আসামের উলফা নেতা অনুপ চেটিয়াকে ভারতের কাছে হস্তান্তর
ডেস্ক ২৪:: অবশেষে ভারতে প্রত্যর্পণ করা হল ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অফ অসম (উলফা) নেতা অনুপ চেটিয়াকে। বুধবার অনুপ চেটিয়া ওরফে গোলাপ বড়ুয়াকে সিবিআই-এর হাতে তুলে দেয় বাংলাদেশ। গত ১৭ বছর ধরে বাংলাদেশের জেলে রয়েছে ভারতের এই ‘মোস্ট ওয়ান্টেড’ জঙ্গি। প্রায় এক দশক ধরে উলফার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সদস্য অনুপ চেটিয়া হেফাজতে পেতে চাইছে ভারত সরকার। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর হস্তক্ষেপেই অনুপ চেটিয়াকে ভারতে প্রত্যর্পণ করার জট কাটল। ছোটা রাজনের পর অনুপ চেটিয়া। আরও এক মোস্ট ওয়ান্টেড তালিকায় থাকা অপরাধীকে নিজেদের হাতে পেল ভারত। বন্দি প্রত্যর্পণের ক্ষেত্রে ছোটা রাজনের পর অনুপ চেটিয়াকে হেফাজতে পাওয়া কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থার বড় সাফল্য বলে মনে করা হচ্ছে। খুব শিগগিরই চেটিয়াকে ভারতে নিয়ে আসা হবে। তবে গুয়াহাটি না দিল্লি, কোথায় তাকে রাখা হবে, তা এখনও স্পষ্ট নয়। চেটিয়ার ভারতে প্রত্যর্পণের খবরে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন আসমের মুখ্যমন্ত্রী তরুণ গগৈ।
ভারতের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা পিটিআই, এনডিটিভি, ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসসহ বহু গণমাধ্যম এ খবর দিয়েছে।
সূত্র জানায়, উলফার সাধারণ সম্পাদক অনুপ চেটিয়া, তার দুই সঙ্গী লক্ষী প্রসাদ গোস্বামী ও বাবুল শর্মাকে বুধবার রাত আড়াইটায় কাশিমপুর কারাগার থেকে ভারতীয় দূতাবাস কর্মকর্তা জে পি সিংয়ের হাতে তুলে দেয়া হয়। এসময় একটি গাড়িতে অনুপ চেটিয়া ও তার দুই সঙ্গীকে নিয়ে যাওয়া হয় গুলশানে অবস্থিত ভারতের দূতাবাসে। সেখান থেকে অনুপ চেটিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ভারতের রাজধানী দিল্লি নেওয়া হতে পারে।
প্রথমে অনুপ চেটিয়ে হস্তান্তরের বিষয়টি জানেন না বলে দাবি করেছিলেন বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল।
পরে সচিবালয়ে নিজ কার্যালয়ে সাংবাদিকদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘তিনি দীর্ঘদিন আটক ছিলেন। তাঁর আটকাদেশ শেষ হয়েছে। তিনি ভারতে যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন। এ জন্য তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। আজ সকালে তিনি বাংলাদেশের সীমান্ত পার হয়েছেন।’
অনুপ চেটিয়াকে হস্তান্তর করা হয়েছে কি না–এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘উনি সীমান্ত পার হয়েছেন। এটুকুই জানি। তবে তিনি বিজিবি-বিএসএফের মাধ্যমেই গেছেন। এটাকে যদি হস্তান্তর বলেন, তাহলে হস্তান্তর হয়েছে।’
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আরও বলেন, ‘উনি যাওয়ার সময় বলে গেছেন, তিনি সজ্ঞানে ও নিজের ইচ্ছায় গেছেন।’ তখন মন্ত্রীর কাছে জানতে চাওয়া হয়, কারাগার থেকে ছেড়ে দেওয়ার সময় কারও হাতে তাঁকে তুলে দেওয়া হয়েছে কি না? জবাবে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘যখন কোনো বিদেশি আটক থাকেন এবং আটকাদেশ শেষ হয়ে যায়; তখন বিষয়টি দূতাবাসকে জানানো হয়।’
