস। ১৯৮৯ সালে চার বছর বয়সে মায়ের সঙ্গে তার প্রথম ব্রিটেন আসা। এরপর থেকেই হাঁটি হাঁটি পা পা করে ২৯ বছরে পদার্পন। কৈশোর থেকে যৌবনে পদার্পনের ক্ষণে ‘অসহায়’ জড়িয়ে পড়েছিলো কিছু বখে যাওয়া ছেলের সঙ্গে। যার পরিণতি আজ ভোগ করছে সে। ৮ বছরের শাস্তি নিয়ে কারাগারে যাওয়ার কিছুদিন পরই একমাত্র ছেলের চিন্তায় রোগ-শোকে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করেন ‘অসহায়’র বাবা। সেই থেকে বিধবা মা ই নিয়মিত খোঁজ খবর রাখছেন কারাগারে অন্তরীণ ছেলের।
সাজা শেষে একমাত্র ছেলেকে সবাইকে ছেড়ে দেশে ফিরে যেতে হবে, এই চিন্তায় মাও এখন অনেকটা শয্যাশায়ী। ৪ বছর বয়সে ব্রিটেনে আসা ‘অসহায়’ ভালো করে বাংলাও বলতে পারেনা। এমনি অবস্থায় ছেলেকে নিয়ে দু:চিন্তায় নির্ঘুম রাত কাটছে ‘অসহায়’র মায়ের।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি এ প্রতিবেদককে বলেন, যে ঘটনায় আমার ছেলেকে শাস্তিভোগ শেষে দেশে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে, সেই ঘটনায় সে জড়িত ছিল না। একটি পাকিস্তানি ছেলে আরেকটি বাংলাদেশি ছেলেকে মারধর করলে এর প্রতিশোধ হিসেবে বাংলাদেশি ছেলেটি আরেকদিন ওই পাকিস্তানি ছেলেটিকে বাগে পেয়ে তার বাসায় ধরে এনে আটকে রেখে মারধর করে। ওই বাংলাদেশি ছেলেটির সঙ্গে আমার ছেলের ছিল বন্ধুত্ব। পাকিস্তানি ছেলেটিকে আটকে রেখে বাংলাদেশি ছেলেটি আমার ছেলে ও তার আরেক বন্ধুকে ফোনে তার বাসায় যাওয়ায় অনুরোধ করলে তারা ওই বাংলাদেশি ছেলেটির বাসায় যায়। আর এর কিছুক্ষণ পরই পুলিশ অভিযান চালায় ওই বাসায়।
তিনি বলেন, আসল বাংলাদেশি ছেলেটি পালিয়ে যেতে সক্ষম হলেও বন্ধুসহ আমার ছেলেটি গ্রেফতার হয় পুলিশের হাতে। এরপর পাকিস্তানি ছেলে অপহরণের সব দোষ ঘাড়ে চাপে আমার ছেলে ও তার বন্ধুর উপর। ‘অসহায়’র মা বলেন, এর আগে কিছু বখে যাওয়া ছেলের হাতে ব্যবহৃত হয়ে আমার ছেলেটি আরও এক বছর জেল খেটেছিল। ওইসময় আদালত তাকে ওই ছেলের সঙ্গে আর কখনও মেলামেশার বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দেন।
তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ওই অপকর্মের মূল কারিগররা আজ মুক্তভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে, আর আমার সহজ সরল ছেলেটি শুধু শাস্তি ভোগই করেনি, তাকে দেশেও ফিরে যেতে হচ্ছে’।
বাঙালি গ্রামীণ বিধবা গৃহবধু মা জানান, ছেলের এসব মামলা পরিচালনায় যথেষ্ট বেগ পেতে হচ্ছে তাকে।
কোন একজন সলিসিটর ২ হাজার পাউন্ড অগ্রিম নিয়ে কোন কাজ না করেই এই অর্থ খরচের একটি রিসিট তাঁর হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন এমন অভিযোগও করেন তিনি এই প্রতিবেদকের কাছে।
এই মামলা পরিচালনায় কোন লিগ্যাল এইড পান কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে কিছুই বলতে পারেননি অসহায়ের মা।
