সময়ের সাহসী উচ্চারণ অসীম সাহা
শেখ হাসিনাকে নিবেদিত কবিতা
২০০৭ সাল বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি আলো-আধারি সময়-পরম্পরার দিশাহীন দিগন্তের অভিসারী ক্ষেত্র রচনা করে তৎকালীন ১/১১ সরকার যে স্বপ্নভঙ্গের কারণ ঘটিয়েছিলেন এবং তার ফলে বিতর্কিত সেই সরকার সম্পর্কে অবশেষে মানুষের মনে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছিল, তা দেশের জন্য কোনো সুফল বয়ে আনতে পারেনি। যে প্রত্যাশা নিয়ে রাজনৈতিক দল এবং দেশের বৃহত্তর জনমানুষ একটি স্বপ্নের জগতে পর্যটন করতে চেয়েছিল, তাকে দলে-মুচড়ে তৎকালীন তথাকথিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনাকেও ২০০৭ সালের ১৬ জুলাই গ্রেফতার করে কারাপ্রকোষ্ঠে নিক্ষেপ করে নিরপেক্ষতার নামে যে ভান করেছিল, সেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে পূর্বের মতোই দেশের কবিরাও গর্জে উঠে নেত্রীর মুক্তির দাবিতে রচনা করেছিলেন অমোঘ কিছু বাণী, যাকে গ্রন্থবদ্ধ করে ‘শেখ হাসিনাকে নিবেদিত কবিতা’ নামে আনিস মুহম্মদ একটি দুর্লভ এবং গুরুত্বপূর্ণ কর্ম সম্পাদন করেছেন। এখানে দেশের খ্যাতিমান কিছু কবির কবিতা যেমন আছে, তেমনি আছে নতুনদের কবিতা, যারা তাদের হৃদয়ের অর্ঘ্য দিয়ে নেত্রীর জন্য রচনা করেছেন আন্তরিক পঙ্ক্তিমালা। শিল্পের বিচারে এই গ্রন্থের অনেক কবিতাই হয়তো মানোত্তীর্ণ হয়নি। কিন্তু যে সময়কালকে ধারণ করে এই কবিতাসমূহ রচিত হয়েছে, সেখানে শিল্পের দাবির চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ছিল শেখ হাসিনার মুক্তির দাবিতে কবিদের একাত্মতা ঘোষণার মৌলিক চেতনাপ্রবাহ।
আনিস মুহম্মদের আরেকটি কৃতিত্ব এখানেই যে, তিনি শুধু দেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য কবিতাগুলোকে ইংরেজিতে রূপান্তর করে একমলাটেই গ্রন্থিবদ্ধ করে একে একটি ভিন্ন মাত্রা দান করেছেন। এ-ধরনের উদ্যোগ এই প্রথম। শেখ হাসিনাকে নিয়ে বিভিন্ন ধরনের লেখালেখি হয়েছে, কিন্তু একটি বিশেষ দিনকে অনুভবের ভেতরে সংগোপনে স্থাপন করে কবিতায় ভাষারূপ দেয়ার সাহসী কৃতিত্ব কবিদের এবং তাকে সংকলিত করার কৃতিত্ব অবশ্যই আনিস মুহম্মদ এর প্রাপ্য। ।
‘শেখ হাসিনাকে নিবেদিত কবিতা’র মধ্যে উঠে এসেছে কবিদের ক্ষোভ, তাদের ঘৃণা এবং সোচ্চার কণ্ঠে শেখ হাসিনার মুক্তির দাবি। কোথাও হাহাকার, কোথাও বিদীর্ণ হৃদয়ের আত্মার ক্রন্দন। ক্রন্দনের কি কোনো শিল্পরূপ থাকে? নাকি সেখানে শুধুই থাকে আর্ত হাহাকারের আন্তরিক বহিঃপ্রকাশ? এই গ্রন্থের প্রতিটি কবিতা পাঠ করলেই বোঝা যাবে, এখানে কবিরা শিল্পমান্যতাকে তেমন গুরুত্ব না দিয়ে কখনো কখনো কখনো উচ্চকিত শ্লোগানের ভাষা ব্যবহার করেছেন। সময়ের দাবি যেখানে প্রধান, সেখানে শিল্প কি খুবই গুরুত্বপূর্ণ? হয়তো শিল্পের বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু জীবনের