অনুপ চেটিয়া কোন কারাগারে ছিলেন- জানতে চাইলে আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘তিনি কাশিমপুর কারাগারে ছিলেন। অনুপ চেটিয়ার সঙ্গে আটক আরও দুজন বাবুল শর্মা ও শক্তিপ্রসাদও আজ সীমান্ত পার হয়েছেন।’
অনুপ চেটিয়া গোলাপ বড়ুয়া, সুনীল বড়ুয়া, ভাইজন এবং আহমেদ নামেও পরিচিত। তিনি আসামের ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অব আসামের (উলফা) অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।
১৯৯৭ সালের ২১ ডিসেম্বর ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকার একটি বাসা থেকে অনুপ চেটিয়াকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর তার বিরুদ্ধে অবৈধভাবে বাংলাদেশে অবস্থান এবং অবৈধভাবে বিদেশি মুদ্রা ও একটি স্যাটেলাইট ফোন রাখার অভিযোগে তিনটি মামলা হয়। পরে তিনটি মামলায় তাঁকে যথাক্রমে তিন, চার ও সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেয় বাংলাদেশের আদালত।
কারাদণ্ডের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর ২০০৩ সালে উচ্চ আদালতের একটি নির্দেশনা অনুযায়ী চেটিয়াকে কারা হেফাজতে রাখা হয়। এর পর ২০০৫, ২০০৮ ও ২০১১ সালে তিনবার বাংলাদেশে রাজনৈতিক আশ্রয় চান তিনি।
ভারত দীর্ঘদিন ধরে অনুপ চেটিয়াকে হস্তান্তরের জন্যে বাংলাদেশের ওপর চাপ দিয়ে আসছিল। কিন্তু দুটি দেশের মধ্যে বন্দী বিনিময় চুক্তি না থাকায় তা সম্ভব হয়নি।
২০১৩ সালে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বন্দিবিনিময় চুক্তি হয়। আর গত জুন মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ঢাকা সফরে এলে অনুপ চেটিয়াকে হস্তান্তরের বিষয়টি আরো এগিয়ে যায়।
অবশেষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির হস্তক্ষেপ এবং দেশটির জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থার (এনএসএ) উপদেষ্টা অজিত দোভালের সক্রিয় প্রচেষ্টায় চেটিয়াকে ভারতে ফেরত নেওয়া হলো
অনুপ চেটিয়ার খোলা চিঠি::
নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার অপেক্ষায় অস্থির দিন কাটানো ভারতের আসাম রাজ্যের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন ‘উলফা’র সাধারণ সম্পাদক অনুপ চেটিয়া এবার গণমাধ্যমের কাছে একটি খোলা চিঠি লিখেছেন। দীর্ঘ ১৬ বছরের বন্দিজীবনে এই প্রথম গণমাধ্যমের কাছে তার কোনো বক্তব্য পৌঁছল। চিঠিতে চেটিয়া বলেছেন, বাংলাদেশের কোনো সরকারই তাকে বাংলাদেশে রাজনৈতিক আশ্রয় দিয়ে ভারতের অসন্তুষ্টির কারণ হতে চায় না। তিনি আরও বলেন, আসামের স্বায়ত্তশাসনের জন্য তারা যে উদ্দেশ্য নিয়ে আন্দোলন শুরু করেছিলেন, সেই লক্ষ্য ও আদর্শে তার কোনো বিচ্যুতিও ঘটেনি। তিনি এখনও স্বাধীন আসামের ওপরই আস্থা রাখেন। পরিচ্ছন্ন বাংলায় ঝরঝরে হাতের লেখায় চার পাতার ওই খোলা