ময়না হত্যার ১০ মাসেও কুলকিনারা হয়নি :: বাদীকে প্রাননাশের হুমকি
মোহাম্মদ মাসুদ :: দীর্ঘ দশ মাসেও কোন কুলকিনারা হয়নি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলের ফারজানা আক্তার ময়না (১৯) হত্যা মামলা। ঘটনার নেপথ্যে রয়েছে নানান কাহিনী। নেই কোন গ্রেপ্তার, নেই অগ্রগতি। তাই থানায় দুইজন তদন্তকারীর তদন্ত শেষে মামলাটি এখন সিআইডিতে। আসামীরা প্রভাবশালী হওয়ায় হাঁটছে না মামলার নথিপত্র। আসামীরা প্রকাশ্যে ঘুরলেও গ্রেপ্তার করা হচ্ছে না তাদের। উল্টো মামলার বাদী ময়নার পিতা নূরুল ইসলাম (৬০) সহ তার স্বজনদের দেওয়া হচ্ছে প্রাননাশের হুমকি। চরম আতঙ্ক ও উৎকন্ঠায় দিন পার করছেন ময়নার পরিবারের লোকজন। টাকা না থাকায় আলোর মুখ দেখছে না ময়না হত্যা মামলা, এমন অভিযোগ বাদী পক্ষের। নিহতের পরিবার, মামলা ও অনুসন্ধানে জানা যায়, উপজেলার লোপাড়া গ্রামের বাসিন্ধা ময়না হত্যা মামলার প্রধান আসামী আলফাজ মিয়া (৪৭)। ময়নার বাড়ি পাকশিমুল ইউনিয়নের কালিশিমুল গ্রামে। আলফাজ ময়নার ফুফাত বোন হোসেরা বেগমের স্বামী। ময়না ও হোসেরারা একই বাড়িতে পাশাপাশি ঘরে বসবাস করত। মা হারা ময়নারা অত্যন্ত দরিদ্র। বৃদ্ধ পিতার সংসারে নুন আনতে পানতা পুড়ায় অবস্থা। শ্বশুড় বাড়িতে আলফাজ প্রায়ই রাত্রি যাপন করত। এক সময় আলফাজের লোলুপ দৃষ্টি পড়ে তার মামাত শালিকা ময়নার উপর। বিষয়টি বুঝতে পেরে ময়না তাকে এড়িয়ে চলত। ময়নাকে কু-প্রস্তাব দিলে তা প্রত্যাখ্যান হয়। আলফাজ তখন কিছুটা ক্ষুদ্ধ হয়। আলফাজের চলাফেরা ও নীতি নৈতিকতা প্রশ্নবিদ্ধ ছিল তার শ্বশুর বাড়ির লোকজনের কাছে। একবার ময়নার বড় বোন রচনার (২২) স্বামী আব্বাস আলীর (২৭) ভিসাযুক্ত পাসপোর্ট তাদের বসতঘর থেকে চুরি করে নিয়েছিল আলফাজ। দেড় লাখ টাকার বিনিময়ে মাহতাব মিয়ার (৩৫) বাড়ি থেকে ওই পাসপোর্টটি উদ্ধার করা হয়েছিল। পুরো নাটকের বিষয়টি জেনে গিয়েছিল ময়না। এটাই কাল হয়ে দাঁড়ায় ময়না ও তার পরিবারের জন্য। সকলে মিলে আলফাজের শ্বশুর বাড়ির অস্থায়ী ঠিকানা ভেঙ্গে দেয়। এতে করে ময়নার উপর তার ক্ষোভ আরো বেড়ে যায়। ঘটনার আড়াই মাস আগে রাতের বেলা ময়না প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিয়ে ঘরে প্রবেশ করা মাত্র পেছনের দিক দিয়ে আলফাজ ময়নাকে জাবরে ধরে ধর্ষণের চেষ্টা করে। এ সময় ময়নার আর্তচিৎকারে স্বজনরা দৌড়ে এসে লম্পট আলফাজকে হাতেনাতে ধরে ফেলে। তারপরও থামেনি আলফাজের বর্বরতা ও নৃশংসতা। এ ঘটনার কিছুদিন পর আলফাজ ময়নাকে অপহরন করে নিয়ে