সৌদী’র হাসপাতালে কাঁদছে....
মৃত্যুর আগে স্বজনদের সাথে আমার দেখা হবে তো?”



মোহাম্মদ মাসুদ, সরাইল : “আমার বুঝি বাংলাদেশে কেউ নেই। স্ত্রী সন্তানরা কেমন আছে? তাদেরকে দেখতে খুবই ইচ্ছা করছে। মনে হলে কলিজাটা ছিঁড়ে যায়। হাঁটতে মন চায়। পারছি না। কেউ সহায়তা করলে পারতাম। এমন কেউও তো এখানে নেই। বাংলাদেশে যেতে মনটা সবসময় ছটফট করছে। আমাকে সাহায্য করতে এখনো একটি লোক ও আসেনি। মৃত্যুর আগে স্বজনদের সাথে আমার দেখা হবে তো?” সৌদী আরবের রিয়াদের একটি হাসপাতালের বেডে শুয়ে গত ৯ মাস ধরে এমন সব বিলাপ করে কাঁদছে সরাইলে বাবুল মিয়া (৪৩)। তার বাড়ি উপজেলার নোয়াগাঁও ইউনিয়নের ইসলামাবাদ (গোগদ) গ্রামে। ওদিকে অর্থাভাবে পরিবারের লোকজনও কিছুই করতে পারছে না। মা স্ত্রী ও সন্তানরা শুধু কাঁদছে।
বাবুলের পারিবারিক সূত্র জানায়, ইসলামাবাদ গ্রামের প্রয়াত আরজু মিয়া ছিলেন নি:সন্তান। ৪৩ বছর আগে ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেল ষ্টেশন এলাকা থেকে ৫ বছর বয়সের একটি শিশুকে (বাবুল) কুঁড়িয়ে আনেন। খুবই যত্নে তাকে লালন পালন করেন। ১৯-২০ বছর আগে একই গ্রামের কুদরত আলীর মেয়ে নারগিছ বেগমের সাথে বাবুলের বিয়ে হয়। ইতিমধ্যে বাবুল ২ সন্তানের জনক হন। বর্তমানে ছেলে তাফাজ্জুল হোসেন (১৩) ১০ পারা কোরআন মুখস্থ করেছে। মাদরাসায় পড়ছে। আর মেয়ে হাকিমা বেগম (১৭) মাদরাসার পড়া শেষ করে সেখানেই শিক্ষকতা করছেন। বিয়ের পরই বাবুল সৌদী আরব চলে যান। সর্বশেষ ছুটিতে এসেছিলেন ৩ বছর আগে। ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে রিয়াদে গিয়ে আর ফিরেননি বাবুল। মাঝে মধ্যে সামান্য কিছু টাকা পাঠাতেন পরিবারের ৫ সদস্যের জন্য। গত ৪ বছর আগে বাবুলের পিতা আরজু মিয়া মারা যান।
প্রবাসে অর্থাভাবে আকামা ঠিক করতে পারেনি বাবুল। গত ৯ মাস আগে হঠাৎ শয়ন কক্ষেই অসুস্থ হয়ে যায় সে। সেখানকার পুলিশ বাবুলকে রিয়াদের ছানাইয়া আল-হারিজ রোডের আল-রাবেয়া হাসপাতালে ভর্তি করেন। বাবুলের শরীরের এক পাশ শক্তি হারিয়ে ফেলে। কারো সহায়তা ছাড়া হাঁটতে চলতে পারে না। গত নয় মাস ধরে ওই হাসপাতালেই আছে বাবুল। পরিবার, আত্মীয় স্বজন কারো সাথে যোগাযোগের ব্যবস্থা নেই। সেই দেশ থেকেও কেউ তাকে দেখতে যাচ্ছে না। একা বিছানায় শুয়ে শুধু চোখের জল ফেলে কাঁদছেন। আর দেশে আশার জন্য ছটফট করছেন। কিন্তু নিজে থেকে ওঠে দাঁড়ানোর ক্ষমতা যে নেই তার। টাকা পাঠিয়ে তাকে দেশে আনার মত ক্ষমতাও নেই তার পরিবারের।
গতকাল সরজমিনে দেখা যায়, ২০ বছর প্রবাসে থেকেও একটি দু’ছালা টিনের ঘরেই বসবাস করছে বাবুলের গোটা পরিবার। সকলের চোখে মুখে বেদনা ও বিষাদের চাপ। স্ত্রী ছেলে মেয়ের চিৎকারে ভারী হয়ে ওঠে বাড়ির পরিবেশ। আশপাশের লোকজনও খুবই ব্যথিত। গতকাল সৌদীতে বসবাসকারী বিজয়নগর উপজেলার চান্দুরার সিদ্দিক মিয়া ইমুতে বলেন, বাবুলের অনেক স্বজন টাকার ভয়ে দেখতে হাসপাতালে যাচ্ছে না। আমি তাকে স্বচোখে দেখেছি। খুবই কষ্টে আছে। দিনরাত শুধু কাঁদছে। আর চারিদিকে স্বজন খুঁজছে। খাবারেরও কষ্ট করছে। দেশে আসতে ব্যাকুল সে। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছেন তারা স্থানীয় বাংলাদেশ এ্যাম্বাসির সাথে যোগাযোগ করেছিলেন। এ্যাম্বাসি খুব একটা গুরুত্ব দেয়নি। স্ত্রী নারগিছ কান্নাজড়িত কন্ঠে বলেন, আমরা গত ২ বছর ধরে অনেক কষ্টে দিন পার করছি। আমার বাচ্ছা দুটি রাতে বাবার জন্য শুধু কাঁদে। তাদের আহার যোগার করাই দায়। এরপরও উনার চিকিৎসার জন্য বছরে ১০ মন চাল দেয়ার শর্তে ১ লাখ টাকা এনে পাঠিয়েছিলাম। ৩ বছরে ৩০ মন চাল সুদ দিয়েছি। আমাদের সব শেষ। আর পারছি না। আমার স্বামীকে দেশে আসতে সরকার ও বিত্তশালীদের সহায়তা কামনা করছি। আপনাদের সহায়তাই আমার অসহায় দুটি বাচ্চা তাদের বাবাকে ফিরে পেতে পারে। ছেলে তোফাজ্জল ও মেয়ে হাকিমা তাদের বাবাকে দেশে ফিরে পেতে সরকারের প্রধানের কাছে আকুতি জানাচ্ছে।