শামীম উন বাছির : ব্রাহ্মণবাড়িয়া আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রার্থীদের মধ্যে চমক সৃষ্টি করা দুটি ঘটনার মধ্যে অন্যতম একটি হল কসবা আখাউড়ার বর্তমান এমপি পার্বত্য চট্টগাম বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি এডভোকেট শাহ আলমের নমিনেশন না পাওয়া । কসবা এবং আখাউড়া উপজেলা নিয়ে গঠিত ব্রাহ্মণবাড়িয়া ৪ আসন। গত নির্বাচনে এডভোকেট শাহ আলম সুনির্দিষ্টি কতগুলো ওয়াদা করে নির্বাচনী বৈতরনী পার হন। উনি মনোনয়ন না পাওয়ায় এখন বিশ্লেষণ হচ্ছে এর কারণ কি? কসবা আখাউড়া মানুষের দাবী ছিল গ্যাস সরবারহের বিশেষ করে নারীরা যারা গৃহস্থালীতে গ্যাস ব্যবহার করে, তারা ছিল প্রচন্ড বিরুপ। কসবা আখাউড়া দুই উপজেলাতেই নারী ভোটারের সংখ্যা বেশী। প্রায় ১ লক্ষ আখাউড়ায় এবং ৪৫ হাজার কসবায়। গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রধান নির্বাচনী ওয়ায়দা ছিল গ্যাস সরবরাহ। এই ওয়াদা পালন করতে পারেনি এডভোকেট শাহ আলম, সরকারের মাঠ পর্যায়ের জরিপ থেকে প্রাপ্ত তথ্যের এ কারনটিই ছিল সবচেয়ে উপরে। এছাড়াও আরও কিছু কারণ ছিল। আখাউড়া দিয়ে প্রবাহমান তিতাস নদী। প্রচন্ড খরস্রোতা তিতাস এখন মৃত প্রায়। এ নদীটি খনন করাও ছিল একটি নির্বাচনী ওয়াদা। যা শাহ আলম পূরণ করতে পারেনি। আখাউড়ার শহীদ স্মৃতি কলেজকে এবং কসবার টি আলী কলেজকে জাতীয়করন করার আশ্বাস বহুবার দিয়েছিলেন এমপি শাহ আলম। কিন্তু দুটোর কোনটাই বাস্তবায়ন হয়নি। এ ছাড়াও উনি আশ্বাস দিয়েছিলেন আখাউড়া কসবায় আন্ত: নগর ট্রেনের যাত্রা বিরতি এবং গ্রামের রাস্তাঘাটের ব্যাপক উন্নয়ন করার। দুই উপজেলার ভোটাররা তার উপর ছিল যথেষ্ট বিরক্ত। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ৪ কসবা আখাউড়া উপজেলায় সব চেয়ে বেশী দূর্নীতি হয়েছে কাবিখা প্রকল্পে। এই দুই উপজেলায় শত শত টন খাদ্য বরাদ্দ হয়েছিল প্রান্তিক জনগনের জীবন মানের উন্নয়নের জন্য। কাবিখা প্রকল্প নিয়ে এমপি মহোদয়ের নিকট ব্যক্তিরা তৈরি করেছিল একটি কঠিন বলয়। এ বলয়ের নেতৃত্বে ছিলেন কসবা উপজেলা চেয়ারম্যান। এ সব প্রকল্পের ব্যাপারে কঠোর গোপনীয়তা রক্ষা করে চলতেন তিনি। নিজেদের পছন্দের লোকদের মাধ্যমে নামে বেনামে প্রকল্প তৈরি করেছেন। এ সব প্রকল্পের মধ্যে রয়েছে রাস্তা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে মাটি ভরাট, কাব ও সংস্থার উন্নয়ন। বরাদ্ধের ক্ষেত্রে তারা বিবেচনায় আনতেন নিজস্ব পছন্দের লোকদেরকে। কর্তৃপক্ষ কাগজে কলমে এ সব প্রকল্প দেখালেও বাস্তবে কোন কাজই হয়নি। কাবিখা বরাদ্ধপ্রাপ্তদের কাজ করার জন্য কোন নির্দেশনাই দেয়া হয়নি। শুধু বরাদ্দ পাওয়া ব্যক্তি/সংঘঠনটিকে প্রকল্পের বিপরীতে হাতে টাকা তুলে দেওয়া হয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বরাদ্ধকৃত গম নিজেরাই তুলে নিয়ে বাহিরে বিক্রি করে দিনে। এ ধরনের দূর্নীতিগুলোর সাথে জড়িত ছিলেন শাহ আলম বকুলের পছন্দের ব্যক্তিরা। বাকীরা অর্থ্যাৎ দলের ত্যাগী নেতারা এ সব বরাদ্দ থেকে কিছুই না পেয়ে মনে মনে ক্ষুব্ধ হতে থাকেন। যার প্রভাব দেখা যায় মাঠ পর্যায়ের জরিপে। এ ছাড়াও দলে অন্ত: কোন্দল ছিল অন্যান্য বারের চেয়ে অনেক বেশী। এর প্রথম বিস্ফোরণ লক্ষ্য করা যায় আখাউড়া পৌর নির্বাচনে। জেলা আওয়ামী লীগ প্রার্থী হিসাবে সমর্থন দেয় কাজলকে। অন্যদিকে এমপি শাহ আলম সমর্থন দেন কম জনপ্রিয় এক বির্তকিত নেতাকে। সরাসরি এমপির বিরোধিতা করে পৌর মেয়র হয়ে যায় কাজল। তখন থেকেই মানুষ বুঝতে পারে শাহ আলমের সময় ভাল নয়। এর পর অন্ত কোন্দল দেখা যায় আখাউড়া ছাত্রলীগ কমিটি নিয়ে। স্থানীয় সাংসদের ক্ষমতাকে অগ্যাহ্য করে জেলা ছাত্রলীগ সম্পূর্ণ একটি নতুন কমিটির অনুমোদন দেয়। ছাত্র রাজনীতিতে এভাবেই প্রভাব হারাতে থাকেন শাহ আলম এমপি। শাহ আলম এমপির বিরুদ্ধে আরেকটি অভিযোগ খুব বড় করে দেখা হয়। সেটি হল বিরুদ্ধ মতবাদীদের সহ্য করতে না পারা। বেশ কিছুদিন আগে যুবলীগের এক কেন্দ্রীয় নেতার মটর সাইকেল বহরে হামলা চালায় শাহ আলমের অনুসারীরা। বেশ কয়েকটি মটর সাইকেল পুড়িয়ে দেয়া সহ তারা নিগৃহীত করেন কেন্দ্রীয় নেতা এবং তার সমর্থকদের। যা দলের হাইকমান্ড মোটেই ভালভাবে নেয়নি। এমপি শাহ আলম বেশীর ভাগ সময় থাকতেন ঢাকায়। প্রকল্পের উদ্ধোধন, বড় ধরনের কর্মী সভা, ত্রান বিতরণের প্রধান অতিথি ছাড়া তিনি কসবা আখাউড়ায় আসতেন না। দলের তৃণমূলের নেতা কর্মীরা তার কাছে তুলে ধরতে পারতেন না তাদের সমস্যা। ক্ষমতায় আসার উপর এমপি শাহ আলম তৃণমূলের নেতাদের এল জি ই ডি অগ্রাধিকার প্রকল্পে অনেক কাজ পাইয়ে দেন। তৃণমূলের নেতারা যাদের কাজ বা ঠিকাদারী সর্ম্পকে বিন্দুমাত্র কোন ধারনা না থাকলেও প্রচন্ড খুশী ছিল কাজ পেয়ে। অগ্রাধিকার এই সব প্রকল্পে বিলের কোন নিয়মনীতি না থাকায় ফান্ডের অভাবে তারা বিল না পেয়ে হতাশ হতে থাকে। এই ধরনের কাজ যে সব নেতারা করেছে, তারা কেউই লাভবান তো দূরের কথা, পুজিই ফেরত পায়নি অনেকে। এ কাজগুলো তৃণমূলের নেতাদের সাথে শাহ আলমের দূরত্ব অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। এর উপর যোগ হয়েছে এমপি শাহ আলমের ভাইদের কিছু অনিয়ম। উনার এক ভাই আম মোক্তার নামার মাধ্যমে জমি হাতিয়ে নেবার চেষ্টা চালায়, যদিও ভাইদের এ রকম কাজের প্রতি এমপি শাহ আলমের মোটেই সমর্থন ছিল না তারপরেও গন মাধ্যমে সংবাদগুলো পরিবেশিত হয়েছে শাহ আলমের ভ্রাতা হিসাবে। এত সব ঘটনা নিয়ে এমপি শাহ আলমের প্রতি বিরক্ত হয়ে উঠেছিল দলের হাই কমান্ড। জেলা আওয়ামী লীগের নেতাদের সাথেও ছিল উনার একটা ঠান্ডা সর্ম্পক বিরাজমান ছিল। জেলা আওয়ামী লীগের অনুষ্ঠানে এমপি শাহ আলমের উপস্থিতি ছিল না বললেই চলে। কেন্দ্রে বা আওয়ামী লীগে উনার অভিভাবক ছিলেন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান। পারিবারিক একটা সর্ম্পক ছিল রাষ্ট্রপতির পরিবারের সঙ্গে। গত নির্বাচনে জোট গত অবস্থানের কারণে উনার অনিশ্চিত মনোনয়নকে নিশ্চিত করেছিল প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান। আজ জিল্লুর রহমানের অনুপস্থিতি হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন শাহ আলম। তার উপর এবার যিনি আওয়ামী লীগের নমিনেশন পেয়েছেন উনি হলেন দেশের প্রখ্যাত আইনজীবি আনিসুল হক। যার বাবা সিরাজুল হক ও এই আসন থেকে নির্বাচন করেছিলেন। আনিসুল হক বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার প্রধান আইনজীবি ছিলেন। দূর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবি হিসাবে তিনি অনেক কাজ করছেন। তার উপর শেখ রেহানা একটি প্রচ্ছদ সমর্থন ও আছে উনার প্রতি। তারপরেও সব দিক বিবেচনা করলে দেখা যায়, এডভোকেট শাহ আলম কসবা আখাউড়ায় আওয়ামীলীগের ভিত্তি নতুন করে গড়ে তুলেছিলেন। আনিসুল হক ব্যক্তি জীবনে একজন প্রতিষ্ঠিত আইনজীবি। ব্যক্তিজীবন এবং রাজনৈতিক জীবন মোটেই এক নয়। এখন দেখা যাক আনিসুল হক কতটুকু সাফল্য অর্জন করতে পারেন? তবে এডভোকেট শাহ আলমের সহযোগিতা ছাড়া উনার পক্ষে নির্বাচনী বৈতরণী পার হওয়া এক প্রকার অসম্ভব বলে মনে করেন সংশ্লিষ্ট মহল। |