চিঠিতে অনুপ চেটিয়া বাংলাদেশে আটককালীন জীবনের কথা, আসামের রাজনীতি ও উলফার উদ্দেশ্য, তার ব্যক্তিগত জীবনসহ নানা বিষয়ে আলোকপাত করেছেন। নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার প্রবল আগ্রহের কথা উল্লেখ করে চেটিয়া বলেন, এ দেশে আটক হওয়ার পর আইন অনুযায়ী আমার সাজা হয়, যার মেয়াদও ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে শেষ হয়ে গেছে। এখন আমাকে যেতে দিন, আমি বাংলাদেশে মরতে চাই না; আসামের মাটিতেই মরতে চাই। প্রসঙ্গত, আসামে উলফাকে শান্তি প্রক্রিয়ায় আনার অংশ হিসেবে নয়াদিল্লিতে চলমান ত্রিপক্ষীয় আলোচনায় অংশ নেওয়ার জন্য অনুপ চেটিয়া নিজ দেশে ফিরে যেতে আগ্রহী। ২০০৫, ২০০৮ ও ২০১১ সালে জানানো রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন প্রত্যাহার করে চেটিয়া এখন নিজ দেশে ফিরতে চান। বাংলাদেশে তার আবেদনটি উচ্চ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে বলে ভারতে ফেরানোর প্রক্রিয়া থেকে বিরত রয়েছে বাংলাদেশ সরকার। গাজীপুরের কাশিমপুর হাই সিকিউরিটি কারাগারের ‘শৈবাল’ ভবনে এখন নিরাপত্তা হেফাজতে রয়েছেন তিনি।
চিঠিতে অনুপ চেটিয়া বলেছেন, আমি বাংলাদেশ সরকারের কাছে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করার মূল কারণ ছিল রাজনৈতিক কৌশল। আমরা অবগত ভারতকে অসন্তুষ্ট করে বাংলাদেশের যে দল বা জোটই সরকার গঠন করবে তারা কখনও ভারতের বিরুদ্ধে গিয়ে আমাকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেবে না। ২০০৩ সালে বাংলাদেশ সরকার আমার রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন খারিজ করে দিয়েছিল। তখন আমরা পুনর্বিবেচনার্থে সরকারের কাছে আবেদন করে উচ্চ আদালতেও একটি রিট করেছিলাম। উচ্চ আদালত আমাকে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত নিরাপত্তা হেফাজতে রাখার রুল জারি করেছিলেন। এ পদক্ষেপ গ্রহণের মূল কারণ ছিল বাংলাদেশ সরকার যাতে আমাকে ভারতের কাছে হস্তান্তর করতে না পারে। যদিও ভারত সরকার অনেক চেষ্টা করে আসছিল। কিন্তু বাংলাদেশ সরকার এবং জনগণের সহযোগিতা আমাদের পক্ষে থাকায় তা সম্ভব হয়নি। ভারত সরকার ঘোষণা করেছিল প্রত্যর্পণ চুক্তি করে আমাকে নিয়ে যাবে। আমিও অপেক্ষা করেছিলাম-দেখি তারা বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি করে আমাকে নিতে পারে কি না? দুই দেশের মধ্যে বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি করে তার আওতায় আমাকে নিতে পারেনি। ভারত সব চেষ্টা চালিয়ে অকৃতকার্য হওয়াতে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম-এখন আমার প্রত্যর্পণের জন্য নিজ উদ্যোগ গ্রহণের উপযুক্ত সময়। সুদীর্ঘ ১৬ বছর বন্দিত্বে কাটালাম। আর কত দিন? এ অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকা যায়? বিদেশি বন্দি হিসেবে ভারতকে অসন্তুষ্ট করে বাংলাদেশের কোনো সরকার আমাকে বিগত দিনে মুক্তি দেয়নি, ভবিষ্যতেও দেবে না। আমার দল বর্তমান আসাম ও ভারতের মধ্যে সঙ্কট অবসানের চেষ্টায় আছে। এ অবস্থায় আসামের পরিবেশ আমার জন্য অনুকূল হবে-এ প্রত্যাশা করছি। আমি নিজ ইচ্ছায় যাচ্ছি-এটা একটা প্লাস পয়েন্ট।