তিনি বলেন, এই লিগ্যাল এইডটি কি আমি তো তা জানিনা।
তিনি বলেন, ছেলেটি আমার ভালো করে বাংলাও বলতে পারে না। দেশে একসাথে বসবাস করবে এমন আপন কেউও নেই। এমতাবস্থায় ছেলেটিকে বাংলাদেশে ফেরৎ পাঠানো যে কতটুকু অমানবিক ব্রিটিশ হোম অফিসকে কে বুঝাবে সেটা।
ছেলেকে ব্রিটেনে রাখার শেষ চেষ্টা তিনি এখনও করে যাচ্ছেন- এমনটি জানিয়ে অসহায়ের মা বলেন, ছেলে আমার হাল ছেড়ে দিয়েছে, বলেছে যা হবার হবে আমি দেশেই চলে যাবো।
ছেলেকে নিজের কাছে রাখার এই সংগ্রামে মানবাধিকার সংগঠন, আইনজীবী ও কমিউনিটির সহযোগিতা চেয়েছেন ‘অসহায়’ এর মা।
‘অসহায়’কে বাংলাদেশে ফেরৎ পাঠানোর বিষয়ে জয়েন্ট কাউন্সিল ফর দ্যা ওয়েলফেয়ার অব ইমিগ্রেন্টস (জে সি ডব্লিউ আই) এর চিফ এক্সিকিউটিভ হাবিব রহমানের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বিষয়টিকে অমানবিক বলে মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, ব্রিটিশ ডিপোর্টেশন আইন অনুযায়ী ব্রিটেন থেকে বের করে দেয়ার এধরনের রায় আদালত অবশ্যই দিতে পারেন। তবে মানবিক দৃষ্টিতে এটি কতটুকু সঠিক এবিষয়টি আমাদের বিবেচনা করা উচিত।
হাবিব রহমান বলেন, অপরাধের শাস্তি ও শাস্তি পরবর্তী পুনর্বাসন গণতান্ত্রিক সমাজের একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তাই বলে এক অপরাধে দুই শাস্তি কোনভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। একটি অপরাধে ৮ বছর শাস্তি ভোগের পর একজন অপরাধী যখন বেরিয়ে আসে তখন আর সে অপরাধী থাকে না। সমাজে নতুন করে তাকে পুনর্বাসনে সহযোগিতা করা তখন রাষ্ট্রের দায়িত্ব হয়ে ওঠে। এই দায়িত্ব পালন না করে নতুন করে আবার আরেকটি শাস্তি দিয়ে তাকে দেশ থেকে বের করে দেয়া আধুনিক সমাজে কোনভাবেই গ্রহনযোগ্য হতে পারে না।
তিনি বলেন, এটি অমানবিক, বৈষম্য।
ব্রিটিশ ডিপোর্টেশন আইনে গুরুতর অপরাধে সাজাপ্রাপ্ত বিদেশি অপরাধীদের সাজা ভোগ শেষে নিজ নিজ দেশে ফেরৎ পাঠানোর বিধান রয়েছে। ‘অসহায়’ এর মত ফেঁসে যাওয়া সহজ সরল যুবকরা এই বিধানকে নিজেদের নিয়তি হিসেবে মেনে নেয়ার চেষ্টা করলেও ইউরোপীয়ান কনভেনশন অব হিউম্যান রাইটস এর আর্টিক্যাল-৮ এর সুযোগে ‘অসহায়’ এর চেয়েও ভয়ঙ্কর অপরাধীদের অনেকেই শাস্তি ভোগের পর ব্রিটেনে থেকে যাচ্ছে। স্বয়ং ব্রিটিশ হোম সেক্রেটারি তেরেসা মে’ই গত বছর ডিপোর্টেশন নাকচ করে দেয়া এক আদালত রায়ের সমালোচনা করে মন্তব্য করেছিলেন, ‘দ্যা রাইট টু এ ফ্যামিলি লাইফ আন্ডার আর্টিক্যাল ৮ মাস্ট বি বেলেন্সড বাই দ্যা নিড টু প্রটেক্ট দ্যা পাবলিক ফ্রম ডেন্জারাস ক্রিমিনাল।
