শোষকের ষড়যন্ত্র ও আগামীর বাংলাদেশ :: র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী
স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ শৈশব, কৈশোর এবং যৌবনও অতিক্রম করেছে। সময়ের পরিক্রমায় স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ ১৬ ডিসেম্বর ২০১৭ সালে ৪৭ বছরে পদার্পণ করবে। মহাকালের তুলনায় এ সময় অনেক কম হলেও বাঙালির জন্য অনেক গৌরব ও আনন্দের। বিজয়ের এই মাহেন্দ্রক্ষণে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি রাষ্ট্রপিতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। স্মরণ করছি জাতীয় চারনেতাসহ স্বাধীনতা যুদ্ধের শহীদ ও বীর সৈনিকদের।
এই ভূখ-ের মানুষের ইতিহাস তাবৎ পৃথিবীর নীরিহ, নির্যাতিত আর শোষিত মানুষের অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে আছে এবং থাকবে। এটি যেমন আনন্দে তেমনি শঙ্কার বিষয়ও রয়েছে। কারণ আমাদের উত্থান মানে কর্পোরেট রাষ্ট্র আর পুজিবাদের ফেরিওয়ালাদের স্বার্থ সংকুচিত হয়ে আসা। পুজির পসার সাজিয়ে পৃথিবীব্যাপী তথাকথিত উন্নয়নের নামে সমরাস্ত্রের ফেরিওয়ালারা লাভের যে খেলায় মেতেছে তাতে ভাটা পড়বে। রাষ্ট্রপিতা মুজিবের লড়াই ছিল ওদের বিরুদ্ধে। আমার বিশ্বাস এ আদর্শ লালন করেছিলেন বলেই তিনি শেষ পর্যন্ত লড়ে গেছেন। সত্যিকার অর্থেই উপলব্ধি করেছিলেন পৃথিবীতে শোষক আর শোষিতের লড়াই। তবে বাংলাদেশে এ লড়াই শুধু দ্বিপক্ষীয় ছিল বলা যাবে না। এর ফাঁকে ঢুকে পড়েছে আরো বহু গোষ্ঠী। সব গোষ্ঠীই প্রতক্ষ্য বা পরোক্ষভাবে শোষকের হয়ে কাজ করেছে। এখনো এ লড়াই চলছে। জাতির পিতা আজীবন শোষিতের পক্ষে থেকে লড়াই করে আমাদের দেখিয়ে গেছেন যে বাঙালির গতিপথ একটাই। তা হলো শোষিতের পক্ষাবলম্বন।
এ লড়াইয়ে নানা কূটতন্ত্র থাকবে এটা স্বাভাবিক। কিন্তু তার মধ্যে সবচেয়ে ভয়ানক যে বিষয়টি হলো ধর্মের ব্যবহার। ১৯৪৭ সালে ধর্মের নামে দেশ বিভাগের কি মারাত্মক পরিণাম হয়েছিল তার প্রমাণ আমরা দিয়েছি মহান মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের রক্ত আর প্রায় আড়াই লাখ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে ৪৭ সালের ভুল শোধরাতে গিয়ে ৭১‘র মধ্য দিয়ে আমরা যা অর্জন করেছি তার ধারাবাহিকতা কি রক্ষা করতে পেরেছি? আমার মনে হয় এই পারা না পারার মধ্যেই আমাদের ভবিষ্যত।
যদিও বিগত ৪৬ বছরে অনেক দিক থেকে আমাদের অগ্রগতি বিস্ময়কর। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, বিদ্যুৎ ও প্রযুক্তিখাতসহ নানা ক্ষেত্রে আমরা অসাধারণ সফলতা দেখিয়েছি। প্রতিনিয়ত ষড়যন্ত্রকারীদের মোকাবিলা করেই সামনের দিয়ে অগ্রসর হচ্ছি। এক পদ্মা সেতুর কথাই ভাবুন। কতশত অজুহাত যে তারা দেখিয়েছে। তাদের সুরে সুর মিলিয়ে কথা বলেছে এদেশের তথাকথিত সুশীলগণ। কিন্তু আটকে রাখতে পারেনি। জননেত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ় নেতৃত্ব আর অসম সাহসীকতায় পদ্মার বুকে যে ব্রিজ তৈরি হচ্ছে তা অনেক কিছুর প্রতীক হয়ে থাকবে। এই ব্রিজ আমাদের সক্ষমতাকে যেমন জানান দিচ্ছে তেমনি পৃথিবীব্যাপী আমাদের মতো নির্যাতিত সাধারণ মানুষকে অনুপ্রেরণাও দিচ্ছে। আমার বিশ্বাস খর¯্রােতা পদ্মার বুকে জেগে ওঠা একেকটি স্পাইল একদিকে শোষকের বুকে লাঙলের ফলার মতো বিঁধছে অন্যেিদক মাথা উঁচু করে যারা আত্মমর্যাদা নিয়ে দাঁড়াতে চায়, তাদের সাহস যোগাচ্ছে। এখানেই আমাদের সক্ষমতা, স্বার্থকতা এবং গৌরব।
