সরাইলের বীর বিক্রম আবুল খায়েরের যুদ্ধের স্মৃতি চারন
মোহাম্মদ মাসুদ , সরাইল থেকে ॥
১৯৭১ সালের রনাঙ্গনের সাহসী সৈনিক আবুল খায়ের (বীর বিক্রম)। দুই হাতে শত্র“ পক্ষের বুলেটের আঘাতের হত নিয়ে বেঁচে আছেন তিনি। বর্তমানে তিনি মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। নিজ হাতে অস্র চালিয়ে দেশ ও সহযোদ্ধাদের রক্ষা করেছেন। কিন্তু শত চেষ্টা করেও নিজের ছেলেকে অভিযোগ মুক্ত করতে না পারার বেদনা কূড়ে খাচ্ছে তাকে। বয়সের ভারে নতজানু আবুল খায়ের এখন বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত। আট সন্তানের জনক আবুল খায়ের এখনও সংসারের ঘানী টানছেন। মাঠে ময়দানে স্ত্রী সন্তানের কথা ভুলে জীবন বাজি রেখে যুদ্ধের স্মৃতি চারন করতে গিয়ে কেঁদে উঠেন খায়ের। তিনি জানান, তার পৈত্রিক বাড়ি চাঁদপুর জেলার ফরিদগঞ্জের কাশারা গ্রামে। তার জন্ম-১৯৩৩ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর। পিতা-মৃত লনি মিয়া। মাতা-মৃত মখসুদা খাতুন। চাকুরীর সুবাদে তিনি সরাইলের কালীকচ্ছে বাড়ি করে স্থায়ী ভাবে বসবাস করছেন। ১৯৫৩ সালের ২৫ অক্টোবর মাত্র ১৯ বছর বয়সে তিনি ই পি আর-এ যোগ দেন। ১৯৬৩ সালে তিনি একই উপজেলার পাইক পাড়া গ্রামের মাহমুদা বেগমকে বিয়ে করেন। ১৯৭১ সাল। শুরু হয়েছে স্বাধীনতা যুদ্ধ। স্ত্রী মাহমুদা বেগম, মেয়ে রওশন আরা(৫) ও ছেলে মোবারক হোসেন বকুল (২) কে নিয়ে তিনি চুয়াডাঙ্গার চার ব্যাটালিয়নে কর্মরত। তিনি তখন ল্যান্সনায়েক। যুদ্ধের ভয়াবহতায় ব্যাটালিয়নের কর্মকর্তারা নিরাপদ স্থানে চলে যেতে মাইকিং করেন। রাজাপুর বর্ডার দিয়ে তারা বেতাই গিয়ে এক হিন্দু বাড়িতে আশ্রয় নেন। সেখানে এক সপ্তাহ থাকেন। ২৫ মার্চ ১০/১২ জন হাবিলদার ও নায়েকসহ যশোরের সামন্তা ক্যাম্পে যোগ দেন। ওইদিন রাত ৪টায় রওয়ানা দিয়ে পরদিন বেলা ২টায় উৎলী ষ্টেশনে দুই কোম্পানী একত্রে মিলিত হন। পাথর বোঝাই ট্রলিতে চড়ে হেড কোয়াটারে যান। ২৭ মার্চ প্রবেশ করেন চুয়াডাঙ্গায়। পাকশি নামক ব্রীজের নিকটে গিয়ে দেখেন তুমুল যুদ্ধ। আইনুল হক নামের এক যুবক যুদ্ধ করতে করতে গুলিতে মৃত্যুবরন করেছে। কিন্তু পিছু হঠেনি। ৮নং সেক্টরে প্রথমে মেজর উসমান গণি ও পরে মেজর মনজুরের নেতৃত্বে যুদ্ধ করেন। ১৭ এপ্রিল চুয়াডাঙ্গার মেহেরপুরে চলে যান। বুড়িপোতা ক্যাম্পে থেকে যুদ্ধ করতে থাকেন। ২২ আগস্ট রাতের তান্ডব লিলার কথা সর্বক্ষন তাড়া করে ফিরে আবুল খায়েরকে। নিজের ডিউটি শেষ করে রাত ১২টায় ঘুমিয়ে পড়েন তিনি। ১২ জনের অন্য একটি দলের ডিউটি চলছে। গভীর রাত। তারা খবর পেল পাকবাহিনী আসছে। দ্রুত দুইভাগে বিভক্ত হয়ে যুদ্ধ শুরু করেন। ক্যাম্পের ৫শত গজ দূরে পাঞ্জাবীরা অবস্থান নিয়েছে। এ ভুল তথ্যটি তাদের চরম বিপদে ঠেলে দেয়। প্রকৃতপক্ষে তারা তখন ২০/২৫ গজ দূরে। তাদের পুরো ক্যাম্প ঘিরে ফেলেছে। রাইফেল তাক করে পজিশনে চলে গেলেন আবুল খায়ের। মূহুর্তের মধ্যে একজন মুক্তিযোদ্ধার বুক ঝাঝরা হয়ে গেল। কারন এ লোকটা গুলি বহন করতো। খায়েরের ১২ ম্যাগজিন গুলি তার কাছে ছিল। অবস্থা খুবই খারাপ। শত্র“পক্ষ গুলি ছূড়ে এগুচ্ছে। পেছনে তাকিয়ে দেখেন খায়ের সহযোদ্ধারা পালিয়েছে। তিনি একদম একা। নিশ্চিত মৃত্যুকে মেনে নিয়েই বিসমিল্লাহ বলে গুলি শুরু করেন। প্রতিজ্ঞা করলেন পিঠে গুলি লাগতে দিবেন না। তবে বুকে গুলি নিবেন। ১০/১২ জন পাকসেনাকে আহত করলেন। একটু সরে গিয়ে অস্রটি রেখে গাছের পেছনে দাঁড়ানোর সাথেই ডান হাতে ১০টি, বাম হাতে ১টি গুলি বিদ্ধ হয়। রক্ত ঝরছে। ব্যাথায় অস্থির। যন্ত্রনায় ছটফট করছেন। বাঁচার জন্য চেষ্টা থামাননি। দুটি হাত দু’পায়ের মাঝে চেপে ধরে বুক সামনে রেখে পেছনে যেতে থাকেন। আবু বকর নামের সহযোদ্ধাকে পানি পার করে দিতে বলেন। ভয়ে ভয়ে পার করে দেয় সে। এ যুদ্ধে ১৭ জন পাঞ্জাবী ও রাজাকার মারা যায়। বকর খায়েরের দুই হাত কাঁচা পাটের আঁশ দিয়ে বেঁধে দেয়। ২৩ আগষ্ট ভোরে তিনি ভারতে পৌঁছেন। রেডক্রসের কমান্ডার রবি দত্ত চিকিৎসা শুরু করেন। পরে তাকে কৃষ্ণ নগরে নেয়া হলে সেখানে রাখেনি। বারাকপুর হাসপতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে খায়েরের হাত কেটে ফেলতে বলে। ২৪ আগষ্ট তার জ্ঞান ফিরে। চিৎকার দিয়ে বলে উঠেন-হাত ফেলে দিলে বেঁচে থেকে লাভ কি? নভেম্বরের শেষের দিকে বেতাই আসলে ছেলে তাকে চিনে না। বাপ বলে ডাকে না। ১৮ ডিসেম্বর ব্যাটালিয়নের সাথে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। স্বাধীনতার পর আবার তিনি চাকুরীতে যোগদান করেন। ১৯৯১ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর নায়েক সুবেদার পদ থেকে বীর বিক্রম আবুল খায়ের অবসর গ্রহন করেন। তার খেতাব নং-৩৫৭। দেশের জন্য যুদ্ধ করে তিনি এখন ১টি গ্রামে কোন রকমে মাথা গোজে বসবাস করছেন। বড় ছেলে সামান্য বেতনে ১টি ফার্মে চাকুরী করছে। আরেক ছেলে বিডিআর বিদ্রোহের আসামী হয়ে দীর্ঘদিন জেল হাজতে ছিলেন। ছয় মাস আগে কারাবাস শেষ করে একেবারে বেরিয়ে এসেছেন। বর্তমানে একটি প্রাইভেট ফার্মে চাকুরী করছেন। বৃদ্ধ আবুল খায়ের বর্তমানে পেনশন ও মুক্তিযোদ্ধা ভাতা মিলিয়ে মাসে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা পান। স্বাধীনতার ৪০ বছর পেরিয়ে গেলেও তিনি যুদ্ধাহত ভাতা পাচ্ছেন না। দ্রব্য মূল্যের চরম উর্ধ্ব গতির বাজারে স্ত্রী সহ ১১ সদস্যের সংসারে কষ্ঠে শিষ্ঠে চলছেন এ বীর বিক্রম। লজ্জায় কারো কাছে মুখ খুলেন না যুদ্ধাহত এ মুক্তিযোদ্ধা। বীর বিক্রম আবুল খায়ের অত্যন্ত আক্ষেপের সাথে বলেন, যুদ্ধ ক্ষেত্রে মরে গিয়ে ও বেঁচে গেলাম কেন? এখন ভালই তো আছি। কার জন্য যুদ্ধ করলাম! কেন যুদ্ধ করলাম?