তিনি ওই রায়ের সমালোচনা করে আরও বলেছিলেন, কোন কোন বিচারকের এ ধরনের রায় গ্রহণযোগ্য নয়। আমি বলতে চাই, ব্রিটিশ জনগণের নিরাপত্তার স্বার্থে আমাদের ডিপোর্টেশন আইনের প্রতি যদি বিচারকরা মনযোগ না দেন তাহলে অপরাধীদের জোর করে বের করে দেয়ার বিষয়ে আমরা নতুন আইন তৈরি করার কথা ভাববো। বিপদজনক বিদেশি অপরাধীদের বের করে দিতে আর্টিক্যাল ৮ আমাদের থামাতে পারবে না, এবিষয়ে আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।
অবশ্য অপরাধীদের বহিস্কার বিষয়ে যতই শক্ত আইন বা দৃঢ়তা থাকুক ব্রিটিশ হোম অফিসের, ‘ব্রিটেন অপরাধীদের স্বর্গরাজ্য’ এমন মন্তব্য প্রায়ই শোনা যায় অনেকের মুখে। আন্তর্জাতিক গণহত্যা থেকে শুরু করে বিভিন্ন ধরনের অপরাধে জড়িতরা বছরের পর বছর ধরে বসবাস করছে ব্রিটেনে। বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বহু অপরাধী অবাধে চলাফেরা করছে এই দেশে। শুধু বসবাসই নয়, ব্রিটিশ সরকারের ওয়েলফেয়ার সিস্টেমের পুরো সুযোগও গ্রহণ করছে এসব অপরাধী। এসব অপরাধীর মধ্যে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী, গণহত্যায় জড়িত সন্ত্রাসী ও যুদ্ধাপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত অপরাধীও রয়েছে।
সরকারি এক পরিসংখ্যান মতে, ২০১১/২০১২ সালে বিচারককে যুক্তি দিয়ে সন্তুষ্ট করার পর ১৭৭ জন বিদেশি ক্রিমিনাল আর্টিক্যাল ৮ এর ফ্যামিলি লাইফের অধীনে ব্রিটেনে থেকে যাওয়ার সুযোগ পায়। এরমধ্যে খুনের দায়ে সাজাপ্রাপ্ত অপরাধীও রয়েছে।
সম্প্রতি উত্তর ইংল্যান্ডের একটি শহরে ৬ বছরের এক বালিকাকে ধর্ষণের দায়ে ৬ বছরের সাজাপ্রাপ্ত আরেক বাংলাদেশিকে দেশে ফেরৎ পাঠানোর আদালতের রায়ের বিরুদ্ধেও আপিল শুনানি চলছে। নিজের স্ত্রী, সন্তানসহ পরিবার ব্রিটেনে রয়েছে এবং তাদের সঙ্গে বসবাসের তাঁর অধিকার রয়েছে এমন যুক্তি দিয়ে ডিপোর্টেশন আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করেছেন ওই বাংলাদেশি অপরাধী।
অবশ্য আইনের ফাঁক ফোকরে অপরাধীদের ব্রিটেনে থেকে যাওয়া রোধ করতে ডিপোর্টেশন আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করার সুযোগও আর রাখছে না ব্রিটিশ হোম অফিস। ব্রিটিশ ডিপোর্টেশেন আইনে আপিল রাইটস রহিত করার বিধান রেখে ইতোমধ্যে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে নতুন আইন উত্থাপন করা হয়েছে, যা চলতি মাস থেকেই হয়তো কার্যকর হতে পারে।
ভয়ঙ্কর শীর্ষ অপরাধীদের ব্রিটেন থেকে বের করে দিতে না পারলেও ‘অসহায়’ এর মত সহজ সরল পরিস্থিতির শিকার যুবকদের ব্রিটেন থেকে বের করে দেয়ার বিষয়টি সভ্য সমাজের দাবিদার ব্রিটিশ সোসাইটি কিভাবে গ্রহণ করে এটিই এখন দেখার বিষয়। অসহায় এর মা’র আবেদনে সাড়া দিয়ে কমিউনিটি, মানবাধিকার সংগঠন বা অভিবাসীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় সংগ্রামরত কোন সংগঠন এগিয়ে আসে কি না এটিরই অপেক্ষায় রয়েছে কারাগারে অন্তরীণ ‘অসহায়’।