তবে একটি কথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই যে, এ সময়ে আমরা একটি মজবুত রাষ্ট্রীয় কাঠামো গড়ে তুলতে সক্ষম হয়নি। কিন্তু এমনটি প্রত্যাশিত ছিল না। এ সময়ের মধ্যে আমরা টেকসই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি। ১৯৭৫ সালের হৃদয়বিদারক পটপরিবর্তনের পর আমাদের জাতীয় জীবনে বারবার সমরতন্ত্র চেপে বসেছিল। তারপরও নানা চড়াই উৎড়াই পার করে আমরা গণতন্ত্রে ফিরেছি। যদিও এ পথও খুব মসৃণ ছিল না।
এখন আমাদের সামনে সবচেয়ে বড় প্রশ্ন আমরা এই অমসৃণ পথ বেয়ে আগামী দিনে গণতন্ত্রকে কতটা শক্তিশালী ভীতের উপর দাঁড় করাতে পারবো? কেননা গণতন্ত্র এবং অসাংবিধানিক পথ আমাদের সামনে সমান্তরাল ভাবে দাঁড়িয়ে আছে। এই দিক বিবেচনায় বলা যায়Ñ আমরা দাঁড়িয়ে আছি একটি ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে। জাতি হিসেবে আমরা কোথায় যেতে চাই, তা নির্ভর করছে এ সময়ে নেয়া সিদ্ধান্তর উপর। আমাদের সামনে এখন দুটি পথ খোলা। এক. জামায়াত ও জঙ্গীবাদ অধ্যুষিত বিএনপির মতাদর্শে দেশকে এগিয়ে নেয়া। দুই. মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আধুনিক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হওয়া। দেশের আপামর জনসাধারণ নিশ্চয় প্রত্যাশা করে না বাংলাদেশ পাকিস্তানের প্রেতাত্মায় ফিরে যাবে।
যুদ্ধাপরাধের বিচার, তথাকথিত বিচার মানি তালগাছ আমার মতো গণতন্ত্রের নাম করে বিএনপি-জামায়াত ১৯৭১ সালের মতো পুনরায় ধর্মকে সামনে নিয়ে আসার চেষ্টা করছে। আমরা মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ও দেখেছি এই হায়েনারা কিভাবে ধর্ম রক্ষার নামে পাকিস্তান রক্ষায় নেমে গণহত্যা, লুণ্ঠন, রাহাজানি ও ধর্ষণের উল্লাসে নেমেছিল। বাংলার মাটিতে কান পাতলে এখনো শোনা যায় সেই সব মানুষের আর্তনাত। মুক্তিযুদ্ধের অর্জন এই একুশ শতকে এসে কোনো ভাবেই মাথানত করতে পারে না। ৭১ এর চেতনাকে সমুন্ন রাখতে এখন প্রয়োজন ঐক্য।
১৯৭১ সালে আমরা বাঙালিরা ও বাংলাদেশের নাগরিকেরা স্বাধীন স্বার্বভৌম বাংলাদেশ গঠন করতে সক্ষম হয়েছি। অনেক সংগ্রাম, আন্দোলন, সশস্ত্র যুদ্ধ আর রক্তের বিনিময়ে আমাদের এই অর্জন সম্ভব হয়েছে। ১৯৪৭ এর ভারত বিভক্তির পর, কৃত্রিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের জন্মের পর থেকেই বাঙালির সংগ্রাম আর আন্দোলনের সূচনা। বলা যায় তারও আগ থেকেই স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্রের চেতনা বাঙালির মনোজগতে স্থান করে নিয়েছিল। ১৯৪৬ সনে সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশিম-শরৎ বোস পরিকল্পিত টহরঃবফ ঝড়পরধষরংঃ ইবহমধষ প্রস্তাবনার মধ্য দিয়ে এ চেতনার ভ্রুর্ণ জন্ম নেয়। টহরঃবফ ংড়পরধষরংঃ ইবহমধষ বাস্তবতা অর্জনে ব্যর্থ হলেও এর চেতনা প্রতিটি সংগ্রামশীল মানুষের অন্তরে সুপ্ত হয়ে থাকে। ঘুণে খাওয়া, পোকায় খাওয়া কৃত্রিম পাকিস্তান রাষ্ট্রের একত্রে একটি জাতি রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার কোন সুযোগই ছিল না।
পাকিস্তান রাষ্ট্র্র একটি জাতি রাষ্ট্র হিসেবে এমনকি একটি রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় নিজেকে ধরে রাখতে ব্যর্থ হয়ে গেছে। স্বাধীন বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে বেরিয়ে আসার পর আজকের বাস্তবতায়ও আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, পাকিস্তান ধর্মের ভিত্তিতে একটি রাষ্ট্র হিসেবে অদ্যাবধিও সক্ষমতা অর্জন করতে পারছে না। বস্তুত বাংলাদেশ হচ্ছে, ঐতিহাসিক বাস্তবতার একটি যৌক্তিক পরিণতি। কেননা, পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যে ভৌগলিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, ভাষা ও সাংস্কৃতিক বিভাজন বিরাজমান ছিল। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের কোন সূত্র মতেই এই বিভাজন দূরীভূত হওয়ার ছিল না।