বন্দিজীবন প্রসঙ্গ : বন্দিজীবনে একাকিত্ব প্রসঙ্গে চেটিয়া বলেন, সত্য বলতে সাক্ষাত্কারবিহীনভাবেই দিন অতিবাহিত হচ্ছে। অন্য বিদেশি বন্দিদের সঙ্গে সাক্ষাত্কারে বিশেষ প্রতিবন্ধকতা আছে বলে আমার চোখে পড়েনি। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে কেন যেন কঠিন প্রতিবন্ধকতা। ২০১০ সালে আমি রাজশাহীতে অবস্থানকালে ভারত থেকে বড় ভাই, ভাবী এবং বন্ধুরা এসেছিল। কিন্তু কেন জানি না কর্তৃপক্ষ আমাকে সাক্ষাত্ করতে দেয়নি এবং এ সম্পর্কে আমাকে তখন কিছুই জানায়নি। পরে আমি জানতে পারি। যদিও মনের ক্ষোভে কর্তৃপক্ষকে কারণ জিজ্ঞাসা করিনি। করলে নিশ্চয় কোনো কারণ তারা দেখাত। কারণ জেনেইবা লাভ কী। এরপর ২০১১ সালের জুন মাসের শেষ সপ্তাহে অনেক চেষ্টা, দেনদরবার করে আমার এক বন্ধু এসে রাজশাহীতে প্রথম সাক্ষাত্ করে। তার কাছে আসামের, আমার দলের অনেক খবর জানতে পারি। সে অবশ্য দলের লোক নয়। এরপর ২০১২ সালের ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহে দুইজন শুভাকাঙ্ক্ষী আমার সঙ্গে সাক্ষাত্ করে আসামের বাস্তব পরিস্থিতি জানায়। এরা অবশ্য দলের সঙ্গে ছিল। এরপর থেকে এখন পর্যন্ত আর কারও সঙ্গে আমার সাক্ষাত্ হয়নি।
চেটিয়া বলেন, আমার জীবনের মূল্যবান ১৬টি বছর বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে বন্ধুত্ব অবস্থায় কাটাচ্ছি। সে পরিপ্রেক্ষিতে আমি বাংলাদেশ আমার দ্বিতীয় ঘর বলতে পারি। এ সময় বাংলাদেশিদের অতি কাছ থেকে বোঝার, উপলব্ধি করার চেষ্টা করেছি। সত্য বলতে বাংলাদেশিরা অত্যন্ত সহানুভূতিশীল, অতিথিপরায়ণ, দয়ালু এবং মানুষের বিপদের সময় সাহায্য করতে বিচলিত হয় না। চেটিয়া লিখেছেন, কারাগারে বন্দিজীবনে শ্রেণিপ্রাপ্ত মর্যাদা দেওয়ায় আওয়ামী লীগ সরকারকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাব। না হলে জীবনধারণ অনেক কষ্টকর হতো। এ সময় কারা কর্তৃপক্ষ আমাদের প্রতি সহানুভূতিপূর্বক যে সহযোগিতা করেছে, তার জন্যও তাদের সবার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ। বাংলাদেশি সহবন্দিরা প্রতিক্ষণে আমার প্রতি যে সহযোগিতা, অতিথিপরায়ণতা, বন্ধুত্বসুলভ আচার-আচরণ করেছে, তার ফলে আমি যে বিদেশের কারাগারে বন্দি আছি কখনও অনুভব হয়নি। বাংলাদেশ সরকার, কারা কর্তৃপক্ষ ও জনগণের কাছ থেকে যে আদর-যত্ন, ভালোবাসা, আন্তরিকতাপূর্ণ আচরণ, সাহায্য-সহযোগিতা পেয়েছি তা আজীবন স্মরণ থাকবে। এ সহযোগিতা মানুষ হয়ে আমি যদি ভুলে যাই, তবে আমাকে অমানুষ হতে হবে।
