সরাইলে হাতুড়ে গাইনির অপচিকিৎসায় মা ও নবজাতকের মৃত্যুর অভিযোগ
সরাইল প্রতিনিধি : ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইলে ভূয়া ও হাতুড়ে গাইনি চিকিৎসক ছালেহা বেগমের (৫৮) অপচিকিৎসায় প্রসূতি মা ও নবজাতকের মৃত্যুর অভিযোগ ওঠেছে। নিহত স্বপ্না বেগম (১৮) উপজেলার কালিকচ্ছ ইউনিয়নের নন্দিপাড়ার কুতুব উদ্দিনের মেয়ে। স্বামীর বাড়ি একই ইউনিয়নের দৌলতপাড়ায়। ঘটনার পর থেকে ভাড়া বাসায় তালা দিয়ে পালিয়েছে ছালেহা।
গত বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় সরাইল উপজেলা ৫০ শয্যা হাসপাতাল সংলগ্ন উচালিয়াপাড়ায় ছালেহার ভাড়া বাসায় এ ঘটনা ঘটেছে। প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ধাত্রী না হয়েও ছালেহা গত ১৫ বছর ধরে গাইনি চিকিৎসা ও সন্তান প্রসবের কাজ করছেন বলে জানিয়েছেন তার প্রতিবেশীরা। স্বপ্নার স্বজন ও প্রতিবেশীদের অভিযোগ ছালেহা বেগমের অপচিকিৎসার শিকার হয়ে অতিরিক্ত রক্তক্ষরনে স্বপ্নার মৃত্যু হয়েছে। ২/১ জনপ্রতিনিধি ও কিছু প্রভাবশালী ঘটনার পর থেকেই টাকার বিনিময়ে বিষয়টি ধামা চাপা দিতে লড়ছেন।
নিহতের পরিবার, প্রত্যক্ষদর্শী ও স্থানীয়রা জানান, কুতুব উদ্দিনের ৬ সন্তানের মধ্যে স্বপ্না সবার বড়। এক বছর আগে দৌলতপাড়ার নান্নু মিয়ার ওমান প্রবাসী ছেলে শফিকুল ইসলামের সাথে বিয়ে সরাইল সরকারি কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী স্বপ্নার। শ্বশুর বাড়ির স্বজনদের পরামর্শে গত বৃহস্পতিবার সকাল ছয়টায় স্বপ্নাকে নিয়ে যায় কথিত গাইনি চিকিৎসক ছালেহার ভাড়া বাসায়। ছালেহা ৫শত টাকা নিয়ে প্রথমে রোগীকে ইনজেকশন দিয়েছে। এরপর সারা দিনে ৪টি স্যালাইন পুশ করেন। সাথে বেশ কয়েকটি ছোট বোতলের পানি সিরিঞ্জের সাহায্যে স্যালাইনে মিক্স করেন। স্বপ্নার সাথে শুরু থেকেই ছিল তার দাদী শাহারা বেগম (৬৫)। এক সময় ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হন স্বপ্নার উকিল শ্বশুর রুপ মিয়াও। কিছুক্ষণ পরই হয়ে যাবে বলে ১২ ঘন্টা পার করে দেন ছালেহা। ওদিকে রোগীর অবস্থা ক্রমেই অবনতির দিকে যেতে থাকে। সন্ধ্যা ৬ টার দিকে স্বপ্নার সন্তান প্রসব হয়। কিন্তু জন্মের পরই বাচ্চাটি অজ্ঞান। কিছুক্ষণ পরই নবজাতকের মৃত্যু ঘটে। মা স্বপ্নার অবস্থাও আশঙ্কাজনক। অতিরিক্ত রক্তক্ষরনের কারনে স্বপ্নার শাররীক অবস্থা দ্রুত অবনতির দিকে যেতে থাকে। উপায় না দেখে ছালেহা সরাইল হাসপাতালের সাবেক ইউএইচও ডা. আবদুল কাদেরকে ডেকে আনেন। তিনি রোগীকে দ্রুত সরকারি হাসপাতালে নেয়ার পরামর্শ দেন। তড়িঘড়ি স্বপ্নাকে নিয়ে যাওয়া হয় আনন্দ ক্লিনিকে। সেখানে না রাখায় শেষে নিয়ে যায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে। হাসপাতালে কর্তব্যরত চিকিৎসক নিরীক্ষা শেষে স্বপ্নাকে মৃত ঘোষণা করেন। মা ও শিশুর লাশ নিয়ে বাড়ি ফিরেন স্বপ্নার স্বজনরা। ঘটনার পরই ভাড়া বাসায় তালা ঝুলিয়ে গা ঢাকা দিয়েছেন ছালেহা। বন্ধ রয়েছে তার মুঠোফোনটিও।
সরজমিনে স্বপ্নার বাবার বাড়িতে গেলে কথা হয় পরিবার ও স্বজনদের সাথে। স্বপ্নার উকিল শ্বশুর রুপ মিয়া বলেন, ছালেহা বেগম মেয়েলি চিকিৎসার কিছুই জানেন না। পড়া লেখাও জানে না। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত অযথা রোগীকে আটকে রেখেছেন। তার অপচিকিৎসার শিকার হয়েই নবজাতক সহ স্বপ্নার মৃত্যু হয়েছে। এ মৃত্যুর জন্য ছালেহাই দায়ী। নিহত স্বপ্নার পিতা কুতুব উদ্দিন কান্না জড়িত কন্ঠে বলেন, আমি কি করব? এখন কি আর আগের দিন আছে। স্বপ্নার শ্বশুর বাড়ির সিদ্ধান্তে ওই মহিলার কাছে নিয়েছে। আমার মেয়ের মত আর যেন কোন মেয়ে এমন অপচিকিৎসার শিকার না হয়। আর কোন মা বাবার বুক যেন এমন অকালে খালি না হয়।
তবে নাম প্রকাশ না করার শর্তে নন্দিপাড়ার কয়েকজন লোক জানান, ঘটনার পর থেকেই ২/১ জন জনপ্রতিনিধি ও কতিপয় প্রভাবশালী লোক বিষয়টি ধামাচাপা দিতে ওঠে পরে লেগেছেন। ছালেহার বাসার আশপাশের কিছু মহিলা পুরুষ বলেন, মহিলা ডাক্তার না। পড়ালেখাও ফাইভের নিচে। এরপরও উনি নাকি গাইনি ডাক্তার। সারাদিনই রোগী আসে আর যায়। গত বৃহস্পতিবার ওই রোগীটি এখানেই মারা গেছে। আনন্দ ক্লিনিকের মালিক আলার উদ্দিন জুরু বলেন, আমার এখানে নিয়ে আসার পর দেখি অটোরিকশার সিট রক্তে সয়লাভ। বিদায় করে দিয়েছি। সরাইল হাসপাতালের পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা কোহিনুর বেগম বলেন, ছালেহা বেগম প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত কোন ধাত্রী নয়।
যেভাবে গাইনি চিকিৎসক হলেন ছালেহা: ছালেহার বাড়ি কসবা উপজেলায়। তার স্বামী মো. কাইয়ুম মিয়া ছিলেন সরাইল হাসপাতালের প্যাথলজিষ্ট। চাকুরির সুবাদেই ছেলে মেয়ে নিয়ে এখানে বসবাস করছেন ছালেহা। একজন সিনিয়র নার্সের সাথে কিছুদিন থেকে কাজ দেখেছেন। মাঝে মধ্যে গাইনি চিকিৎসকদের কাজ দেখেছেন। এভাবেই তিনি আস্তে আস্তে গাইনি চিকিৎসক বনে গেছেন। দীর্ঘ ১৫ বছর ধরে ছালেহা বাসায় নিয়ে গাইনি চিকিৎসা করে টাকা কামাই করছেন। এখন হাতুড়ে চিকিৎসক ছালেহারও গ্রাম এলাকায় রয়েছে অনেক দালাল। দালালরা রোগী দিলেই টাকা পায়। আবার ছালেহাও রোগীর অবস্থা বেগতিক দেখলে প্রাইভেট হাসাপাতালে পাