Main Menu

আশুগঞ্জে কামরুন্নাহার হত্যা মামলায় অগ্রগতি নেই, সংবাদ সংগ্রহের সময় সাংবাদিকের মটরসাইকেল ভাংচুর

+100%-

বিশেষ প্রতিবেদক :: ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আশুগঞ্জে শ্বশুরবাড়িতে নিহত কামরুন্নাহার তুর্ণার(২৮) মৃত্যুর ১৭দিন পার হলেও ঘটনার সাথে জড়িত কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি পুলিশ। মামলার প্রধান আসামী গৃহবধূর স্বামীকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে পুলিশের নিশ্চুপ ভূমিকা ও ধীর গতির তদন্তে মেয়ের হত্যার বিচার নিয়ে শঙ্কায় পড়েছেন নিহতের পিতা মফিজুল হক ওরফে টুক্কু।
মফিজুল হক বলেন, মামলার একমাত্র আসামী মেয়ের স্বামী আরিফুল হককে গ্রেপ্তারের বিষয়ে পুলিশের পক্ষ থেকে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। মেয়ের স্বামীর পক্ষের লোকজন পুলিশকে কোনো না কোনোভাবে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছে। তাঁর ভাষ্য, পুলিশ প্রযুক্তি ব্যবহার করে কত কিছু উদঘাটন করছেন। আরিফুলকে কেন গ্রেপ্তার করছে না পুলিশ। আরিফুল ঠান্ডা মাথায় পরিকল্পনা করে কামরুন্নাহারকে খুন করে পেছন থেকে হাত-মুখ বেধে এবং গলায় পলিথিন ও ওড়না পেচিয়ে বাড়ির পরিত্যাক্ত পানির ট্যাংকে রাখে।
কামরুন্নাহার আশুগঞ্জ উপজেলার চর চারতলা ইউনিয়নের খান বাহাদুর সরকার বাড়ির মফিজুল হকের একমাত্র সন্তান এবং একই এলাকার বাসিন্দা আরিফুল হকের স্ত্রী।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১২ সালে মফিজুল হকের আপন ছোট ভাই আমিরুল হক ওরফে ছুট্টু বড় ছেলে আরিফুল হক ওরফে রনির সঙ্গে পরিবারিকভাবে কামরুন্নাহারের বিয়ে হয়। কামরুন্নাহার ও আরিফুল সম্পর্কে চাচাতো ভাই-বোন। তাদের সাড়ে তিন বছরের সহি নামে একটি কন্যা সন্তান রয়েছে।
নিহতের পরিবার ও পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত ২৪ এপ্রিল বিকেল চারটার দিকে সকালে শ্বশুরবাড়ির পরিত্যক্ত পানির ট্যাংকে কামরুন্নাহারের লাশ দেখতে পায় স্বজনরা। পরে সন্ধ্যা ছয়টার দিকে হাত বাঁধা, মুখে পলিথিন মোড়ানো ও গলায় ওড়না প্যাঁচানো অবস্থায় কামরুন্নাহারের লাশ উদ্ধার করে ময়নাতদন্তের জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর হাসাপাতাল মর্গে পাঠায় পুলিশ। নিহত কামরুন্নাহার তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন স্বজনেরা জানান।
নিহতের পরিবার সূত্রে জানা গেছে, কামরুন্নাহার উপজেলার রওশন আরা আবদুল জলিল উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ২০০৪ সালে এসএসসি ও ২০০৬ সালে কিশোরগঞ্জের ভৈরব উপজেলার রফিকুল ইসলাম মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করে। পরে ঢাকা ইডেন কলেজ থেকে রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর পাশ করেন। কামরুন্নাহার শান্ত ও লাজুক স্বভাবের ছিল। কথা কম বলত। তার মা নাসরিন হক ২০১৫ সালের মারা যান। মায়ের মৃত্যুর আগেই বাবা মফিজুল হক তাঁর পুরো সম্পত্তির ৭৫ শতাংশ নিহত কামরুন্নাহার ও নিহত স্ত্রী নাসরিন হকের নামে লিখে দিয়েছিলেন। একইসঙ্গে একমাত্র সন্তান ও স্ত্রী হারানো ষাটোর্ধ্ব এই বৃদ্ধ নিরাপত্তাহীনতায় দিন কাটাচ্ছেন।

যেভাবে কামরুন্নাহার-আরিফুলের বিয়ে হয় :

কামরুন্নাহারের বাবা মফিজুল হক বলেন, আমার স্ত্রী নাসিরন দীর্ঘ দিন ধরে অসুস্থ ছিল। কামরুন্নাহারের মাস্টার্স পরীক্ষার পর বিভিন্ন জায়গা থেকে আমার মেয়ের জন্য বিয়ের প্রস্তাব আসতে শুরু করে। তখন থেকে আরিফুল হক (কামরুন্নাহারের স্বামী) ও তাঁর চাচাতো ভাই এ কে আবদুল্লাহ ওরফে প্রদীপ বিভিন্নভাবে প্রস্তাবগুলো ফিরিয়ে দেয়। অন্য পাত্রের সঙ্গে বিয়ে দিলে আমার সম্পত্তি অন্য জায়গায় চলে বলে এক পর্যায়ে আমিরুল হকসহ আমার অন্যান্য ভাইয়েরা আরিফুল হকের সঙ্গে কামরুন্নাহার বিয়ে দিতে বলেন। আমার স্ত্রীর অসুস্থার কথা চিন্তা করেই কামরুন্নাহারকে আরিফুল হকের সঙ্গে বিয়ে দিতে রাজী হয়।

নিহতের অন্তত পাঁচ থেকে ছয়জন স্বজন এই প্রতিবেদককে বলেন, আরিফুল মাধ্যমিকের গন্ডি পার করতে পারেনি। আরিফুল সম্পত্তির জন্যই কামরুন্নাহারকে বিয়ে করেছিল। গত তিন/চার মাস আগ থেকে পুরো সম্পত্তি নিজের নামে লিখিয়ে নেওয়ার জন্য আরিফুল হক ও তাঁর ডেনমার্ক প্রবাসী ভাই আসাদুল হক কামরুন্নাহারকে শারিরীক ও মানসিক নির্যাতন করেছে। গত ৪ এপ্রিল আসাদুল ডেনমার্কে চলে যান।

মঙ্গলবার সরেজমিন মোটরসাইকেল যোগে আশুগঞ্জ উপজেলার চরচারতলা ইউনিয়নের খান বাহাদুর সরকার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, টিন শেডের তিনটি কক্ষের বর্তমানে একা থাকছেন নিহত কামরুন্নাহারের বৃদ্ধ বাবা মফিজুল হক। ঘরের উঠান অতিক্রম করে ৫০/৬০ ফুট পূর্বদিকেই কামরুন্নাহারের শ্বশুরবাড়ি। একমাত্র সন্তান কামরুন্নাহার ও স্ত্রী নাসরিন হককে হারিয়ে তিনি এখন পাগল প্রায়। মেয়ের কথা বলতে গিয়ে অশ্রুসিক্ত হয়ে পড়েন তিনি। তিনি বলেন, আমার এখন কেউ নেই। মেয়ের হত্যাকারীরা আমাকে মেরে ফেলবে। যে কোনো ভাবেই তাঁরা তা করবেই। আমি মরে গেলে কেইসটা বন্ধ হয়ে যাবে। ঘটনা ধামাচাপা পড়ে যাবে। তিনি বলেন, আর কিছুই চায় না। মৃত্যুর আগে মেয়ের হত্যাকারীদের বিচার চাই। মেয়ের স্বামী আরিফুল হক ও তাঁর চাচাতো ভাই এ কে আবদুল্লাহকে (ঢাকার উত্তরার একটি গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে কর্মরত) গ্রেপ্তার করলেই সব বেরিয়ে যাবে।

নিহতের পরিবারের সঙ্গে কথা বলার জন্য ঢাকা অফিসের দেওয়া মোটরসাইকেলটি চরচারতলার খান মাহমুদ সরকার বাড়ির ভেতরে নিহতের শ্বশুর বাড়ির সামনে রেখে যান এই প্রতিবেদক। এই সময় এই প্রতিবেদকের মোটরসাইকেলের মোবিলের ঢাকনা, সিডিআই কয়েলের লাইন, প্লাগ ক্যাপ ছিড়ে ফেলে এবং পুরো মোবিল খুলে ফেলে। বাড়ি থেকে বের হয়ে মোটরসাইকেলের এই অবস্থা লক্ষ্য করেন এই প্রতিবেদক। বিষয়টি তিনি আশুগঞ্জ থানা পুলিশকে জানিয়েছেন।

এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নিহতের স্বজনরা বলেন, এই মামলার পুলিশের ভূমিকা রহস্যজনক মনে হচ্ছে। এতদিন হলো এখন পর্যন্ত আরিফুলের অবস্থানই সনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ। কারণ হিসেবে তাঁরা বলেন, নিহতের স্বামীর মুঠোফোন বেশ কয়েকবার খোলা পাওয়া গেছে। তাছাড়া ফেসবুকের মাধ্যমে সে বিভিন্ন জনের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। তাঁরা বলেন, আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে শুনেছি, পুলিশের সঙ্গে নিহতের স্বামী ও শ্বশুর বাড়ির বিশাল অংকের লেনদেন হয়েছে।

নিহত কামরুন্নাহারের শ্বশুর আমিরুল হক বলেন, ২৩ এপ্রিল রাত সাড়ে আটটার দিকে সর্বশেষ ছেলের বউকে ঘরে দেখেছিলাম। পরদিন সকাল ১০টায় আশুগঞ্জ বাজারে সর্বশেষ ছেলের সঙ্গে কথা হয়। আরিফুলই কামরুন্নাহারকে হত্যা করেছে এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই বলে জানান তিনি। নিজের আপন ভাই কামরুন্নাহারের বাবা মফিজুল হক নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে বলেও জানান তিনি। পুলিশকে আপনাদের পক্ষ থেকে প্রভাবিত করা চেষ্টা করা হচ্ছে প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমিও এই হত্যার বিচার চাই।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা (ওসি) ইদ্রিস মিয়া বলেন, নিহতের স্বামীসহ বেশ কয়েজনের মুঠোফোন নম্বরের কলের তালিকা এখনও হাতে আসেনি। ওই গৃহবধূর স্বামীর অবস্থান এক-দুই বার ঢাকায় দেখা গেছে। আসামীকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে।
এঘটনায় কথা বলতে নিহতের স্বামী আরিফুল হকের মুঠোফোনে একাধিকবার চেষ্টা করেও যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইকবার হোসাইন, সহকারী পুলিশ সুপার (সদর সার্কেল) দেলোয়ার হোসেন ও সহকারী পুলিশ সুপার (সরাইল সার্কেল) মনিরুজ্জামন ফকির বলেন, পুলিশ প্রভাবিত হচ্ছেন বিষয়টি সঠিক নয়। আসামী পলাতক থাকায় গ্রেপ্তার করতে সময় লাগছে। অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আগামী ১৫-২০ দিনের মধ্যে আরিফুলকে গ্রেপ্তারের আশ্বাস দেন।






Shares