২৩ জুন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ৬৫তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী
ডেস্ক টোয়েন্টি ফোর : ২৩ জুন, আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা দিবস। গত শতাব্দীর মধ্য ভাগে, ১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন প্রগতিবাদী নেতাদের উদ্যোগে আহূত এক কর্মী সম্মেলনে পুরনো ঢাকার ঐতিহ্যবাহী রোজ গার্ডেনে বাঙালি জাতির মুক্তির বারতা নিয়ে এই সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। বস্তুত এটিই ছিল তদানীন্তন পাকিস্থানের সরকারি মুসলিম লীগ বিরোধী প্রথম কার্যকর বিরোধী দল। অখণ্ড ভারতের রাজনৈতিক দলগুলোর ধারাবাহিকতায় মুসলিম লীগ ছাড়াও, কংগ্রেস, কমিউনিস্ট পার্টি, তফসিলী ফেডারেশন প্রভৃতি রাজনৈতিক দলের অসি-ত্ব থাকলেও, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এসব দল পূর্ব বাংলার গণমানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিনিধিত্বকারী গণপ্রতিষ্ঠান হিসেবে আর উঠে দাঁড়াতে পারেনি। সামপ্রদায়িক ভেদ-বিভেদ, মুসলিম লীগের দমননীতি এবং ভয়-ভীতিতো ছিলই, সর্বোপরি তৎকালীন উদীয়মান বাঙালি মধ্যবিত্তের সামাজিক, রাজনৈতিক আবেগ, অনুভূতি এবং আশা-আকাঙ্ক্ষা অনুধাবনে কোন দলই সক্ষম ছিল না। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙালি জাতিসত্তার স্বাতন্ত্র্যের অস্বীকৃতি বাঙালি জাতিকে এক অভিনব বাস্তবতার মুখোমুখি এনে দাঁড়া করায়।
১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর মতো দিকপাল নেতাদের সঙ্গে মুসলিম লীগের দূরত্ব, উদীয়মান তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর সহকর্মীদের দ্রোহ ও আত্মত্যাগ পরিস্থিতির ঐতিহাসিক নিয়তি নির্ধারণ করে দেয়। দিক-নির্দেশনা এবং নেতৃত্বহীন অসংগঠিত জনতাকে সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক লক্ষে আর্থ-সামাজিক কর্মসূচির ভিত্তিতে সংগঠিত করা এবং মুসলিম লীগের বিকল্প গড়ে তোলার তাগিদ সৃষ্টি হয়। এই বাস্তবতা থেকেই উৎসারিত হয় আওয়ামী লীগের মতো একটি জাতীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার অপরিহার্যতা। এক কথায় বলতে গেলে সংগ্রামের মধ্য দিয়েই আওয়ামী লীগের জন্ম এবং জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষাকে চেতনায় ধারণ করে বাস-বমুখী পদক্ষেপ গ্রহণই এই সংগঠনটির বিকাশমান ধারা আজ অবধি অব্যাহত রয়েছে।
ভাষা আন্দোলন, খাদ্য আন্দোলন, মুসলিম লীগ বিরোধী ২১ দফা প্রণয়ন ও যুক্তফ্রন্ট গঠন, ‘৫৪-এর নির্বাচনে বিজয় ও মুসলিম লীগের ভরাডুবি প্রভৃতি ঘটনার ভেতর দিয়ে ‘৫০-এর দশকেই আওয়ামী লীগ হয়ে ওঠে পূর্ববাংলার রাজনৈতিক ভরকেন্দ্র বা প্রধান চালিকাশক্তি। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর জাতিগত নিপীড়ন, শোষণ বঞ্চনা, বৈষম্য এবং অব্যাহত স্বৈরশাসন ক্রমশঃ বাঙালি জাতির মোহমুক্তি ঘটায়। পাকিস্তানি ধর্ম সামপ্রদায়িক ভাবধারার আচ্ছন্নতা কাটিয়ে ধীরে ধীরে আত্মসম্বিৎ ফিরে পায় বাঙালি জাতি। এরই পটভূমিকায় বাঙালি জাতীয়তাবোধের স্ফূরণ, বিকাশ ও বাঙালির স্বতন্ত্র জাতিরাষ্ট্রের ধারণাকে জনচিত্তে প্রথিত করা এবং অপ্রতিরোধ্য করে তোলার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ পালন করে নিয়ামক ভূমিকা।’৬০-এর দশকে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন, ”দুই অর্থনীতি”র তত্ত্ব প্রচার এবং ১৯৬৬ সালে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ৬-দফা দাবি হয়ে ওঠে স্বাধিকার আন্দোলনের মেগনাকার্টা, পূর্ণ স্বাধীনতাই যার যৌক্তিক পরিণতি। ৬-দফা ভিত্তিক ছাত্র সমাজের ১১-দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার এবং বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে সৃষ্ট ‘৬৯-এর গণঅভ্যুথান, ‘৭০-এর নির্বাচনে ৬-দফার পক্ষে গণরায় এবং আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় পাকিস্তানের রাজনৈতিক ভারসাম্য বদলে দেয়। আওয়ামী লীগ আত্মপ্রকাশ করে কেবল পূর্ব বাংলার নয়, পাকিস্তানেরও সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল হিসেবে। পক্ষান্তরে, বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেন বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা এবং বাঙালি জাতির পক্ষে কথা বলার একমাত্র বৈধ কর্তৃত্বের অধিকারী।