এমনকি, যদিও ইসলাম পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলের অধিকাংশ মানুষের ধর্ম, কিন্তু, প্রায়োগিক ও চেতনাগত দিক থেকে দুই অঞ্চলের মুসলমানদের মধ্যে মিলের চেয়ে অমিলই ছিল বেশি। এমনকি, রাষ্ট্র চিন্তার দিক থেকেও বাঙালিরা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের ধারক ও বাহক। যদিও বাঙালি মুসলমানেরা স্বাধীনতা সংগ্রামের এক পর্যায়ে পাকিস্তানের সৃষ্টিতে পালন করেছিলেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা, অচিরেই তাঁদের মোহভঙ্গ হয়।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ভাস্মর সময়ে যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরুর পর আমাদের রাষ্ট্রীয় ও সমাজ জীবনে যে উত্তাপ ছড়িয়েছে, এবারের বিজয় সে উত্তাপকে বহন করে নিয়ে এসেছে। বাঙালির জীবনে বিজয়ের মাস এমনিতেই আলোর উত্তাপ নিয়ে আসে, এবার সে উত্তাপই লক্ষ কোটি গুণ বেড়ে সমগ্র জাতিকে আগুনে পুড়িয়ে নতুন জীবন দিতে এসেছে। ১৯৭৫ এর পনেরই আগস্টের পর আমাদের সমগ্র চেতনাকে স্তব্ধ করে দিয়ে মৃত্যুর শীতলতায় পৌঁছে দিতে উদ্যত ছিল প্রতিক্রিয়ার শক্তি, মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধ শক্তি। জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব আমাদের সেই মৃত প্রায় চেতনায় নব জীবনের সূচনা করেছে। বাঙালি সত্তা জেগে উঠেছে। জয় বাংলার দুর্দমনীয় শ্লোগানকে ধারণ করে বাঙালি আবার জেগে উঠেছে। যা কিছু মন্দ, কুলুষ, সবকিছুকে ঝেড়ে মুছে দিয়ে, সকল দুর্বলতাকে ছাড়িয়ে তারুণ্যের যে উচ্ছাস সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে, সে উচ্ছ্বাসকে ধারণ করে আবার ডিসেম্বর এসেছে আমাদের জীবনে।
তাই এবারের বিজয় দিবসে আমাদের শপথ স্পষ্ট। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় একটি অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ব্যবস্থা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রক্ষমতা থেকে উৎখাত করায় আমরা জাতি হিসেবে, রাষ্ট্র হিসেবে যে ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছি, তা কখনও পূরণ হওয়ার নয়। তারপরও এ দেশের জনগণ আমাদেরকে সুযোগ এনে দিয়েছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় দেশকে পুনর্গঠনের, সে সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে। ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিক্রিয়ার শক্তিকে মোকাবেলা করতে হবে। নতুন দিনের চেতনা, বিজয়ের চেতনা আর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এক ও অভিন্ন এবং অবিচ্ছেদ্য।
ইতোমধ্যে রাজনীতির নামে যে ষড়যন্ত্রের খেলা শুরু হয়েছে তার নাম কখনো রাজনীতি হতে পারে না। সংখ্যালঘুর উপর আক্রমণ, কথায় কথায় ধর্মের অপব্যবহার ১৯৭১ সালেও করা হয়েছিল। বর্তমানে এসে তা আর চলতে দেয়া যায় না। এখনই সময় এই সব অপশক্তিকে রুখে দেয়ার।
বিজয় দিবসে আমরা আশা করবোÑ গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গঠনে যে আকাঙ্খা তাড়িত হয়ে বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম রচনা করেছিল, সে লক্ষে আমরা সহনশীলতার সাথে এগিয়ে যাবো। সংঘাতের পথ পরিহার করে ঐক্যমত, সংযত ও সহনশীলতার পথে অগ্রসর হই। জয় বাংলা।