Main Menu

বিপুল বিজয়ের পথে আওয়ামী লীগ

+100%-

টানা তৃতীয় নির্বাচনে জয়ের পথে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট। বিভিন্ন নির্বাচনী আসন থেকে যে ফলাফল আসছে, তাতে ক্ষমতাসীন জোটের প্রতিদ্বন্দ্বী ঐক্যফ্রন্টের প্রার্থীরা পাত্তাই পাননি। বেশিরভাগ আসনেই ভোটের ব্যবধান অস্বাভাবিক বেশি।

পাকিস্তান আমলে ১৯৭০ এবং স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালের প্রথম সংসদ নির্বাচনের পর অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনে এই চিত্র কখনো দেখা যায়নি। ক্ষমতাসীন দল বলছে, এটি উন্নয়নের ফসল আর বিরোধী পক্ষের নেতিবাচক ও স্বাধীনতাবিরোধীদের নিয়ে রাজনীতি করার ফসল। অন্যদিকে বিএনপি বলছে, নির্বাচন সুষ্ঠু হয়নি।

এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত ১০৫টি আসনে বেসরকারি ফলাফল পাওয়া যায়। এর মধ্যে নৌকা প্রতীকে আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা পায় ৯৩টি আসন। মহাজোটের শরিক জাতীয় পার্টি পায় সাতটি আসন। আর অন্যান্য দল পায় দুটি। আর বিএনপি পায় কেবল দুটি আসন।

আওয়ামী লীগ যেসব আসনে জিতেছে, তার মধ্যে বলার মতো প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়েছে কেবল দিনাজপুর-৫, লালমনিরহাট-৩ এবং বান্দরবান আসনে।

দিনাজপুরের আসনটিতে এক লাখেরও বেশি ভোট পান বিএনপির প্রার্থী এ জেড এম রেজওয়ানুল হক। লালমনিরহাট আসনে প্রায় ৯০ হাজার ভোট পান বিএনপির আসাদুল হাবিব দুলু। আর বান্দরবান আসনে নিতটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ভোট পায় ৬২ হাজারের মতো।

এমন বেশ কিছু আসন আছে, যেখানে বিএনপি নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বীও হয়ে উঠতে পারেনি। পাঁচ হাজারেরও কম ভোট পেয়েছে এমন আসনও আছে।

বিএনপি কখনো হারেনি, এমন আসন লক্ষ্মীপুর-৩ এ ১৪ হাজারের মতো ভোট পেয়েছে বিএনপি। সেখানে আওয়ামী লীগের এ কে এম শাহজাহান কামাল পেয়েছেন দুই লাখ ৩০ হাজারের বেশি ভোট।

ঐক্যফ্রন্ট অবশ্য এই ভোটকে ‘গণতন্ত্রের প্রতি উপহাস’ আখ্যা দিয়ে বলেছে, প্রমাণ হয়ে গেছে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ভোট হওয়া সম্ভব নয়।

রবিবারের ভোট নিয়ে সব মহলেই ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা ছিল। বিএনপি-জামায়াত জোট দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করার পর এবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত হওয়ায় এক ধরনের স্বস্তিও ছিল। ভোট দিতে দলে দলে মানুষের ঢাকা ছাড়ার ঘটনাতেই স্পষ্ট হয় এবার ভোট নিয়ে বাড়তি আগ্রহ ছিল।

গত ১০ ডিসেম্বর ভোটের প্রচার শুরুর পর থেকেই বিএনপি-জামায়াত এবং ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে সমান সুযোগ না পাওয়ার অভিযোগ করে আসছিল।

তবে ভোটের আগের দিনও নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে নির্ভয়ে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছিল। কেন্দ্রে গিয়ে সকাল সকাল ভোট দিতে ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকেও একই আহ্বান জানানো হয়।

বিএনপি অভিযোগ করছে দেড়শরও বেশি আসনে আগের রাতেই ভোট দিয়ে দেওয়া হয়। ২২১টি আসনে এজেন্ট বের করে দিয়ে সিল দেওয়ার অভিযোগও করা হয়।

প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নুরুল হুদা বলেছেন, বিএনপির এজেন্ট কেন আসেনি, সেটি তারাই বলতে পারবে। তবে তাদের কেউ বাধা দেয়নি।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর ভোট চলাকালে দুপুরে বলেছেন, বেলা ১১টা পর্যন্ত ভোট হয়েছে। এরপর আর ভোট দেওয়া হয়নি।

