মাশরাফি, নায়ক নন, মহানায়ক
প্রেমাদাসায় বৃহস্পতিবাররাতে লাল-সবুজ রঙের ২ নম্বর জার্সি পরে যে লোকটা মাঠ ছাড়বেন, তার জন্য লঙ্কা থেকে বাংলায় একটা হাহাকার পড়ে যাবে। সুযোগের অভাবে কেউ হয়ত উপর থেকে ফুল ছুঁড়বেন না। কিন্তু দূর থেকে নায়ক বলে সম্বোধন করবেন। যদি তাই হয়, তবে ওই লোকটা ভীষণ আপত্তি করবেন। বহুবার বলেছেন, নায়ক শব্দে তার ঘোর আপত্তি। তাহলে তার পরিচয় কী?
পরিচয় খোঁজার এই যাত্রায় নানা উপাধি সামনে আনা যেতে পারে। তিনি বাংলাদেশ ক্রিকেটের বৈরাম খাঁ হলেও হতে পারেন! মোঘল সাম্রাজ্য যদি আকবরের হাতে প্রতিষ্ঠা লাভ করে, তবে তা রক্ষা পেয়েছিল ওই বৈরাম খাঁ’র জন্য। আকবরকে ১৩ বছরে রেখে তার পিতা হুমায়ুন পরলোক গমন করেন। সময়টা ছিল বড় অস্থির। পাল্টে যেতে পারত ইতিহাস। কিন্তু বৈরাম খাঁ সেটা হতে দেননি। সিংহাসনের মোহ বাদ দিয়ে অভিভাবক হয়ে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত কিশোর আকবরের পাশে ছিলেন। আর তাই আকবরকে রাজমুকুট পরানোর দিনে বলেছিলেন, ‘আমি রাজা হতে আসিনি। শরীরে আমার যোদ্ধার রক্ত। যোদ্ধা হয়েই থাকতে চাই।’
বৈরাম খাঁ’র কথা মনে পড়ে, যখন মাশরাফি বিন মর্তুজা সগর্বে বলেন, ‘আমি নায়ক নই। নায়ক তো তারাই, যারা জীবন দিয়ে দেশকে স্বাধীন করে গেছেন। আমরা জাতির জন্য এমন কিছু ত্যাগ করিনি, যা তারা করেছেন। আমাকে ভুল বুঝবেন না, ক্রিকেটই সব নয়। আমরা শুধু জাতিকে আনন্দ দিতে পারি।’
মাশরাফি চোখে আসল নায়ক সেই মুক্তিযোদ্ধারাই। এমনকি নায়ক কৃষকরাও। যারা কাঠফাঁটা রোদে ফসল ফলিয়ে চলেন। এই কথা বলেছিলেন চট্টগ্রামে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ঐতিহাসিক সিরিজ জয় করে ফেরার পথে।
যখন তিনি অধিনায়কের দায়িত্ব পান, তখন মোঘল সাম্রাজ্যের চেয়ে কম অস্থিরতা ছিল না দলে। মাশরাফি তা সামলান পরম মমতায়। দিনে দিনে কিশোর মোস্তাফিজ, সৌম্যদের লালন করে দলকে করেছেন অপ্রতিরোধ্য।
এই বিদায় তার শেষ বিদায় নয়। ওয়ানডে খেলে যাবেন। তবু ভক্তরা মানতে পারছেন না। এই সময়ে যতটা ফিট আছেন, তাতে ‘শেষের ডাক’ শোনার মত পরিস্থিতি আসেনি বলে অনেকের বিশ্বাস।
বৃহস্পতিবারের ম্যাচ দিয়ে রেকর্ড ২৮ ম্যাচে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন মাশরাফি। দল সবচেয়ে বেশি টি-টুয়েন্টি জিতেছে তার নেতৃত্বেই। শেষ ম্যাচের আগ পর্যন্ত জয় ৯টি। ওয়ানডেতে তার হাত ধরেই নতুন বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে।
২০১৪ সালে জিম্বাবুয়ে সিরিজের আগে ২১ নভেম্বরেই ওয়ানডে ও টি-টুয়েন্টি দলের নেতৃত্ব নিয়েছিলেন মাশরাফি। সেই থেকে বহু সাফল্যেরই রেণু উড়েছে বাংলাদেশের ক্রিকেটে। জিম্বাবুয়েকে ধবলধোলাই করে টানা ১২ ওয়ানডে হারের জ্বালা জুড়ানোর পর বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে খেলা; দেশে ফিরে পাকিস্তান, ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টানা সিরিজ জয়। বছরের শেষ প্রান্তে এসে জিম্বাবুয়েকে আবারও ওয়ানডেতে ধবলধোলাই। এই উপাখ্যান এখনও চলছে।
কিন্তু ক্রিকেটার মাশরাফির যে উপস্থিতিটা সবাই মাঠে দেখে, তা আসলে রুপালি পর্দার সেসব চরিত্রের মতই, পর্দার বিনোদনদায়ী চেহারায় যারা ঢেকে রাখেন বাস্তব জীবনের কষ্টের ছবি। মাঠে উইকেট পেয়ে মাশরাফি উদ্বাহু হন, ফেটে পড়েন জয়োল্লাসে, দর্শক শুধু এটুকুই দেখে। এই খেলার জন্য তাকে কতটা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, সে খবর কজন রাখেন?
স্বপ্নে তার অন্ধ তুষারের সবুজরাত্রি। কখনও সমুদ্রের চোখ। যার পাগল আকাশ খোলা বাংলাদেশ নামক একটি দলের জন্য। ১৬ বছরের ক্যারিয়ারে দুই হাঁটুতে সাতবার অস্ত্রোপচার করা হয়েছে। সৌভাগ্যবশত গত ছয় বছর ছুরির নিচে যেতে না হলেও বেশি পরিশ্রমে এখনও হাঁটু ফুলে যায়, ব্যথা হয়। খেলা শেষে সিরিঞ্জ দিয়ে টেনে বের করে নিতে হয় হাঁটুতে জমা বিষাক্ত রস। ঘুম থেকে উঠে সঙ্গে সঙ্গে বিছানা থেকে নামতে পারেন না। হাঁটু দুটো কয়েকবার ভাঁজ করতে হয়, সোজা করতে হয়—তারপর শুরু হয় দিন। মাঝেমধ্যে রাতগুলোও হয়ে ওঠে আতঙ্কের। ঘুমের মধ্যেই অনুভব করেন, কোন একটা পা বাঁকানো যাচ্ছে না।
একদিন মিরপুরে সাংবাদিকদের ছোট এক আড্ডায় বলছিলেন, ‘রাতে মাঝে মাঝে আমার অবস্থা দেখে সুমি (মাশরাফির স্ত্রী) ভয় পেয়ে যায়। ব্যথায় পা’টা হাঁটু থেকে যেন ছিঁড়ে যাচ্ছে…আমি অদ্ভুত শব্দ করে উঠি!’ মাশরাফি এভাবে বেঁচে আছেন। এভাবে বল করে যাচ্ছেন। এমন একটা দেহকে নায়ক বলাটা তো ‘অপরাধে’রই তালিকায় পড়বে। তিনি যে মহানায়ক!