সাংবিধানিক, শান্তিপূর্ণ ও সশস্ত্র সংগ্রামের অভূতপূর্ব সমন্বয় ঘটিয়ে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির হাজার বছরের স্বপ্ন-সাধনাকে সার্থক করে তোলেন। অসহযোগ আন্দোলন, ৭ মার্চের দিক-নির্দেশনামূলক ঐতিহাসিক ভাষণ, বাংলার মানুষের অকাতরে আত্মদান সত্ত্বেও শানি-পূর্ণ সকল পথ রুদ্ধ হয়ে যায়। পাকিস্তানি সামরিক জাস্তা শান্তিপ্রিয় বাঙালিদের ওপর কাপুরুষোচিত হামলা চালায়। ১৯৭১-এর ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে গ্রেফতারের পূর্ব মুহূর্তে বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তাঁর আহ্বানে বাঙালি জাতি ঝাঁপিয়ে পড়ে সশস্ত্র সংগ্রামে। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে আওয়ামী লীগের পরিচালনায় সংঘটিত মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জিত হয়। ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বর বিশ্বের মানচিত্রে সগৌরবে স্থান করে নেয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ।স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে তাঁর প্রিয় মাতৃভূমিতে ফিরে আসেন। শুরু করেন যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশের পুনর্গঠনের দুরূহ কর্মযজ্ঞ। মাত্র সাড়ে তিন বছরে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধের ক্ষত মুছে বাংলাদেশকে উন্নয়ন অভিযাত্রায় শামিল করেন। স্বল্পতম সময়ে ভারত থেকে স্বদেশে প্রত্যাগত এক কোটি শরণার্থী এবং গ্রাম ও ভিটেমাটি ছাড়া প্রাণভয়ে পালিয়ে বেড়ানো দুই কোটি অভ্যন-রীণ ভাসমান উদ্বাস্তুকে তিনি নিজ নিজ গ্রামে সগৃহে পুনর্বাসিত করেন। তিন লক্ষাধিক নির্যাতিত নারীর সম্মানজনক পুনর্বাসনের কাজও তিনি সম্পন্ন করেন। চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরকে মাইনমুক্ত করে জাহাজ চলাচল উপযোগী করা, ধ্বংসপ্রাপ্ত ৪৩ লক্ষ ঘরবাড়ি, বিমানবন্দর, রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, কলকারখানা প্রভৃতি অবকাঠামো পুননির্মাণ ও সংস্কার করে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডকে স্বাভাবিক পর্যায়ে আনেন। কৃষি পুনর্বাসনের মাধ্যমে কৃষি উৎপাদনকে যুদ্ধ-পূর্ববর্তী পর্যায়ের স্বাভাবিক অবস’ায়ই কেবল ফিরিয়ে আনেন না, কৃষির বৈপ্লবিক পরিবর্তনের লক্ষে ভূমি সংস্কার ও কৃষিকে আধুনিকায়নের ক্ষেত্রেও যুগান-কারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধু মাত্র ১০ মাসে জাতিকে একটি গণতান্ত্রিক সংবিধান উপহার দেন। নতুন সংবিধানের ভিত্তিতে ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত হয় সংসদ নির্বাচন। আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৩টি আসনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। পরিকল্পিত অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রণীত হয় প্রথশ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। রচিত হয় গণমুখী শিক্ষানীতি। বঙ্গবন্ধু ভারতীয় মিত্র বাহিনীকে দ্রুততম সময়ে ফেরত পাঠান। বাংলাদেশের নিজস্ব প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষে সেনা, নৌ, বিমান বাহিনীকে পুনর্গঠন করেন। স্থাপন করেন বাংলাদেশের প্রথম সামরিক একাডেমী। রাষ্ট্রকর্মে ও শিক্ষার সর্বস-রে বাংলা ভাষার প্রচলন এবং বাঙালি সংস্কৃতির মুক্তধারার সকল বাধা অপসারণ করেন। বঙ্গবন্ধুর বহুমুখী কূটনৈতিক তৎপরতার ফলে বাংলাদেশ ১২১টি দেশের স্বীকৃতি অর্জন করে; লাভ করে জাতিসংঘ, কমনওয়েলথ, ইসলামি সম্মেলন সংস্থা, বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ আন-র্জাতিক বিভিন্ন সংস্থার সদস্যপদ। গঙ্গার পানি বণ্টন চুক্তি ও সীমান্ত চুক্তি সম্পাদনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু ভারতের সঙ্গে অমীমাংসিত সমস্যাগুলোর সমাধানের পথ রচনা করেন।