৫ মে’র প্রেক্ষাপট :: আল্লামা শফীকে ৫টি মন্ত্রণালয়ের টোপ দিয়েছিল সরকার
২০১৩ সালে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিল হেফাজতে ইসলাম। ওই বছরের ৫ মে হেফাজতে ইসলাম ঢাকা অবরোধ কর্মসূচি ও মহাসমাবেশের আয়োজন করে। যদিও সমাবেশ শেষে সরে না গিয়ে তারা মতিঝিলের শাপলা চত্বর এলাকা দখল করে রাখে। ৫ ও ৬ মে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে এই সংগঠনের কর্মীদের ব্যাপক সংঘর্ষ হয়। তখন হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়, ৫ মে শাপলা চত্বরে গভীর রাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তাদের হাজার হাজার কর্মীকে হত্যা করে। তাদের লাশ গুম করে। বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে হেফাজতকে নিহতের তালিকা প্রকাশের অনুরোধ করা হলে হেফাজতও সায় দেয়। যদিও পরে তালিকা প্রকাশ করেনি হেফাজত।
হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আজিজুল হক ইসলামাবাদী একটি সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে একান্ত আলাপে জানালেন, হেফাজত তালিকা প্রকাশ করবে না। এমনকি সেসময়ে সরকারের পক্ষ থেকে হেফাজতের আমির আল্লামা আহমদ শফীকে ৫টি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব আর ৫০টি আসনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল।আজিজুল হক ইসলামাবাদী
হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ, ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারিতে চট্টগ্রামের কওমি মাদ্রাসার ঘরানার লোকদের নিয়ে গঠিত হয়। চট্টগ্রামের হাটহাজারী মাদ্রাসার পরিচালক আল্লামা শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বাধীন এ সংগঠনটি ২০১০ সালে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষানীতির বিরোধিতার মধ্য দিয়ে আত্মপ্রকাশ করে। ২০১১ সালে তারা বাংলাদেশ নারী উন্নয়ন নীতি (২০০৯) এর কয়েকটি ধারাকে ইসলামের সঙ্গে সাংঘর্ষিক দাবি করে এর তীব্র বিরোধিতা করে। সংগঠনটি আলোচনায় আসে ২০১৩ সালে ইসলাম ও রাসুলকে কটূক্তিকারী নাস্তিক ব্লগারদের ফাঁসি দাবি করে ব্যাপক আন্দোলন ও সমাবেশের মধ্য দিয়ে।
প্রতিবেদক : বর্তমানে হেফাজতে ইসলামের তৎপরতা নেই কেন?
আজিজুল হক: ইসলামবিরোধী শক্তির মোকাবেলায় গঠিত হয়েছে হেফাজতে ইসলাম। ইসলাম বা ইসলামের বিধি বিধানের ওপর আক্রমণ মোকাবেলা করার জন্য অতীতে হেফাজত যেভাবে প্রস্তুত ছিল, এখনও আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে।
ব্লগার নাস্তিক, শাহবাগী চক্রান্ত এদেশের মুসলামানদের বিরুদ্ধে ছিল। এটা মোকাবেলা করার জন্য যতটুকু কর্মসূচি পালন করা দরকার,তাৎক্ষণিকভাবে হেফাজত তা করেছে। এক্ষেত্রে হেফাজতে ইসলাম শতভাগ সফল হয়েছে। হেফাজতের কর্ম তৎপরতা আগের মতো এখনও আছে। এ বছর ২২টি জেলার কেন্দ্রীয় নেতারা সফর করেছেন। কিন্তু এখন সেভাবে সংবাদপত্রে প্রকাশ হয় না বলে অনেকে মনে করেন হেফাজত নিষ্ক্রিয়। বরং অনুষ্ঠান করতে গিয়ে হেফাজত বাধার সম্মুখীন হচ্ছে।
প্রতিবেদক : কারা বাধা দিচ্ছে? কী ধরণের বাধা?
আজিজুল হক: আমরা হয়রানির শিকার হচ্ছি। সরকার ভয় পায় হেফাজতকে। আমাদের কর্মসূচি পালনের অনুমতি দিতে ভয় পায়। ঢাকা মহানগর ও আশপাশে আমাদের কোনও প্রোগ্রাম করতে দেওয়া হচ্ছে না। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আমাদের বিভিন্ন সময়ে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। কোথাও অনুষ্ঠানের অনুমতি দিচ্ছে না, আবার কোথাও অনুমতি দিয়ে একদিন আগে বাতিল করে দিচ্ছে, কোথাও স্থান পরিবর্তন করে অনুষ্ঠান করতে হচ্ছে।
প্রতিবেদক : আপনাদের ঘোষিত ১৩ দফা দাবি নিয়ে ভবিষ্যৎ কর্মসূচি কী?
আজিজুল হক: আমাদের ১৩ দফা শুধু মুসলমানদের দাবি নয়, সব ধর্মের মানুষের দাবি। আমরা দাবি নিয়ে তৃণমূলে কাজ করে যাচ্ছি। এটা বাস্তবায়ন করা জন্য আমরা অটল আছি।
প্রতিবেদক :: সরকারের সঙ্গে আপনাদের সমঝোতার কথা শোনা যাচ্ছে, এ বিষয়ে কিছু বলবেন?
আজিজুল হক: এটা সর্ম্পূণ গুজব। হেফাজত কোনও রাজনৈতিক সংগঠন নয়, একটি ধর্মীয় সংগঠন। ২০১৩ সালের ৫ মে এই সংগঠনের ওপর সরকার বর্বরোচিত আক্রমণ করেছে। সে আক্রমণের মোকাবেলা ইচ্ছা করলে বৃহৎ জনগোষ্ঠী সঙ্গে নিয়ে করা যেত। ১০ হাজারের বেশি গুলিবিদ্ধ হয়েছেন, অনেকে পঙ্গু হয়ে গেছে। তারপরও আমাদের আমির আল্লামা শফী বলেছেন, ‘সরকার আমাদের মেরেছে। মাসুম বাচ্চাদের ওপর গুলি চালিয়েছে। এ সরকার নাস্তিকদের দোসর সরকার। বিচার ব্যবস্থাও নাস্তিকদের পক্ষে। এ সরকারের কাছে আমরা বিচার পাবো না। এজন্য আমরা আল্লাহর কাছে বিচার দিলাম।’
আমাদের ১৩ দফা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলের দাবি ছিল না। কাউকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসানোর বা নামানোর দাবি ছিল না। আমাদের ব্যক্তিগত কোনও স্বার্থ ছিল না। সরকার আমাদের অনেক টোপ দিয়েছিল। আমাদের আমিরকে মন্ত্রিত্বের টোপ দেওয়া হয়েছিল। ৫টি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব, ৫০টি আসনের প্রস্তাব এসেছিল। কওমি মাদ্রাসার ১০ বছরের খরচ দেওয়ার প্রস্তাব ছিল। কিন্তু আল্লামা আহমদ শফী এসব গ্রহণ করেননি। আলেমদের সম্মান মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের চেয়ে অনেক বেশি। আমাদের লোভ বা আতাঁতের কোনও বিষয় নেই। আমরা আমিরের হুকুম অনুসরণ করেছি, তিনি যা নির্দেশ দিচ্ছেন তা পালন করছি।
প্রতিবেদক : নিহতের সংখ্যা নিয়ে বিতর্ক আছে, আপনারা তালিকা প্রকাশ করবেন বলেও করেননি কেন?
আজিজুল হক: প্রথমে আল্লামা আহমদ শফী ৫ মে’’র পর আমাদের বলেছিলেন, সারাদেশে খোঁজ খবর নিতে। পরে তিনি সরাসরি নির্দেশ দিলেন, যেহেতু সরকার মেরেছে, তাই সরকারের দায়িত্ব হলো কতজন মারা গেছে সঠিক তালিকা বের করা।” আমাদের এখন স্পষ্ট বক্তব্য- সরকার মেরেছে, সরকারই নিহতদের তালিকা প্রকাশ করবে। পত্রিকায় খবর এসেছে ১ লাখ ৫৪ হাজার গুলি ব্যবহার হয়েছে, এসব গুলি কাদের ওপর চালানো হয়েছে?
প্রতিবেদক :: তবু আপানাদের কাছে তো নিহতদের তালিকা আছে। তালিকা প্রকাশ না করলে তো বিতর্ক বাড়বে। কতজন মামলায় কারাগারে আছেন?