দাবির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ নয়। তখন কবিদের কাছে লক্ষ্য ছিল একটাইÑজননেত্রী শেখ হাসিনার মুক্তি। সেই উদ্দেশ্য পূরণের ক্ষেত্রে যে এই কবিতাসমূহ মৌলিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছে, একথা দ্বিধাহীন চিত্তেই ঘোষণা করা যায়। তবে এই বইটি পাঠ করতে গিয়ে একটি বিষয় কারোরই দৃষ্টি এড়াবে না, তা হলো, দেশের অনেক খ্যাতিমান কবি সেই দুঃসময়ের সহযাত্রী হতে ব্যর্থ হয়েছেন। তাঁরা শেখ হাসিনার কারামুক্তির চেয়ে নিজেদের নিরাপদ রাখতে অধিকতর তৎপর ছিলেন, সেটা এই গ্রন্থে তাঁদের অনুপস্থিতি থেকেই অনুমান করা যায়। এখন যারা কারণে-অকারণে শেখ হাসিনার অতিশয় স্তুতিতে ব্যস্ত, তাঁরা সেই দুর্বিপাকের সময় কেন নিশ্চুপ ছিলেন, স্বভাবতই সচেতন মানুষমাত্রেরই মনে এই প্রশ্নের উদ্রেক হবে।
যদিও সেটি ভিন্ন প্রসঙ্গ। কিন্তু গ্রন্থের আলোচনা করতে গিয়ে যখন সেই সব কবির অনুপস্থিতি চোখে পড়ছে, তখন আলোচনার গতি কিছুটা হলেও শ্লথ হয়ে আসছে। কিন্তু যারা নিজেদের অস্তিত্বের ঝুঁকি নিয়েও জননেত্রীর কারামুক্তির জন্য কলমের কালিকে রক্তের উপমায় সজ্জিত করেছেন, তাদের অভিবাদন জানাতেই হয়। আর অভিবাদন তো আনিস মুহম্মদের প্রাপ্যই। তবে একটি ব্যাপারে আনিসের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই, এই গ্রন্থে যেসব কবিতা সংকলিত হয়েছে, তার বাইরেও যদি কোনো কবিতা অসাবধানতাবশত কিংবা প্রাপ্তির সুযোগহীনতার জন্য বাদ গিয়ে থাকে, তা হলে তিনি যেন পরবর্তী সংস্করণে সেগুলো গ্রন্থভুক্ত করে নেন।
সংকলিত বইটিতে মোট ৩১টি কবিতা স্থান পেয়েছে। এই কবিতাগুলোর মধ্যে দুএকটি বাদে সবগুলোই শেখ হাসিনার উদ্দেশ্যে সরাসরি নিবেদিত। এর মধ্যে রফিক আজাদ, মহাদেব সাহা, নূহ-উল-আলম লেনিন, কাজী রোজী, হাবীবুল্লাহ সিরাজী, মুহাম্মদ সামাদ, রবীন্দ্র গোপ, আসলাম সানী, ফারুক নওয়াজ, তপন বাগচী এবং মাসুদ পথিক শিল্পের দাবি মেনেও শেখ হাসিনার মুক্তির দাবি এবং তাঁর প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করেছেন। যদিও এখানে শিল্পের দাবি প্রধান নয়, তবুও যারা এতে সক্ষমতা দেখাতে পেরেছেন, তারা অবশ্যই বাহ্বা পাওয়ার যোগ্য।
সবশেষে বলি, ক্ষণকালের দাবি মিটিয়েও যারা মহাকালের হয়ে উঠতে পারেন, তারাই প্রকৃত কবি। অন্যরা সময়ের প্রতিভূ মাত্র, যদিও তাদের ভূমিকাও সময়ের প্রেক্ষিত বিবেচনায় কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমি সকলকেই নেত্রীর দুঃসময়ে তাঁর প্রতি যে কবিতা-অর্ঘ্য নিবেদন করেছেন, তার জন্যে ধন্যবাদ জানাই। আর এ ধরনের একটি দ্বিভাষিক সংকলন করার জন্য সম্পাদক ও অনুবাদক আনিস মুহম্মদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। আর একই সঙ্গে ধন্যবাদ জানাই গ্রন্থটির প্রকাশক ‘রাইটার্স ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ’কে।