বঙ্গবন্ধুর আজীবন দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবার সাধনা করেছেন। মাত্র সাড়ে তিন বছরে বঙ্গবন্ধুর সরকার শূন্য হাতে যুদ্ধবিধ্বস- দেশের পুনর্গঠন ও নতুন প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার দুরূহ কর্তব্য সম্পাদনের পাশাপাশি অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেও তাৎপর্যপূর্ণ সাফল্য অর্জন করেন। যেমন ১৯৭৩-৭৪ অর্থ বছরে এযাবতকালের সর্বোচ্চ ৯.৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধির হার অর্জনের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু দুঃখী মানুষের দারিদ্র্য নিরসনের লক্ষে বাংলাদেশের সামনে উন্নয়ন-সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেন।কিন’ দুর্ভাগ্য বাঙালি জাতির। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতার পরাজিত শত্রুরা জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। প্রতিবিপ্লবী ঘাতকচক্র রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে। মাত্র ৭৯ দিনেরর ব্যবধানে ৩ নভেম্বর কারাগারে আটক বঙ্গবন্ধুর যোগ্য সহকর্মী মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মুক্তিযুদ্ধকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমেদ, মন্ত্রী এম. মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামানকে একই ঘাতকচক্র হত্যা করে। রক্তাক্ত পথে ক্ষমতা দখল করে সামরিক একনায়ক জেনারেল জিয়া। বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের কূটনৈতিক মিশনে চাকরি দিয়ে করে পুরস্কৃত। আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করার লক্ষে পরিচালিত হয় হিংস্র দমননীতি।বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের ভেতর দিয়ে সূচিত হয় স্বৈরশাসনের ধারা। হত্যা-ক্যু, ষড়যন্ত্র, কারচুপি ও ভোটারবিহীন নির্বাচন হয়ে দাঁড়ায় ক্ষমতা বদলের উপায়। রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে, ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার লক্ষে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় সামরিক ছাউনিতে বসে রাজনৈতিক দল গঠন এবং প্রহসনের নির্বাচনের মাধ্যমে সেসব দলকে রাষ্ট্রক্ষমতায় বসিয়ে বেসামরিক পোশাকে চলতে থাকে সামরিক স্বৈরশাসনের ধারা।১৯৭৫ থেকে ১৯৯৬-এর মার্চ পর্যন- প্রায় ২১ বছর মোস্তাক-জিয়া-সাত্তারচক্রের সূচিত স্বৈরশাসন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের চরিত্র বৈশিষ্ট্যকেই পাল্টে দেয়। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার মধ্যেই বিষয়টি সীমাবদ্ধ থাকে না। স্বৈরশাসকরা বঙ্গবন্ধু আদর্শ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অর্জনসমূহকে ধ্বংস করার চেষ্টা চালায়। বাঙালি জাতিসত্তার আত্মপরিচয়ের মীমাংসিত প্রশ্নকে অমীমাংসিত করে তোলে। বন্দুকের নল দেখিয়ে সামরিক ফরমান বলে যতেচ্ছভাবে সংশোধন করে পবিত্র সংবিধান। সংবিধান থেকে ধর্ম-নিরপেক্ষতা কেটে দেয়, সমাজতন্ত্রের নতুন ব্যাখ্যা হাজির করে এবং বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের নামে অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও মুক্তিযুদ্ধের রণধ্বনি ‘জয় বাংলা’-কে করে নির্বাসিত। সামরিক একনায়ক জিয়া ও তার উত্তসূরীরা বাংলাদেশকে একটি সামপ্রদায়িক রাষ্ট্রে পরিণত করার জন্য সাধ্যমতো সবকিছু করে। বঙ্গবন্ধুর নাম পর্যন- উচ্চারণ নিষিদ্ধ হয়। সর্বগ্রাসী ইতিহাস বিকৃতি মুক্তিযুদ্ধের গৌরব, জাতির জনকের অবদান এবং আওয়ামী লীগের ভূমিকাকে মুছে দিতে চায়। গণতন্ত্র, ভোট ও ভাতের অধিকার হয় অপহৃত। দেশের উন্নয়ন-সম্ভাবনা পড়ে মুখ থুবড়ে। কায়েম হয় এক অন্ধকারের রাজত্ব।