আসাম প্রসঙ্গ : চিঠিতে আসামের মানুষের ‘স্বাধীনতা’ প্রসঙ্গে চেটিয়া বলেন, আসামের জনগণের জন্য স্বাধীনতার প্রয়োজনীতা আছে-সেই কথাকে দৃঢ়তার সঙ্গে বিশ্বাস করে সশস্ত্র সংগ্রামের প্রতি পূর্ণ আস্থা রেখে আমরা আসামের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়েছিলাম। এখানে কোনো সন্দেহ-সংশয় অতীতেও ছিল না এবং বর্তমানেও নেই। ভিক্ষা করে, অনুনয়-বিনয় করে কোনো প্রাপ্য বর্তমান যুগে আদায় করা যায় না। সে ক্ষেত্রে স্বাধীনতা অতিদুরূহ একটি ব্যাপার। এ ক্ষেত্রে অনেক লম্বা লেখা লিখতে হয়, যা বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে সম্ভব নয়। স্বাধীনতার সংগ্রাম দীর্ঘমেয়াদি হয়ে থাকে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই যা আরম্ভ সেই ১৯৫২ সালের পর থেকে। অবশ্য নয় মাস যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করা সম্ভব হয়েছে ভারতের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের জন্য। বর্তমান যুগে স্বাধীনতা লাভের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক-রাজনৈতিক সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে। ৯/১১ ও পরবর্তীতে আত্মনিয়ন্ত্রণ, স্বাধীনতা সংগ্রাম, সন্ত্রাসবাদ-এ বিষয়গুলোকে সাম্রাজ্যবাদী উপনিবেশবাদীরা একাকার করে জটিলতা তৈরি করেছে। চেটিয়া লিখেছেন, ঐতিহাসিকভাবেই আসাম কখনও ভারত সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল না। ইতিহাসে অশোকের সাম্রাজ্য, মৌর্য সামাজ্য বা মোগল সাম্রাজ্যের সময় সমগ্র ভারতবর্ষ অধীনে থাকলেও আসাম কখনও সেই সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল না। ব্রিটিশরা ১৯২৬ সালের অবৈধ ‘ইয়ানদাবু চুক্তি’র মাধ্যমে আসাম দখল করে নেয়। এ চুক্তি হয়েছিল তত্কালীন বার্মার শাসক এবং ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে। আসামের কেউ এ চুক্তিতে সই করেনি। তাই আসামের ভাগ্য নির্ধারণ করার অধিকার বার্মার ছিল না। ব্রিটিশরা আসামকে ভারতের অন্তর্ভুক্ত করে। পরবর্তীতে স্বাধীনতা দেওয়ার সময় আসামের (অবিভক্ত আসাম) কিছু মানুষ শিলংয়ের দরবার হলে সভা আয়োজন করে ভারতের অন্তর্ভুক্তির বিরোধিতা করেছিল। কিন্তু তাদের ওই দাবি সংগঠিত ও জোরালো ছিল না। মানুষ সবসময় নিজস্ব স্বকীয় সত্ত্বা বজায় রাখতে চায়। প্রত্যেকের এটা জন্মগত অধিকার। ব্যক্তির অধিকার প্রতিষ্ঠায় রাষ্ট্র যখনই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে থাকে, জনগণের প্রতি বৈষম্য, শোষণ, দমন, লুণ্ঠন নিকৃষ্টভাবে প্রমাণিত হয়, তখনই রাষ্ট্রের প্রতি জনগণের মনে ঘৃণা, অনাস্থা ও ক্ষোভ সৃষ্টি হয়। আপনারা বাংলাদেশের ইতিহাসের দিকে দেখুন, পশ্চিম পাকিস্তানিরা পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের প্রতি কী আচরণ-বৈষম্য সৃষ্টি করেছিল। ’৭১ পরবর্তী বাঙালি জনগণের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক অবস্থার সঙ্গে বর্তমানের তুলনা করলেই আসামের স্বাধীনতা দাবির যুক্তিসঙ্গতা অনুভব করতে পারবেন।