আজিজুল হক: হ্যাঁ, এটা শত শত। কতজনের নাম বলব। সরকার তো বলেছে মারা হয়নি। আমার প্রশ্ন, ঘাদানিকের শাহরিয়ার কবির কীভাবে বললেন ৬৫/৭০ জনের তালিকা তারা করেছেন। তিনি তো সংবাদ সম্মেলন করে এটা বলেছেন।
আমরা এখন যদি তালিকা প্রকাশ করি তাহলে বিতর্ক বাড়বে। ৫ মে অংশ নেওয়া অনেক মাদ্রাসা ছাত্র-শিক্ষক, সাধারণ মানুষকে এখনও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এদের কীভাবে তালিকা হবে। নিহতের পাশাপাশি অসংখ্যক লোক নিখোঁজ আছেন।
আর আমরা কীভাবে বের করবো, আমাদের তো সরকার কোনও কিছুই করতে দিচ্ছে না। আল্লামা শফীকেও বের হতে দিচ্ছে না।
অনেক লোক কারাগারে আছেন, শতের ওপরে মানুষ কারাগারে আছে। আগে আরও বেশি ছিল। অনেকে জামিনে বেরিয়ে এসেছেন।
প্রতিবেদক : আপনি তো বললেন, সরকারের টোপ ছিল, কিন্তু সেসময়ে তো আলোচনায় এসেছে, কোনও কোনও হেফাজত নেতা বিএনপি-জামায়াতের কাছ থেকে সুবিধা পাওয়ার আশায় শাপলা চত্বরে অবস্থান করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
আজিজুল হক: আমাদের সঙ্গে বিএনপি-জামায়াতের কোনও সম্পর্ক ছিল না। ৫ মে সমাবেশের আগে ও পরে আমাদের সঙ্গে প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের যোগাযোগ ছিল। সরকারের প্রতিনিধিরা যোগাযোগ করেছেন। বিরোধী দল তো নিজেরাই রাস্তায় বের হতে পারে না, তারা আমাদের কী করবে। বিএনপি-জামায়াতের এজেন্ডা নিয়ে তো আমরা মাঠে নামিনি। হেফাজত মুসলমানদের ঈমানি দায়িত্ব নিয়ে মাঠে নেমেছে। আওয়ামী লীগের মুখপাত্র মাহবুবুল আলম হানিফও মিথ্যাচার করেছিলেন যে, আমরা বিএনপি-জামায়াতের টাকা নিয়ে মাঠে নেমেছি। আমরা চ্যালেঞ্জ করার পর তো তিনি মুখে কুলুপ দিয়েছেন, আর জবাব দেননি। এটা আলেম-ওলামাদের হেয় করতে ধোঁকাবাজি।
প্রতিবেদক : আপনারা তো ঢাকায় মহাসমাবেশ করতে চেয়েও বারবার স্থগিত করেছেন, আর কি সমাবেশ করবেন?
আজিজুল হক: আল্লামা শফীকে ঢাকায় ছোট অনুষ্ঠানও করতে দেওয়া হচ্ছে না। সরকার যদি অনুমতি দেয়, আমরা যেকোনও সময় মহাসমাবেশ করতে প্রস্তুত আছি।
প্রতিবেদক : খুৎবা নিয়ন্ত্রণ, মসজিদ কমিটি নিয়ে সরকারের পরিকল্পনাকে কীভাবে দেখছেন?
আজিজুল হক: আমরা স্পস্টভাবে বিবৃতি দিয়েছি, দরবারি আলেমদের দিয়ে তৈরি করা সরকারি খুৎবা এদেশের মুসলমানরা মেনে নেবে না। খুৎবার নির্দিষ্ট নিয়ম আছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালক মোহাম্মদ সামীম আফজালের ধর্মীয় কোনও শিক্ষা নেই। দাড়ি রাখলেই মানুষ ধর্মীয় লোক হয় না। বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ইসলামের প্রচার-প্রসারের জন্য। এই উদ্দেশ্যে বাধা দিয়ে দেশে বিশৃঙ্খলা তৈরি করার জন্য পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছেন সামীম আফজাল। বঙ্গবন্ধুর তৈরি করা প্রতিষ্ঠানকে বিতর্কিত করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার জন্য তিনি কাজ করছেন। তাকে দ্রুত অপসারণ করা সরকারের জন্য জরুরি।