দেশ ও জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ শত সংগ্রামে পরীক্ষিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এই অবস’াকে মেনে নেয়নি। জেল-জুলুম, নির্যাতন উপেক্ষা করে এবং শত শত কর্মীর অকাতর আত্মদানের মাধ্যমে সামরিক-অসামরিক স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। জনগণের অকুণ্ঠ ভালোবাসা, নেতা-কর্মীদের অঙ্গীকার ও ত্যাগ-তিতিক্ষা আওয়ামী লীগকে পুনরায় সংগঠিত করে তোলে।১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মানবতার শত্রু, ঘৃণ্য ঘাতকদের হাতে সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হওয়ার সময়ে তাঁর দুই কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা প্রবাসে থাকায় ঘাতকদের নির্মমতার হাত থেকে রেহাই পান।১৯৮১ সালের ১৪, ১৫ ও ১৬ ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জাতীয় কাউন্সিল অধিবেশনে বিপুল আনন্দ-উল্লাস, বঙ্গবন্ধুর আদর্শ আস-বায়নের দৃঢ় অঙ্গীকার, সপরিবারে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচার, স্বৈরতন্ত্রের চিরঅবসান ঘটিয়ে জনগণের হৃত গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা, সার্বভৌম সংসদীয় পদ্ধতির শাসন ও সরকার প্রতিষ্ঠার বজ্র শপথ নিয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের তনয়া শেখ হাসিনাকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। ১৯৮১ সালের ১৭ মে পিতৃ-মাতৃ, ভাই, স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে স্বদেশ ভূমিতে দেশে ফেরার পর থেকেই তিনি নিরলসভাবে দেশের অধিকারহারা মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নিরবচ্ছিন্ন লড়াই-সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছেন। মূলতঃ আওয়ামী লীগ সভাপতি হিসেবে শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ফলে দেশে গণজাগরণের ঢেউ জাগে, গুণগত পরিবর্তন সূচিত হয় রাজনৈতিক আন্দোলনের, গণসম্পৃক্ততা বৃদ্ধি পায় সংগঠনের; দেশবাসী পায় নতুন আলোর দিশা। গণমানুষের মুক্তির লক্ষে আন্দোলন-সংগ্রাম করার কারণে তাঁকে বারবার ঘাতকদের হামলার শিকার ও কারা নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে। কিন্তু বাংলার মানুষের ভাগ্য উন্নয়নের সংগ্রামে তিনি আজো অবিচল থেকে নিরন্তর প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন।বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দীর্ঘ সংগ্রামে সাফল্য ছিনিয়ে আনে আওয়ামী লীগ। জনগণের রক্তঝরা আন্দোলনে গণঅভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে পদত্যাগে বাধ্য হয় খালেদা সরকার। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনের অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে। দীর্ঘ দুই দশক পরে ২৩ জুন আওয়ামী লীগ আবার সরকার গঠন করে।আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশ পরিচিত হয় অমিত সম্ভাবনার দেশ হিসেবে। প্রথমবারের মতো দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করে। সম্পাদিত হয় গঙ্গার পানিচুক্তি ও পার্বত্য চট্টগ্রাম শানি-চুক্তি। দ্রব্যমূল্য চলে আসে সাধারণ মানুষের ক্রয়-ক্ষমতার মধ্যে। নারীর ক্ষমতায়ন, স্বাস’্যসেবা, দারিদ্র্য দূরীকরণ, বিদেশী বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সরকারের সাফল্য দেশে-বিদেশে প্রশংসা লাভ করে। দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো গড় প্রবৃদ্ধি সর্বোচ্চ ৬ শতাংশে পৌঁছে। সাক্ষরতার হার ৪৫% থেকে ৬৭%-এ উন্নীত হয়, মাথাপিছু আয় ২৪৫ মার্কিন ডলার থেকে ৩৯০ মার্কিন ডলারে বৃদ্ধি পায়। অনপেক্ষ দারিদ্র্য হ্রাস পায় বিএনপি আমলের ৪৭.