বাংলাদেশে উলফার বিনিয়োগ প্রসঙ্গ : বাংলাদেশে উলফার কোনো লগ্নি (বিনিয়োগ) আছে কি না-এমন প্রশ্ন প্রায়ই ওঠে। ভারত সরকার বিশেষ করে বাংলাদেশে উলফার হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ আছে-এমন অপপ্রচার শুরু থেকেই করে যাচ্ছে। বিগত নব্বই দশকের প্রথম পর্যায়ে তারা প্রচার করেছিল ঢাকার সোনারগাঁও হোটেলে উলফার বিনিয়োগ আছে। আমার মনে হয় বাংলাদেশের জনগণ অবগত সোনারগাঁও হোটেলের প্রকৃত লগ্নিকারী কে? এ অপপ্রচার গ্রহণযোগ্য না হওয়ায় পরবর্তীতে অপপ্রচার করে ঢাকার আশপাশে মুরগি খামার, গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে উলফার লগ্নি আছে। তার কোনো সত্যতাও প্রমাণিত হয়নি। ফলে পরবর্তীতে ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রাম প্রভৃতি স্থানের কিছু আবাসিক হোটেলে উলফার লগ্নি আছে বলে অপপ্রচার করে। বাংলাদেশে প্রচারমাধ্যম এবং সরকারি গোয়েন্দা বাহিনী অনুসন্ধান করেও এর কোনো সত্যতা খুঁজে পায়নি। এখানে উল্লেখ করতে চাই-মাঝখানে প্রচারমাধ্যমে ঢাকার এক শিল্পপতির সঙ্গে আমার পারিবারিক ও ব্যবসায়িক সম্পর্ক আছে বলে প্রচার হয়েছিল। আমি স্পষ্ট করতে চাই-আমার সঙ্গে কোনো পারিবারিক সম্পর্কিত কোনো মানুষ বাংলাদেশে নেই এবং কোনো লোকের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্কও নেই। আসামের জনমত যেন আমাদের বিপ্লবের বিরুদ্ধে যায়-সেজন্যই এ অপপ্রচার। আসামে হাজার কোটি টাকা সংগ্রহ করার মতো পুঁজিপতি, শিল্পপতি বা ধনী লোক নেই। উলফার অন্য নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ প্রসঙ্গে চেটিয়া বলেছেন, উলফার সভাপতি অরবিন্দ রাজখোয়া বা পরেশ বরুয়া কোনো পক্ষের সঙ্গেই আমার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ নেই। বাংলাদেশের কারাগারের কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে থেকে যোগাযোগ রক্ষা করা সম্ভব নয়। অবশ্য অন্য কোনো মাধ্যমে মাঝে মধ্যে বার্তা পাওয়া, তাকে অস্বীকার করা যায় না।
পরিবার প্রসঙ্গ : চেটিয়া লিখেছেন, ১৯৯৭ সালের ২১ ডিসেম্বর আমার গ্রেফতারের সময় সাত বছর ছয় মাস বয়সের পুত্র এবং দুই বছর ছয় মাস বয়সী কন্যাসন্তান আমার সঙ্গে ছিল। তাদের অবশ্য আটক করা হয়নি। আমি পরিবারকে নিজ জন্মভূমিতে চলে যেতে বলেছিলাম। কিন্তু অতি পতিভক্তি এবং আজীবন সংগ্রামের দুঃখকষ্টের সমভাগী হতে মানসিকভাবে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ আমার পত্নী আমাকে বাংলাদেশের কারাগারে আবদ্ধ রেখে নিজে জন্মভূমিতে যেতে অনিচ্ছুক ছিল। সত্য বলতে ২০০৮ সাল পর্যন্ত তাদের বার্তা মাঝে মধ্যে কিছু বাংলাদেশি সহানুভূতিশীল মারফত পেতাম। ২০০৮ সালের প্রথমদিকে আমার পত্নীর পাঠানো শেষ চিঠিটি আমি পাই। সন্তানের পত্র পেয়ে সেদিন আমি রাতে অনেক কেঁদেছিলাম। কন্যাসন্তান সেদিন লিখেছিল, ‘বাবা তুমি দেখতে কেমন? অনেকেই বলে আমি দেখতে তোমার মতোন হয়েছি’। সুদীর্ঘ ১৬টি বছর পরিবার-সন্তানদের সঙ্গে আমার সাক্ষাত্ হয়নি। সন্তানদের দেখলে আমি এখন চিনবনা এবং তারাও আমাকে চিনতে পারবে না। আমার এক কপি ছবিও পাঠানোর কোনো সুযোগ নেই। চেটিয়া লেখেন, আসাম থেকে যখন ২০১২ সালে দুইজন আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল, তাদের আমার পরিবার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করেছিলাম। তাদের থেকে জানতে পারি, আমার পরিবার, সন্তানরা আসামে যায়নি এবং তারা কোথায় কেউ জানে না। সত্যি আমি তাদের জন্য চিন্তিত। আমি একজন