সরাইলের বিটঘর গণহত্যা, স্বাধীনতার ৪৬ বছরেও সংরক্ষিত হয়নি বধ্যভূমি
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় যে কয়টি গণহত্যা সংগঠিত হয়েছে সবেচয়ে ভয়ংকর ও লোমহর্ষক হলো সরাইল উপজেলার বিটঘর গণহত্যা। সরকারি হিসেবে এখানে ৮০ জনকে হত্যার কথা উল্লেখ থাকলেও এলাকাবাসীর দাবি এ সংখ্যা শতাধিক। আজও সেই দিনের ভয়াল স্মৃতি তাড়িয়ে বেড়ায় শহীদ পরিবারে সদস্যদের। এত বিপুল পরিমাণ শহীদের রক্তে রক্তাক্ত যে মাটি স্বাধীনতার ৪৭ বছেরও তা সংরক্ষণে নেয়া হয়নি কোন উদ্যোগ। শহীদ পরিবারের পাশাপাশি, মুক্তিযোদ্ধাদেরও দাবি দ্রুত এ স্থানটিকে সংরক্ষণের।
একাত্তরের উত্তাল মার্চে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অসহযোগ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করে। আন্দোলনের ঝড় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলসহ বিভিন্ন থানা, ইউনিয়ন এবং গ্রাম পর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে পাকিস্তানী বাহিনী সরাইল থানার সদর এলাকা দখল করে নেয়। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস পানিশ্বর ইউনিয়নের গ্রামগুলো ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদ অবস্থান ও পারাপারের কেন্দ্র। এই সুযোগে ওইসব গ্রামে গড়ে উঠছিল মুক্তিবাহিনীর ট্রানজিট ক্যাম্প! পরিকল্পনা মোতাবেক ২৯শে অক্টোবর রাতে মুক্তিযোদ্ধারা সরাইল থানা আক্রমণ করে। প্রতিবাদে অক্টোবরের শেষদিকে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় বিটঘর ও আশেপাশের গ্রামগুলোতে সাঁড়াশি আক্রমণের পরিকল্পনা করে।
পরিকল্পনামত ৩১শে অক্টোবর সকাল বেলা সরাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও আশুগঞ্জ থেকে দুইশো পাকিস্তানী সেনা বিটঘর গ্রামটি ঘিরে ফেলে। রাজাকারেরা পথ দেখিয়ে ঘরগুলো দেখিয়ে দেয় এবং পাকিস্তানী সেনাদের নিয়ে ঘরে ঘরে তল্লাশি চালিয়ে নিরীহ নিরপরাধ গ্রামবাসীকে গ্রামের পাশ দিয়ে উত্তর দক্ষিণে প্রবাহিত ছোট খালের পূর্বপাশে জড়ো করে। তারপর ৮-১০ জনকে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে পর্যায়ক্রমে গুলি করতে থাকে। কাউকে কাউকে বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করে। আজও সেই ভয়াল স্মৃতি তাড়িয়ে বেড়ায় শহীদ পরিবারে সদস্যদের।
কথা হয় শহীদ পরিবারের সদস্য ছালামত মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় খারগরের এই বধ্যভূমিতে ৮০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে ধরে নিয়ে সারি বদ্ধ ভাবে গুলি করে হত্যা করে। আধা মরা রেখেই সবাইকে গনকবর দিয়ে ফেলে। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পার হলেও এই গনকবরের কোন চিহ্নরূপ নেই।
এ বিষয়ে কথা স্থানীয় বাসিন্দা আরেক শহীদ পরিবারের সন্তান ছালামত মিয়ার সাথে। তিনি কষ্টের সাথে বলেন, আমার বাবাকে এখানে পাকিস্তানি বর্বর বাহিনীরা গুলি হত্যা করেছে। এখন পর্যন্ত এখানে কোন স্মৃতি চিহৃ নেই। আমাদের পরিবারের পক্ষ থেকে এখানে সরকারকে ১৫ শতক জায়গা দান করা হয়েছে। যাতে শহীদের স্মৃতিফলক গুলো নামসহকারে স্থাপন করা হয়।
স্থানীয় একাধিক এলাকার বাসিন্দরা বলেন, ১৯৭১ সালে বিটঘর গ্রামে একই দিনে ৮০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা তা বিরল ঘটনা। এই গ্রামে যারা শহীদ হয়েছে তাদের প্রত্যেকের নামে তালিকা প্রকাশ করে একটি স্মৃতিসৌধ নিমার্ণ করা হোক এটা আমাদের সরকারের কাছে দাবি। যাতে ভবিষ্যৎত প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস জানতে পারে। কাদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশের সূর্য পশ্চিম আকাশ থেকে পূর্ব আকাশে ওঠেছে।
এ বিষয়ে কথা হয় জেলা মুক্তিযোদ্ধা সাবেক কমান্ডার হারুনুর অর রশিদের সাথে। তিনি বলেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যেসব গনকবর রয়েছে সে গুলো যাতে ভালভাবে সংরক্ষণ করা হয়। প্রতিটি স্মৃতিসৌধ ও গনকবরে যেন একজন প্রহরী নিয়োগ করা হয়। সে জন্য সরকারে কাছে দাবি মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি চিহৃ রক্ষার্থে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে।