ব্ল্যাকে মনোনয়ন, বেকায়দায় আশুগঞ্জ আওয়ামী লীগ



‘লাইনে দাঁড়াইয়াও আমরা টিকিট পাইলাম না। টিকিট বেচা অইছে ব্ল্যাকে, বেশি দামে।’ আশুগঞ্জে ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন নিয়ে এক বিদ্রোহী প্রার্থীর বক্তব্য এমনই। ৬ ইউনিয়নে বিদ্রোহী প্রার্থী নিয়ে এখন বেকায়দায় উপজেলা আওয়ামী লীগ। আলোচনা আছে কয়েকটি ইউনিয়নে এই বিদ্রোহী প্রার্থীদেরই জয় হবে। আর সে কারণে দলের প্রার্থীদের জেতাতে এখন নানা কৌশল করা হচ্ছে।
বিদ্রোহী প্রার্থীদের মোবাইলে ফোন করে গোয়েন্দা সংস্থার পরিচয়ে ভয় দেখানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে, দুদিনের মধ্যে নির্বাচন ছেড়ে দেয়ার জন্য। আবার বলা হচ্ছে, তারা ভোট পেলেও জয় হবে আওয়ামী লীগ প্রার্থীদেরই। উপজেলা সদরে বসে ডিক্লেয়ার করে দেয়া হবে। পুলিশও তৎপর বিদ্রোহী প্রার্থীর সমর্থকদের পেছনে। ভয়ভীতি দেখাচ্ছে।
সরজমিন খোঁজখবরে বেরিয়ে এসেছে, উপজেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ দু-একজন নেতা নিজের লোক বিবেচনায় প্রার্থী বাছাই করেন। আর এমন মতলবি মনোনয়নে ছড়িয়ে পড়ে বিদ্রোহের আগুন। ৭টি ইউনিয়নের মধ্যে ৬টিতেই রয়েছেন বিদ্রোহী প্রার্থী। একটি ইউনিয়নে বিদ্রোহী প্রার্থী ডাবল। সম্প্রতি এ বিদ্রোহীদের বহিষ্কার করা হয়েছে। কিন্তু তা করেও ভোটের মাঠ অনুকূলে আনতে পারছে না আওয়ামী লীগ। বিদ্রোহী প্রার্থী সবারই প্রতীক আনারস। এই বিদ্রোহী প্রার্থী দমাতে নানা কৌশল আর ফন্দিফিকিরে ব্যস্ত উপজেলা ও জেলার নেতারা। জেলার শীর্ষ নেতারাও বিদ্রোহী প্রার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ করে অনুনয়বিনয় করছেন নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াতে। প্রার্থীরা নিজেরাই জানান এসব কথা। ইউপি নির্বাচনের প্রথম দফাতে ২২শে মার্চ হচ্ছে এই উপজেলার ৭ ইউনিয়নে নির্বাচন। অভিযোগ রয়েছে, তফসিল ঘোষণার পর দ্রুত প্রার্থী বাছাই করা হয়। আর এ ক্ষেত্রে নেয়া হয়নি তৃণমূলের কোনো মতামত। অনুসরণ করা হয়নি কোনো নিয়মনীতি। উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক সফিউল্লাহ মিয়া নিজেই তার লাইনের লোকজনের নাম লেখেন মনোনয়নের খাতায়। নিজের লোক বাছাইয়ে যোগ্যদের ছেঁটে ফেলে দেন তিনি। নিজের লোক নয় বলে বর্তমান এক চেয়ারম্যানকেও বাদ দিয়ে দেন। টাকাপয়সা লেনদেনের অভিযোগও আছে মনোনয়নের পেছনে। জেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি মাঈনউদ্দিন মঈন প্রকাশ্যে এমন প্রার্থী দেয়ার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন কদিন আগে।
প্রত্যক্ষদর্শী দলের নেতাকর্মীরা জানান, উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের আহ্বায়ক শাহিন সিকদারকে চড় মারার জন্যও এগিয়ে যান তিনি। বলেন, এখনই কাটাকাটি শিখে ফেলছো। নির্বাচনের পর তোমাদেরই মানুষ সাইজ করবে। জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর সামনে উজান ভাটি হোটেলে ঘটে এ ঘটনা। মাঈনউদ্দিন মঈন বলেন, আসলে আশুগঞ্জের মনোনয়ন ফেয়ার হয়নি। উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতারা যা দিয়েছেন জেলা নেতারা সেটি মেনে নিয়েছেন। জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতিকে মিসগাইড করা হয়েছে। আমি দলের পক্ষেই আছি। তবে ফেয়ার নির্বাচন হলে এখানকার ফলাফল অন্যরকম হতে পারে।
৭টি ইউনিয়নের মধ্যে তালশহর পশ্চিম ইউনিয়ন ছাড়া বাকি ৬টি ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী রয়েছেন। দুর্গাপুর ইউনিয়নে বিদ্রোহী প্রার্থীর সংখ্যা একাধিক।
তালশহর পশ্চিম ইউনিয়নে কোনো বিদ্রোহী না থাকলেও সম্প্রতি দুর্নীতির দায়ে স্কুল পরিচালনা কমিটির সভাপতির পদ থেকে বহিষ্কৃত আবু সামাকে মনোনয়ন দেয়া হয় এখানে। এতে দলের ভাবমূর্তি সংকটে পড়েছে। তালশহর এ এ আই উচ্চ বিদ্যালয় পরিচালনা কমিটির সভাপতির দায়িত্ব পালনকালে আবু শামার নানা অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েন। অবৈধভাবে নিজের দুই ছেলেকে আজীবন দাতা সদস্য করা ছাড়াও জলাশয় ইজারা প্রদান করেন নিজের ছেলেদের। নিলামের টাকা আত্মসাৎ করেন। অর্থ নিয়ে শিক্ষক নিয়োগসহ নানা অভিযোগ বেরিয়ে আসে তার বিরুদ্ধে তদন্তে। দফায় দফায় তদন্তে এসব অভিযোগ প্রমাণিত হলে বিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়।
অন্য ৬টি ইউনিয়নের মধ্যে চরচারতলা ইউনিয়নে মনোনয়ন দেয়া হয় আয়ুব খানকে, আড়াইসিধা ইউনিয়নে মো. সেলিম, তারুয়া ইউনিয়নে মো. ইদ্রিস মিয়া, দুর্গাপুর ইউনিয়নে জিয়াউল করিম খান সাজু, লালপুর ইউনিয়নে মোরশেদ মাস্টার ও শরীফপুর ইউনিয়নে সাইফ উদ্দিন। আর এসব ইউনিয়নের বিদ্রোহীরা হচ্ছেন চরচারতলা ইউনিয়নে আশুগঞ্জ উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক জিয়াউদ্দিন খন্দকার, দুর্গাপুর ইউনিয়নে উপজেলা আওয়ামী লীগ সদস্য জাকির হোসেন বাদল ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মোয়াজ্জেম হোসেন মাজু, আড়াইসিধা ইউনিয়নে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সদস্য কামরুল হাসান মোবারক, শরীফপুর ইউনিয়নে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ সদস্য তাজুল ইসলাম, লালপুর ইউনিয়নে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সহসভাপতি আবুল খায়ের, তারুয়া ইউনিয়নে ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক বাদল সাদির। এই বিদ্রোহী প্রার্থীরা উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক হানিফ মুন্সির লোক বলে পরিচিত। সে কারণে বিদ্রোহী প্রার্থী দেয়ার দোষ চেপেছে হানিফের ওপর। সবাই জানেন আহ্বায়ক সফিউল্লাহ মিয়ার সঙ্গে হানিফ মুন্সির দ্বন্দ্বের কারণে এদের মনোনয়ন দেয়া হয়নি।
সরজমিন খোঁজখবর নেয়ার সময় জানা যায়, দুর্গাপুর ইউনিয়নের সোহাগপুর গ্রামের ১৮টি গোষ্ঠী সমর্থন দিয়েছে বিদ্রোহী প্রার্থী জাকির হোসেন বাদলকে। তার পক্ষে কাজ করছেন এলাকার বিএনপি-জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীরা। বিদ্রোহী প্রার্থী জাকির হোসেন বাদল বলেন, আমার পরিবারে ৪২০টা ভোট। তারা সবাই আওয়ামী লীগের রাজনীতি করেন। আমার চাচাতো ভাই কামাল আহমেদ ধানমন্ডি থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছেন ৬ বার। কিন্তু আমরা আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাই না। তিনি অভিযোগ করেন, তার কাছে লোক মারফত টাকা দেয়ার প্রস্তাব এসেছিল। আর বলা হয়েছিল সফিউল্লাহ মিয়ার কর্মকাণ্ড নিয়ে কথা বলা যাবে না, প্রতিবাদ করা যাবে না। কিন্তু আমি তাতে রাজি হইনি। ব্যাপারটা হয়েছে, আমি লাইনে দাঁড়িয়ে রইলাম আরেকজন ব্ল্যাকে টিকিট কেটে নিয়ে গেল। তিনি বলেন, সফিউল্লাহ জনসভা করে ঘোষণা দিয়েছেন আঙুল চুষতে, আমি পার্টির আহ্বায়ক হইনি। প্রশাসন আর কর্মী বাহিনী নিয়ে ৬টি ইউনিয়নেই জয় আনব। সে আরও লাগামছাড়া কথাবার্তা বলছে। বলছে সরকারের নির্দেশ আছে, নৌকার বাইরে আর কেউ থাকতে পারবে না।
চরচারতলা ইউনিয়নের বিদ্রোহী প্রার্থী জিয়াউদ্দিন খন্দকার বলেন, প্রত্যেক ইউনিয়ন কমিটি ভেঙে সফিউল্লাহ তার নিজের লোকজন দিয়ে কমিটি করেছেন। এখন তার কমিটির লোকজনকে দলের মনোনয়ন দিয়েছেন। জিয়া জানান, গোয়েন্দা সংস্থার নামে তাদের মোবাইলে হুমকি দেয়া হচ্ছে। পুলিশ এসে বাড়ি বাড়ি হানা দিচ্ছে। শরীফপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী তাজুল ইসলাম বলেন, ১১ হাজার টাকা দিয়ে দলের মনোনয়ন ফরম কিনে জমা দিলাম। কিন্তু ভালো-মন্দ বললো না, কোনো সান্ত্বনাও তারা দিলো না। নমিনেশন দিয়ে দিলো বঙ্গবন্ধুর পোস্টার ছিঁড়ার মামলার আসামিরে। আর এই ক্ষোভে ১৭ তারিখ মনোনয়ন দাখিল করি। তাজুল ইসলামও অভিযোগ করেন তাকে গোয়েন্দা সংস্থার পরিচয়ে একাধিকবার ফোন দেয়া হয়েছে। বলা হচ্ছে, সাইফ উদ্দিনের পক্ষে নির্বাচন করার জন্য। তাজুল ইসলাম বলেন, আমি নির্বাচনের মনোনয়ন দাখিলের পরদিন আমার মা মারা গেছেন। সে কারণে আমি নীরব। তাই আমাকে সাইফ উদ্দিনের পক্ষে নির্বাচন করার জন্য চাপ দেয়া হচ্ছে। এখানে সাইফ উদ্দিনের সঙ্গে মূলত কনটেস্ট হবে সুমনের। সে সুমনের চাচাতো ভাই। সেজন্য আনারস প্রতীকের সুমন মিয়াই এখন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে পরিচিত। তিনি বলেন, সাইফ উদ্দিন জীবনে নৌকায় ভোট দেয়নি। এবারই প্রথম সে নৌকায় ভোট দেবে। আমরাই তারুয়া গ্রামের মূল আওয়ামী লীগ। তারুয়া ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান বিদ্রোহী প্রার্থী বাদল সাদির বলেন, মোবাইলে হুমকি দিচ্ছে, আরও কত কাহিনী করতেছে। গ্রুপিংয়ের কারণে নমিনেশন দেয়া হয়নি আমাকে। যে আমার সঙ্গে ৭ বার নির্বাচন করে ফেল করেছে তারে নমিনেশন দিছে। তার বয়সও আশির কাছাকাছি। আওয়ামী লীগের এ ভুল সিদ্ধান্তের কারণে জনগণ ক্ষিপ্ত। তারা আনারসের পক্ষেই রায় দেবে। লালপুর ইউনিয়নের প্রার্থী আবুল খায়ের বলেন, আমারে সমঝোতার প্রস্তাব দিয়েছিলেন জেলার এক বড় নেতা। বলেছি সম্ভব না। খায়ের গোয়েন্দা সংস্থার ফোন পেয়েছেন জানিয়ে বলেন, তারে বলেছি- তুই যদি বাপের বেটা অছ তাইলে আমার সামনে আ। দুর্গাপুর ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের আরেক বিদ্রোহী মোয়াজ্জেম হোসেন মাজু বলেন, আশুগঞ্জ আওয়ামী লীগ দুভাগ। আমি হানিফ ব্লকের। তাই আমাকে মনোনয়ন দেবে না এটা জানা ছিল। সেজন্য মনোনয়নের জন্য তাদের কাছেই যাইনি। আড়াইসিধা ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী কামরুল হাসান মোবারক বলেন, তারা কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করেনি মনোনয়ন প্রদানে। অথচ আমাদের পুরো পরিবার আওয়ামী লীগ। আমার চাচা আজিজুর রহমান ছিলেন এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় আওয়ামী লীগার। এখন আমাকে থ্রেট দেয়া হচ্ছে। আমার বাড়ির সামনে ককটেল ফুটিয়েছে। নিজেদের নির্বাচনী অফিস নিজেরা পুড়িয়েছে। আড়াইসিধার মানুষ সবকিছুর সাক্ষী।
উপজেলা আওয়ামী লীগের ২য় যুগ্ম আহ্বায়ক হানিফ মুন্সি বিদ্রোহী প্রার্থী দেয়ার কথা অস্বীকার করেন। বলেন, আমি কেন প্রার্থী দিতে যাবো। আর প্রতীক তো আমি দিইনি। এটা নির্বাচন অফিসের ব্যাপার। আমি নৌকার নির্বাচনই করছি। উপজেলা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক সফিউল্লাহ মিয়া বলেন, মনোনয়নে কোনো ভুলভ্রান্তি নেই। কতগুলো লোক আছে জাতীয় পার্টি থেকে আওয়ামী লীগে এসেছে, আমি কেন তাদের মনোনয়ন দেবো। মনোনয়ন-বাণিজ্য প্রশ্নে তিনি বলেন, আমি নিষ্কলঙ্ক। আপনি খবর নিয়ে দেখেন আমি এককাপ চা-ও কারও কাছ থেকে খাই না। প্রতিদ্বন্দ্বী বিদ্রোহী প্রার্থীদের হুমকি দেয়ার অভিযোগও তিনি অস্বীকার করেন।সূত্র:: মানব জমিন