ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছেলে সাইফুল্লাহ ওজাকি সপরিবারে ‘আইএসে’



বাংলাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিখোঁজের তালিকায় থাকা জাপান প্রবাসী সাইফুল্লাহ ওজাকি স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে আইএসে যোগ দিয়ে সিরিয়ায় পাড়ি জমিয়েছেন বলে ধারণা করছেন জাপানি গোয়েন্দারা।
গত ১ জুলাই গুলশান হামলায় ঘরছাড়া যুবকদের জড়িত থাকার তথ্য প্রকাশের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনী থেকে দেওয়া নিখোঁজদের প্রথম তালিকায় সাইফুল্লাহ ওজাকির নাম আসে।
পরে অনুসন্ধানে দেখা যায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার জিনদপুর ইউনিয়নের কড়ইবাড়ি গ্রামের জনার্দন দেবনাথের ছেলে সজিত চন্দ্র দেবনাথই এই সাইফুল্লাহ ওজাকি।
সিলেট ক্যাডেট কলেজ থেকে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় মেধা তালিকায় স্থান নিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে ২০০১ সালে বৃত্তি নিয়ে জাপান গিয়ে ধর্মান্তরিত হন সজিত।
সেখানে বিয়ে এক জাপানি নারীকে বিয়ে করে জাপানের নাগরিকত্ব নেন তিনি; তাদের চার ছেলে ও এক মেয়েরও জন্ম হয়।
ধর্মান্তরের পর বাংলাদেশে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন থাকা সাইফুল্লাহ ২০১১ সালে পিএইচডি ডিগ্রি নেওয়ার পর রিসুমেকান ইউনিভার্সিটির ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের সহকারী অধ্যাপক হিসেবে শিক্ষকতায় যোগ দিয়েছিলেন। ২০১৫ সালে সহযোগী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন একই বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগে।
তবে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অনুপস্থিত থাকায় গত মার্চে তাকে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বরখাস্ত করে বলে জাপান টাইমস জানিয়েছে।
গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে কিয়োদো নিউজ জানিয়েছে, স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে ইউরোপ হয়ে সিরিয়া পাড়ি দিয়েছেন সাইফুল্লাহ ওজাকি।
সংবাদ সংস্থাটির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাইফুল্লাহ ওজাকি ২০১৫ সালের ১৫ মে তুরস্কের ইস্তাম্বুল হয়ে সিরিয়া যাওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। তখন জাপান ফিরে আসার পর পুলিশ তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল।
তবে তখন উগ্রবাদী গোষ্ঠীর সঙ্গে সাইফুল্লাহ ওজাকির কোনো রকম যোগসাজশ না পাওয়ার কথা জানিয়েছিল জাপান পুলিশ।
তার দুই মাস পর সিরিয়ার ‘শরণার্থীদের সহায়তা করার’ কথা বলে ইউরোপ যান সাইফুল্লাহ। সেখান থেকে পরে স্ত্রী-সন্তানসহ তিনি সিরিয়ায় ইসলামিক স্টেট অধ্যুষিত এলাকায় চলে যান বলে কিয়োদো নিউজের খবর।
শিগা প্রদেশের কুসাতু সিটির রিসুমেকান ইউনিভার্সিটিতে পড়ানোর সময় সাইফুল্লাহ +81-75-466-3149 ফোন ব্যবহার করতেন বলে বিশ্ববিদ্যালয় দপ্তর জানিয়েছে।
ওই টেলিফোন নম্বরে কল করলে তা এখন বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে।
জাপানির প্রভাবে আইএসে?
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের সজিতকে মেধাবী ও শান্ত স্বভাবের বলেই চিনতেন স্থানীয়রা। তার জঙ্গি সম্পৃক্ততার খবরটি পরিবারসহ এলাকাবাসীর পুরোটাই অজানা।
১৪ মাস আগে বাংলাদেশে এসে গ্রামে গিয়ে স্থানীয় ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের বাড়িতে বাবা-মার সঙ্গে দেখা করে গেলেও তখনও তাকে নিয়ে কোনো সন্দেহ হয়নি কারও।
কিন্তু তালিকায় নাম আসার পর ব্যবসায়ী জনার্দন দেবনাথ জানতে পারেন, তার ছেলে নিখোঁজ। ছেলের জন্য তার মা প্রতিদিনই কাঁদেন বলে জানান জনার্দন।
জাপানের আর্কাইভ ডট ওরাজি ওয়েবসাইটে সজিতের নামে একটি গবেষণাপত্র পাওয়া গেছে। যোগাযোগ সাময়িকী ‘প্রোসিডা’র ২০১৫ সালের জুলাই মাসে তার একটি প্রবন্ধও প্রকাশিত হয়। এরপরই তিনি উগ্রবাদী গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেটের সংস্পর্শে আসেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।
জাপানের গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জাপানের ডশিসা ইউনিভার্সিটির সাবেক অধ্যাপক হাসান কো নাকাতার সংস্পর্শে এসে আইএসে যুক্ত হন সাইফুল্লাহ।
জাপানের জাতীয় পুলিশ সংস্থা (এনপিএ) বলছে, নাকাতা গা ঢাকা দিয়েছেন। তাকে খুঁজতে পুলিশ কাজ করছে।
১৯৭৯ সালে ইসলাম ধর্ম গ্রহণকারী হাসান নাকাতা আইএসের হয়ে কাজ করছেন বলে নিশ্চিত হওয়ার কথা নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান।
তিনি বলেন, নাকাতার সহযোগী হিসেবে সাইফুল্লাহ ওজাকিকেও জাপান পুলিশ খুঁজছিল।
টোকিও ইউনিভার্সিটি থেকে স্নাতক এবং মিসরের কায়রো ইউনিভার্সিটি থেকে ডক্টরেট ডিগ্রি নেওয়া নাকাতা ডশিয়া ইউনিভার্সিটিতে ইসলামিক স্টাডিজ বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন ২০০৩ সালে।
সৌদি আরবে জাপানের রাষ্ট্রদূত হিসেবে কাজ করে আসা নাকাতা এরপরই হিযবুত তাহরীরে যোগ দেন বলে গণমাধ্যমে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদনে দেখা যায়। সংগঠনটির বিভিন্ন কার্যক্রমে তার যুক্ত থাকার প্রমাণ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও আছে।
২০১৫ সালের ১৫ জানুয়ারি জাপানের দুই সাংবাদিক আইএসের হাতে আটক হলে জাপান সরকার নাকাতাকে সিরিয়া পাঠায় মধ্যস্থতাকারী হিসেবে। এরপর ৮ ফেব্রুয়ারি রয়র্টাসের এক প্রতিবেদনে তাকে উদ্ধৃত করে বলা হয়, তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও আইএসের চেচেন যোদ্ধা ওমর গুরবার মধ্যে ‘অভ্যন্তরীণ সমঝতার’ চেষ্টা চালালেও মন্ত্রণালয় ‘যথাযথ ভূমিকা’ নেয়নি।
এরপর থেকে নাকাতার আইএসের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার প্রমাণ সম্বলিত কয়েকটি ছবি আসে গবেষণা প্রতিষ্ঠান আইএস স্টাডি গ্রুপের ওয়েবসাইটে।
এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলেন, “গত ১৪ অক্টোবর ইন্দোনেশিয়ায় গিয়ে নাকাতার সঙ্গে সাইফুল্লাহ ওজাকির দেখা করার তথ্যও আমরা পেয়েছি।”