৫৩ শতাংশ থেকে ৪৪.৩০ শতাংশে। চরম দারিদ্র্য ২৫ শতাংশ থেকে কমে ১৯ শতাংশে দাঁড়ায়। জনগণের গড় আয়ুষ্কাল ৫৮.৭ বছর থেকে বেড়ে ৬৩.৬ বছরে উন্নীত হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস পায় আন-র্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা। বস’ত বাংলাদেশ আবার ঘুরে দাঁড়ায়।কিন’ আবারও দুর্ভাগ্য কবলিত হয় এ দেশের জনগণ। ২০০১-এর অক্টোবরের কারচুপি ও অপকৌশলের নির্বাচনে তদানীন-ন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সহায়তায় ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে বিএনপি-জামাত জোট। দেশে পুনরায় প্রতিষ্ঠিত হয় পাকিস-ানি যুগের অন্ধকারের রাজত্ব। ক্ষমতাসীন জোট মরিয়া হয়ে আওয়ামী লীগকে ধ্বংস করতে একের পর এক আঘাত হানে। হত্যা-গ্রেফতার, নির্যাতন ও নিপীড়ন হয়ে দাঁড়ায় দলের নেতা-কর্মীদের নিত্যদিনের সঙ্গী। রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হয়ে হাজার হাজার আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী-সমর্থক প্রাণ হারিয়েছে, আহত হয়েছে। সম্ভ্রম হারিয়েছে, নির্যাতিত হয়েছে অগণিত নারী। লক্ষ লক্ষ আওয়ামী লীগ সমর্থক সাধারণ মানুষকে গ্রাম ছাড়া ও ভিটেমাটি থেকে উৎখাত করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের সমর্থক হিসেবে চিহ্নিত করে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর চালানো হয়েছে নারকীয় সন্ত্রাস। বিএনপি-জামাত জোট সরকার হত্যা করেছে শাহ এমএস কিবরিয়া, আহসানউল্লাহ মাস্টার, মমতাজউদ্দিন, অ্যাডভোকেট মঞ্জুরুল ইমামসহ দলের অগণিত নেতা ও সংগঠককে।বিএনপি-জামাত জোটের অগণতান্ত্রিক নিষ্ঠুর স্বৈরশাসনের পাঁচ বছর ও অবৈধ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছর বাংলাদেশের জনগণ এক দুঃসময় অতিক্রম করেছে। এই সময়ে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সর্বপর্যায়ের নেতাকর্মীরা অসীম দৃঢ়তা ও সাহস নিয়ে রাজনৈতিক আন্দোলন করেছে। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়ে প্রাণনাশের চেষ্টা করা হয়েছে, রাজনীতি থেকে নিষ্ক্রিয় করার ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রের অংশ হিসেবে কারাগারে নিক্ষেপ করা হয়েছে, কিন্তু তিনি মাথানত করেননি, বাংলার মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে আপোষ করেননি।সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য কন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে বিশাল বিজয় অর্জনের মধ্য দিয়ে দেশ পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। জনগণের ভালবাসায় অভিষিক্ত হয়ে দ্বিতীয়বারের ন্যায় রাষ্ট্র পরিচালনার সুযোগ পেয়ে তিনি দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং সকল শ্রেণী ও পেশার মানুষের কল্যাণে যুগান-কারী অবদান রেখে চলেছেন। একটি উন্নত আধুনিক সমৃদ্ধ অসামপ্রদায়িক গণতান্ত্রিক কল্যাণকামী রাষ্ট্রগঠনে বঙ্গবন্ধু কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠনের প্রথমদিন ৬ জানুয়ারি ২০০৯ থেকেই জনগণের নিকট দেয়া প্রতিশ্রতি পূরণে কাজ করে চলেছেন। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবেলা, প্রায় ৭ বছর ধরে অধিকার বঞ্চিত জনগণকে জাতি গঠনমূলক কাজে সম্পৃক্ত করা, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে আসা ও দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিয়ে কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করেন এবং সেদিন থেকেই সরকারের ব্যাপক কর্মযজ্ঞ শুরু হয়। নির্বাচনী ইশতেহার ও রূপকল্প ২০২১ সালের আলোকে ”প্রেক্ষিত পরিকল্পনা” এবং ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি বৃদ্ধি, দারিদ্র্য হ্রাস ও বৈষম্য ঘোচানো, বিশ্বমন্দার নেতিবাচক প্রভাব মোকাবিলা, দুর্নীতির বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস’া গ্রহণ এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠাকে লক্ষ্য হিসেবে গ্রহণ করে আওয়ামী লীগ সরকার কাজ করে চলেছে। আইন-শৃঙ্খলা পরিসি’তির উন্নতি, সারসহ অন্যান্য কৃষি উপকরণ কৃষকের দোরগোড়ায় পৌঁছানোর পাশাপাশি একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় ২০২১ সালের মধ্যে একটি শিক্ষিত জাতি গড়ে তোলার অঙ্গীকার বাস-বায়ন এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার লক্ষে কর্মপ্রয়াস অব্যাহত রয়েছে।দেশে বিনিয়োগ, উৎপাদন ও রপ্তানি বেড়েছে। ব্যাপক কর্মসংস্থান হয়েছে। শুধু সরকারি খাতেই সাড়ে ৪ লক্ষাধিক নারী পুরুষ চাকরি পেয়েছেন।রেমিটেন্স বৃদ্ধি পেয়েছে। বেকার জনগোষ্ঠীর আত্মকর্মসংস্থানের পথ খুঁজে পেয়েছেন। জনগণের মাথাপিছু আয় বেড়েছে। দারিদ্র্যের হার হ্রাস পেয়েছে। গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার পথে তথ্য প্রযুক্তি ও এসএমএসের মাধ্যমে সেবা দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিটি ইউনিয়নে তথ্য ও সেবা কেন্দ্র চালু হয়েছে। জনগণের তথ্য অধিকার নিশ্চিত হয়েছে। ই-গভর্নেস ব্যাপকভাবে প্রতিষ্ঠার কাজ দ্রুত এগিয়ে চলেছে। সড়ক, রেল ও নৌ যোগাযোগ ব্যবস্থার ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হয়েছে। জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস দমন করেছে। দেশে শানি- ফিরিয়ে এনেছে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে, বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের শাস্তি কার্যকর হয়েছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কাজ শুরু হয়েছে।২০২১ সালে বাঙালি জাতি স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপন করবে। এর মধ্যেই বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করে জাতির পিতার স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ার লক্ষে দেশ দৃঢ়ভাবে এগিয়ে যাচ্ছে।বঙ্গবন্ধুর আদর্শ, মানব কল্যাণ, জনগণের প্রয়োজনের সময়ে সাড়া দেওয়া, জনগণের চাওয়া-পাওয়া, আশা-আকাঙ্ক্ষা বুঝতে পারা, জনগণের মধ্যে আত্মনিবেদিত কাজ, আধুনিকতা, বিজ্ঞানমনস্কতা এবং অগ্রসর চিন-া চেতনাই হচ্ছে আওয়ামী লীগের প্রাণশক্তি। বাংলাদেশের হৃদয় থেকে উৎসারিত এই প্রাণশক্তিই আওয়ামী লীগকে জন্মলগ্ন থেকে আজ পর্যন্ত এদেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দলের মর্যাদায় অধিষ্ঠিত রেখেছে। ঐতিহাসিক প্রয়োজনে জনগণের ভেতর থেকে গড়ে উঠেছে জনগণের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগ। যার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটির ভূখণ্ডের সীমানা পেরিয়ে এই উপমহাদেশের অন্যতম বৃহৎ এবং জনসমর্থনপুষ্ট অসামপ্রদায়িক, প্রগতিশীল, গণতান্ত্রিক, মানব কল্যাণকামী রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ তার পরিচিতি অর্জনে সক্ষম হয়েছে।এককথায় বলতে গেলে পরাধীনতার শৃঙ্খল ছিন্ন করে হাজার বছরের কাঙ্ক্ষিত বাঙালি জাতির স্বাধীনতা লাভসহ সকল মহতী অর্জনের নেতৃত্বে ছিল জনগণের প্রাণপ্রিয় সংগঠন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ; যার মহানায়ক ছিলেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। আজ তাঁরই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা বাঙালি জাতির সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ রচনার আলোকোজ্জ্বল পথ তথা আর্থ-সামাজিক-সার্বিক মুক্তির লক্ষে কাজ করে চলেছেন।