সংগ্রামী হওয়ায় আমার পরিবার-সন্তানদের জন্য বিশেষ চিন্তা করে, তাদের ভবিষ্যত্ গড়ার জন্য কোনো ব্যাংক ব্যালেন্স বা সম্পদের পাহাড় গড়িনি। আমি ভবিষ্যতেও জনগণের কল্যাণের জন্য কাজ করে যাওয়ার আশা রাখি। নিজের সম্পদ গড়ার কোনো উচ্চাকাঙ্ক্ষা নেই। যা হোক, বর্তমানে আমার পরিবার কোথায় আমি জানি না। ধরে নিচ্ছি তারা জন্মভূমিতে ফিরে যায়নি। হয়তো বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে কষ্টকর, দুর্বিসহ জীবন অতিবাহিত করছে। আপনাদের প্রচার মাধ্যমের দ্বারা বাংলাদেশের দয়ালু জনগণের প্রতি আহ্বান জানাব, আমার পরিবারটিকে আপনারা পেলে মানবিকতার খাতিরে একটু সহানুভূতিপূর্বক সহযোগিতা করে তাদের জীবিত থাকতে সাহায্য করবেন। আমি বিশ্বাস রাখি, বাংলাদেশের সরকার বা মানুষ এই বিপদগ্রস্ত পরিবারটিকে কাছে পেলে রক্ষা বা উদ্ধার করার জন্য এগিয়ে যাবে।
এদিকে কারা সূত্রের খবর, চেটিয়া তার সহযোগী লক্ষ্মীপ্রসাদ গোস্বামীর সঙ্গে কারাগারে পাশাপাশি দুটি ভিআইপি সেলে দিন কাটাচ্ছেন। কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারের ছয় তলাবিশিষ্ট ‘শৈবাল’ ভবনের দুই তলায় দুটি পাশাপাশি রুমে দিন কাটছে অনুপ চেটিয়া ও লক্ষ্মীপ্রসাদ গোস্বামীর। গত ২৮ জুন সকালে চেটিয়াকে রাজশাহী থেকে কাশিমপুর কারাগারে আনা হয়। ‘ডিভিশনপ্রাপ্ত বন্দিদের সেল’ পাশাপাশি দুই কক্ষ হলেও ভোর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অবশ্য চেটিয়া ও গোস্বামী একসঙ্গেই দিন কাটান। গোস্বামী নিজেই যান চেটিয়ার রুমে। তাদের কয়েদির পোশাক পরতে হয় না। দুইজন নানাভাবে সময় কাটান; কখনো গল্প করেন, দুইজনে তাস খেলেন, কখনো টেলিভিশন দেখেন (টিভিতে স্যাটেলাইট টেলিভিশনের সংযোগ নেই)। চেটিয়ার রুমে সকাল বেলা একটি বাংলা ও একটি ইংরেজি সংবাদপত্র দেওয়া হয়।
১৬টি দেশের উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বিদেশি মুদ্রা ও স্যাটেলাইট টেলিফোনসহ বাংলাদেশে অবৈধ অনুপ্রবেশের অভিযোগে ১৯৯৭ সালের ২১ ডিসেম্বর অনুপ চেটিয়াকে ঢাকার মোহাম্মদপুরের তাজমহল রোডের এক বাড়ি থেকে গ্রেফতার করা হয়। পাসপোর্ট আইন, বৈদেশিক মুদ্রা, বিশেষ ক্ষমতা আইনসহ চারটি মামলায় তার ১১ হাজার টাকা জরিমানাসহ কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ২০০৫ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তার ওই দণ্ডের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এরপর তাকে নিরাপত্তা হেফাজতে রাখে বাংলাদেশ সরকার। ওই সাজার মেয়াদ শেষের পর সরকারের সমর্থক বেসরকারি সংগঠন ‘বাংলাদেশ মানবাধিকার বাস্তবায়ন সংস্থা’ চেটিয়াকে রাজনৈতিক আশ্রয় দেওয়ার জন্য হাইকোর্টে রিট করে। এ পরিপ্রেক্ষিতে অনুপ চেটিয়ার রাজনৈতিক আশ্রয় লাভের বিষয়টি নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত তাকে কারাগার থেকে ছেড়ে দেওয়া যাবে না মর্মে নির্দেশ দেন বাংলাদেশের হাইকোর্ট। সেই থেকেই কারা প্রশাসন বিভিন্ন কারাগারে তাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বন্দি রাখছে।