Main Menu

বিজয়নগরে প্রকাশ্যেই বিক্রয় হচ্ছে নিষিদ্ধ গাইড বই, শিক্ষকরা খাচ্ছেন লক্ষ লক্ষ টাকার কমিশন

+100%-

মো: জিয়াদুল হক বাবু :: ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগরে লাইব্রেরীগুলোতে প্রকাশ্যে চলছে বিভিন্ন প্রকাশনীর নিষিদ্ধ গাইড ও গ্রামার বইয়ের রমরমা ব্যবসা। আর এসব বই বেচাকেনা হচ্ছে স্কুল গুলোর প্রত্যক্ষ সমর্থনেই। আর শিক্ষকরা কমিশন খাওয়ায় ৭০/৮০ টাকার অনেক গাইড বই বাজারে ৫০০টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ফলে বাধ্য হয়েই ছাত্র-ছাত্রীকে চড়া দামে কিনতে হচ্ছে এসব নিষিদ্ধ বই। আর অভিনব কায়দায় এই নিষিদ্ধ বই বিক্রির লক্ষ লক্ষ টাকা কমিশন হাতিয়ে নিচ্ছে শিক্ষকরা । অন্য দিকে বাজারে অনেকটা প্রকাশ্যেই পপি লাইব্রেরী ,জননী ,পুথিপত্র ,ইনফোকাস পাঞ্জেরী ,লেকচার,মেধাসিড়ি,লাবীব ,বিথী ও দিগন্ত পাবলিকেশন সহ বিভিন্ন প্রকাশনী গাইড বই বিক্রি করে কোটি কোটি টাকার বানিজ্য করছে।

সরজমিনে বিজয়নগর উপজেলার বইয়ের দোকানগুলো ঘুরে দেখা গেছে, দোকানগুলোতে সাজানো রয়েছে বিভিন্ন প্রকাশীর গাইড বই ও ইংরেজি গ্রামার এবং বাংলা ব্যাকরণ বই। লাইব্রেরীর সামনে অভিভাবকদের এসব বই কেনার জন্য ভীড় লক্ষ্য করা গেছে।

গাইড বই কিনতে আসা কয়েকজন অভিভাবকের সাথে কথা বলে জানা গেছে, বিদ্যালয় থেকে নির্দিষ্ট প্রকাশনী ও লাইব্রেরীর নাম উল্লেখ করে বই কিনতে বলা হয়েছে। তাই বই কিনতে এসেছেন তারা। তবে সরকারী ভাবে নিষেধাজ্ঞা থাকায় শিক্ষকরা ঝামেলা থেকে বাচঁতে এবার কোন বুক লিস্ট করেনি মেীখিক ভাবেই সবাইকে বইয়ের তালিকা দিয়ে দিয়েছে।

দাউদপুর উচ্চবিদ্যালয়ের অভিভাবকের হাতে ৬ষ্ট শ্রেণীর তালিকায় দেখা যায়, পপি গাইড বইয়ের নাম লেখা রয়েছে। বইগুলো যে লাইব্রেরীতে পাওয়া যাবে সে লাইব্রেরীর নামও তালিকায় উল্লেখ আছে।
বই প্রকাশনীর এক বিক্রয় প্রতিনিধি বলেন ,বিজয়নগর উপজেলার প্রায় সবগুলো বিদ্যালয় বই বাণিজ্যে জড়িত । তারা ইংরেজি গ্রামার ও বাংলা ব্যাকরণসহ বিভিন্ন বিষয়ের সহায়ক বই কেনার জন্য নির্দিষ্ট প্রকাশনী ও লাইব্রেরীর নাম উল্লেখ করে ছাত্র-ছাত্রীদেরকে বই কিনতে বাধ্য করছে এবং সবগুলি প্রতিষ্ঠানই নগদ টাকা ও উপহার নিয়ে অকারণে শিক্ষার্থীদের উচ্চমূল্যে বই কিনতে বাধ্য করছে।
এদিকে, বেশীর ভাগ প্রতিষ্ঠান সমন্বয় করে আখাউড়ার আল আমিন লাইব্রেরী। এছাড়াও উপজেলার আমতলী বাজারের স্টার লাইব্রেরী ও চেীধূরী লাইব্রেরী, হরষপুরের আল আমিন লাইব্রেরী, চম্পকনগরের বিল্লাল লাইব্রেরী, ইসলামপুরের রৌশন লাইব্রেরী, মুকন্দপুরের মুজাহিদ ও রহমানিয়া লাইব্রেরী, সিংগারবিল বাজারের শুভেচ্ছা লাইব্রেরী ও আশা লাইব্রেরী এসব বই সরবরাহ করে।

সরজমিনে জানা গেছে, স্কুল কর্তৃপক্ষ ও প্রধান শিক্ষকরা আলাদা করে লক্ষ লক্ষ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে।

উপজেলার দাউদপুর উচ্চবিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ও সহকারী শিক্ষক মধু বিকাশ পপি লাইব্রেরি থেকে ১৮০০০০/টাকা, চম্পকনগর স্কুল এন্ড কলেজ এর কামাল মাষ্টার পপি থেকে ১০০০০০/টাকা, পাঁচগাও আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক জননী পাবলিকেশন থেকে নিজে ৩৫০০০/টাকা ও স্কুলের নামে ৬০০০০/টাকা, লক্ষিমোড়া উচ্চ বিদ্যালয় পুথিপত্র পাবলিকেশন থেকে ৪৫০০০/টাকা, মেরাশানী পলিটেকনিক একাডেমি পপি থেকে ১৬০০০০/টাকা ও প্রধান শিক্ষক ৩০০০০/টাকা, কবি সানাউল হক উচ্চবিদ্যালয় পপি থেকে ৫০০০০/টাকা, নিদারাবাদ ইউনিয়ন উচ্চবিদ্যালয় গাইড বইয়ের জন্য জুপিটার থেকে আলমারী ও গ্রামার বইয়ের জন্য পথিপত্র থেকে ৬০০০০/টাকা, পত্তন উচ্চবিদ্যালয় পুথিপত্র থেকে ৪০০০০/টাকা, মুকন্দপুর উচ্চ বিদ্যালয় পপি থেকে ১৬০০০০/টাকা ও প্রধান শিক্ষক ৩০০০০/টাকা, বিষ্ণপুর উচ্চ বিদ্যালয় পপি থেকে ১৬০০০০/টাকা ও প্রধান শিক্ষক ২০০০০/টাকা, সাটিরপার স্কুল পুথিপত্র থেকে ৩০০০০/টাকা ,কালাছড়া উচ্চ বিদ্যালয় পপি থেকে ৬০০০০/টাকা ,চর ইসলামপুর পুথিপত্র থেকে ৫০০০০০/টাকা ,মহেষপুর উচ্চ বিদ্যালয় পপি ও পুথিপত্র থেকে ৫০০০০০/টাকাসহ উপজেলার প্রায় ২ শতাধিক প্রাথমিক বিদ্যালয়, কিন্ডারগার্টেন, মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মাদ্রাসার সংশ্লিষ্ট লোকজন এ বই বাণিজ্যে ব্যস্ত ।

লাইব্রেরীতে গাইড বই কিনতে আসা আমেনা বেগম নামের এক নারী অভিভাবকের সাথে কথা বলে জানা যায়, তার মেয়ে ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে। স্কুল থেকে গাইড বই কেনার জন্য তালিকা দিয়েছে তাই মেয়ের জন্য বই কিনতে এসেছেন। ১২শ ৫০ টাকায় একসেট বই কিনেছেন তিনি। আরেক অভিভাবক কাজী খালেদ বলেন, তাঁর মেয়ে কিন্টারগাডেনে প্লেতে পড়ে। স্কুল থেকে তালিকা দিয়েছে বই কেনার জন্য। তাই বাধ্য হয়ে একসেট বই ৯৫০ টাকা কিনতে হয়েছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন লাইব্রেরীর মালিক বলেন, প্রকাশনীগুলো স্কুল গুলোকে মোটা অংকের টাকা দিয়ে ম্যানেজ করে গাইড বই ব্যবসা চালাচ্ছে। বিদ্যালয় থেকে শিক্ষার্থীদের যে গাইড কিনতে বলে সেটিই চলে। শিক্ষকদের সুবিধা নেয়ার বিষয়টি প্রকাশনীর প্রতিনিধিরাই এসব জানিয়েছে। তবে নিষিদ্ধ এসব গাইড বই বিক্রির বিষয়ে জানতে চাইলে ওই মালিক বলেন, চাহিদা থাকায় আমরা বিক্রি করি। নিষিদ্ধ কীনা তা আমরা জানিনা।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন শিক্ষক জানান, বর্তমানের সৃজনশীল পড়াশোনার কারণে গাইড ছাড়া কোনো শিক্ষার্থী পড়তে পারবে না। শিক্ষকদেরও পড়ানো কঠিন। গাইড বই থাকলে পড়া বুঝতে সুবিধা হয়। তারা আরো জানান,অধিকাংশ শিক্ষকদের কাছেই সৃজনশীল পদ্ধতিতে মূল বই পড়ানো বেশ কঠিন। এ কারণে শিক্ষকরা নোট-গাইডের প্রতি বেশি আগ্রহী।

আরেকজন শিক্ষিকা নাম প্রকাশ না করে বলেন, অভিবাবকদের অনেক কষ্ট করে বই কিনতে হয় ,তবে বই থেকে কমিশন খেতে বিদ্যালয় প্রধানরা প্রতি বছর শিক্ষার্থীদের বই পাল্টে দেয় না হলে পুরাতন বই দিয়েই শিক্ষার্থীরা পড়তে পারত ।

এ বিষষয়ে জানতে চাইলে মোবাইল ফোনে দাউদপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মহা প্রভু ও পাচঁগাও আদর্শ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন খাঁন বলেন ,আমরা শিক্ষার্থীদের বই কিনতে বলিনা এবং বই বাণিজ্য করিনা।

মেরাশানী পলিটেকনিক একাডেমির প্রধান শিক্ষক বলেন, বই বাণিজ্যের প্রশ্নই আসেনা, ৪/৫ বছর আগে শিক্ষার্থীদের বই কিনতে হত এখন তাদের কোন বই কিনতে হয়না। আমি এ স্কুলে কয়েকদিন হল যোগদান করেছি। আগের প্রধান শিক্ষক যদি করে থাকে তা আমি জানিনা। তিনি বলেন, ক্লাসে শিক্ষকরা ভালভাবে পড়ালে সহায়ক বই কিনার আর দরকার হয়না। গাইড বই যাতে মার্কেটে না থাকে সে ব্যবস্থা গ্রহণ করার দাবী জানান তিনি।

এ ব্যাপারে বিজয়নগর উপজেলার ভারপ্রাপ্ত মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আল মামুন বলেন, ২২.১১.১৬ ইং তারিখে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর এর আদেশ অনুযায়ী দেশের যে সকল বিদ্যালয় (মাধ্যমিক স্তর )জাতীয় শিক্ষাক্রম অনুসরন করে তাদেরকে এনসিটিবি প্রনীত ও অনুমোদিত পাঠ্য পুস্তক এবং শিখন সামগ্রী ব্যবহার ও পাঠ্যসুচীর বাইরে অন্য কিছু অন্তর্ভুক্ত করতে নিষেধ করা হয়েছে। তাই সরকারী বই ব্যতীত অন্য কোন বই পড়ানো সম্পুর্ণ নিষিদ্ধ। যদি কোন স্কুল এটা করে থাকে তাহলে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো: আলী আফরোজ বলেন, ক্লাসে শিক্ষকরা ভালভাবে পড়ালে সহায়ক বই কিনার আর দরকার পরেনা, আর গাইড বই ব্যবহার করা সম্পুর্ন নিষেধ ,যারা গাইডবই বিক্রিতে সহায়তা করছে তাদের বিরোদ্বে শিগ্রই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে ।






Shares