বিএনপির অভিযোগ, তাদের কর্মী সমর্থকদেরকে কেন্দ্রে যেতে দেওয়া হয়নি, ক্ষমতাসীন দল সিল মেরে ব্যালট বাক্স ভর্তি করেছে।

তবে জয়ের পর আওয়ামী লীগের সভাপতিম-রীর সদস্য শেখ ফজলুল করিম সেলিম বলেছেন, ‘দেশবাসী স্বাধীনতাবিরোধীদেরকে জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে। এ জয় দেশবাসীর জয়।’

অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, ‘আমাদেরকে এখন নতুন বিরোধী পক্ষ খুঁজতে হবে।’

রবিবার সকাল আটটায় শুরু হয়ে বিকাল চারটা পর্যন্ত একটানা চলে ভোটগ্রহণ। দেশের অন্তত ১৩টি জেলায় সহিংসতায় অন্তত ১৭ জনের প্রাণহানির তথ্য মেলে। ভোটকেন্দ্রের বাইরে যাদের হত্যা করা হয়েছে, তাদের মধ্যে বেশিরভাগ অবশ্য আওয়ামী লীগে। তাদের দলের আট জন প্রাণ হারিয়েছেন বিরোধীপক্ষের আক্রমণে।

হামলায় বিএনপি এবং তার সহযোগী সংগঠনেরও তিন জন, তাদের জোটের শরিক এলডিপি ও জামায়াতের একজন করে, একটি আসনে জাতীয় পার্টির একজন সমর্থক এবং একটি আসনে একজন নিহত হয়েছেন যিনি কোনো রাজনীতি করেন না। আর একটি আসনে নিহত এক জনের পরিচয় মেলেনি। একটি আসনে হামলায় প্রাণ হারিয়েছেন একজন আনসার সদস্যও।

রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় কেন্দ্রের আশেপাশে বিরোধীদের কোনো অবস্থানই দেখা যায়নি। যারা ছিলেন, তারা সবাই মহাজোটের নেতা-কর্মী। আর বেশ কিছু এলাকায় ভোটারদেরকে জেরার মুখে পড়ার অভিযোগও করছে বিএনপি।

যে ছয়ট আসনে ভোট হয়েছে ইভিএমে, সেখানে একজনের ভোট আরেক জনের পক্ষে দেওয়া কঠিন। তবে সেখানেও বিশেষ প্রতীকে ভোট দিতে বাধ্য করার অভিযোগ করছে বিরোধী পক্ষ।

ভোট চলাকালেই শতাধিক জনেরও মতো প্রার্থী ভোট বর্জন করে কারচুপির অভিযোগে। এদের মধ্যে বিএনপির শরিক জামায়াতের ২২ জনের সবাই আছেন। এই তথ্যটি দিয়েছেন ঐক্যফ্রন্টের প্রধান নেতা ড. কামাল হোসে।

সকাল আটটায় ভোটকেন্দ্রের দরজা খোলার পর শীতের সকালে ঘন কুয়াশা ঠান্ডা হাওয়া উপেক্ষা করে ভোট দিতে কেন্দ্রে যান ভোটাররা। সকালের দিকে ভোটার কম থাকলেও বেলা গড়াতেই বাড়তে থাকে কেন্দ্রমুখী ভোটারের সংখ্যা। ভোট পর্যবেক্ষণ করতে আসা বিদেশি পর্যবেক্ষকের পক্ষ থেকেও বলা হয়েছে শান্তিপূর্ণ ভোটের কথা।

আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা সকাল ৮টা ৫ মিনিটে সিটি কলেজে ভোট দেন। এই কেন্দ্রের প্রথম ভোটার হিসাবে তিনি ভোট দেন। সঙ্গে তার ছোট বোন শেখ রেহানা, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলসহ আরও অনেকে উপস্থিত ছিলেন। ভোট দিয়ে এসে বিজয়সূচক ‘ভি’ চিহ্ন প্রদর্শন করেন শেখ হাসিনা। সাংবাদিকদেরকে বলেন, ‘স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের জয় হবে, বাংলার জনগণ আমাদের নৌকা মার্কায় ভোট দিয়ে জয়যুক্ত করবে’।

রাজধানীর ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে সকাল পৌনে নয়টার ভোট দেন জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের অন্যতম নেতা ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন। এসময় নির্বাচনের সামগ্রিক পরিবেশ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও জয় নিয়ে আশা প্রকাশ করেন তিনি।

ভোটের দিনে রাজধানীর বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকা ঘুরে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করেছে ঢাকা টাইমসের প্রতিবেদকরা। দেখা যায়, নির্ধারিত সময়ের অনেক আগে থেকেই ভোটাররা ভোটকেন্দ্রে এসে লাইনে দাঁড়ান। ভোট গ্রহণকালে উৎসবের আমেজ বিরাজ করলেও রয়েছে নানা অভিযোগও। ভোটকেন্দ্রগুলোতে ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীদের সরব উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেলেও বিএনপিসহ অন্য দলগুলোর পোলিং এজেন্টদের দেখা মেলেনি। ভোট কেন্দ্রগুলোতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের ব্যপক উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। সেনাবাহিনী, বিজিবি ও র‌্যাব সদস্যদের কেন্দ্রগুলোতে টহল দিতে দেখা যায়। সাদা পোশাকে গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন।

ভোট গ্রহণ শেষে নির্বাচন কমিশন (ইসি) সচিবালয়ের সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেছেন, ‘ভোটারদের ব্যাপক অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে সারা দেশে শান্তিপূর্ণ ও উৎসবমুখর পরিবেশে ভোট গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে।’

‘সারা দেশে ২৯৯টি নির্বাচনী এলাকার ৪০ হাজার ১৮৩টি ভোটকেন্দ্রের মধ্যে গোলযোগ ও অনিয়মের কারণে ২২টি কেন্দ্র স্থগিত ঘোষণা করা হয়েছে। বাদবাকি সব কেন্দ্রে শান্তিপূর্ণ এবং ভোটারদের ব্যাপক অংশগ্রহণের মাধ্যমে ভোট গ্রহণ করা হয়েছে। সারা দেশে কিছু সহিংস ঘটনা ঘটেছে। এগুলো কমিশনের নজরে এসেছে এবং এসব সহিংস ঘটনা তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য কমিশন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছে।’

প্রত্যাশিত নির্বাচন হয়েছে বলে জানিয়েছে আওয়ামী লীগ। ভোটের পরে গতকাল সন্ধ্যায় রাজধানীর ধানমন্ডিতে দলের সভানেত্রীর কার্যালয়ে আওয়ামী লীগ যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রহমান বলেন, ‘গোটা জাতি আজ আনন্দিত। আমাদের প্রত্যাশিত নির্বাচন হয়েছে। ‘অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। বিক্ষিপ্ত কিছু ঘটনা ঘটেছে। সেসব ঘটনায় ১৩ জন মারা গেছে। এদের ১১ জনই আওয়ামী লীগের কর্মী। আর ২ জন আনসার সদস্য।’

বিজয় মিছিল করবেন কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমাদের বিজয় এখনও সুনিশ্চিত হয়নি। বিজয় সুনিশ্চিত হলেই আমার মিছিল করবো।’

স্বাধীনতার ৪৭ বছরেও এমন নির্বাচন হয়নি, কামাল হোসেনের এমন মন্তব্যের প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, ‘ড. কামাল ঠিক-ই বলেছেন। স্বাধীনতার ৪৭ বছরেও এমন সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি।’

এদিকে সরকার একতরফা নির্বাচন করে জাতিকে দীর্ঘদিনের জন্য সমস্যায় ফেলবে বলবে মন্তব্য করেছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেছেন, ‘এতে নির্বাচনী প্রতিষ্ঠানের প্রতি মানুষের আর আস্থা থাকবে না। প্রশাসনের ওপর মানুষের আর আস্থা থাকবে না। এটা দেশের জন্য বড় ক্ষতি হয়ে গেল।’

‘একটা প্রহসনের নির্বাচন হচ্ছে। আমরা যেহেতু নির্বাচনে আছি, পরে আমরা সিদ্ধান্ত নেব।’

বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘সরকার সকল রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে নির্বাচনের নামে যে তামাশা করছে, ইতিমধ্যে তা প্রমাণ হয়ে গেছে।’

এবারের ভোটে এক হাজার ৮৬১ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এর মধ্যে স্বতন্ত্র প্রার্থী ১২৮ জন। বাকিরা সব বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতীকে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন। সূত্র: ঢাকা টাইমস






Shares