গিয়েছিল। অপহরনের পর ময়নার বাবাকে চিন্তা না করার পরামর্শ দিয়ে কিছু টাকার বিনিময়ে উদ্ধারের আশ্বাস দেন। বার দিন পর টাকার বিনিময়ে ময়নাকে উদ্ধার করে বাড়িতে নিয়ে যায় আলফাজ। প্রাননাশের ভয়ে সেইদিন স্বজনদের কাছে অপহরন নাটকের বর্ণনা দেয়নি ময়না। ২০১৪ সালের ২০ জানুয়ারী। ময়নাদের পাশের বাড়িতে ওরস। ওই রাতে ময়নার চাচা আল ইসলামকে (৪৫) ওরস থেকে অপহরন করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় আলফাজ। পরে আসে ময়নাদের বাড়িতে। রাত তখন দশটা। ময়না এশার নামাজ পড়ার ওজু করার জন্য বাহিরে যায়। আর ফিরে আসেনি। প্রথমে বাড়ি ঘরে আশপাশে ও পরে আত্মীয় স্বজনের বাড়িতে খোজ করে কোথাও ময়নার সন্ধান মিলেনি। পরের দিন (২১ জানুয়ারী) সকাল বেলা তাদের বাড়ির পাশে শফিউল্লার পুকুর পাড়ে অর্ধ উলঙ্গ অবস্থায় ময়নার লাশ পড়ে থাকতে দেখা যায়। পুলিশ ময়নার লাশ উদ্ধার করে ময়না তদন্তের জন্য মর্গে প্রেরন করেন। ২৩ জানুয়ারী ময়নার পিতা বাদী হয়ে অজ্ঞাত লোকদের আসামী করে একটি হত্যা মামলা (নং-৪৪, তাং-২৩.০১.১৪) দায়ের করেন। বাদী ১০ ফেব্র“য়ারী ছয়জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরো ৩/৪ জনকে আসামী করার জন্য সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেটের আদালতে আবেদন করেন। থানাকে তদন্ত সাপেক্ষে বিষয়টি মূল মামলায় অন্তর্ভূক্ত করার নির্দেশ দেয় আদালত। তদন্তকারী কর্মকর্তা ছিলেন এস আই ফরহাদ আব্বাস। তিনি চলে যান তিন মাসের প্রশিক্ষণে। তদন্তের দায়িত্ব পান এস আই আবদুল আলীম। এ মামলার তদন্তে ছিল না কোন অগ্রগতি। পরে গত ১৭ জুন মামলাটি চলে যায় জেলার সিআইডি শাখায়। বাদী নুরুল ইসলাম জানান, প্রধান আসামী মামলা তুলে না নিলে আমাকে, ছোট ভাই সামছুল হক ও ছেলে দেলোয়ারকে প্রানে মেরে ফেলার হুমকি দিয়েছে। আমরা চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। সাক্ষী সামছুল হক বলেন, চার নাম্বার আসামী মাহতাব মিয়া অরুয়াইল ব্রীজের নিকটে মোটর সাইকেল চাপা দিয়ে আমাকে হত্যার চেষ্টা করেছে। মামলার আই ও সিআইডি’র সহকারি পরিদর্শক তাজাম্মুল হক বলেন, সুনির্দিষ্ট ভাবে সাক্ষী পাচ্ছি না। চেষ্টা করছি ভাল একটা কিছু করার জন্য। প্রধান আসামী আলফাজকে গ্রেপ্তারের জন্য সরাইল থানায় রিকোজিশন দিয়েছি অনেক আগে। তাদেরকে হুমকি দিলে আমাকে জানাতে হবে। সরাইল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ আলী আরশাদ বলেন, এটি একটি জটিল মামলা। তাই বাদীর সম্মতিক্রমে মামলাটিকে সিআইডিতে হস্তান্তর করেছি।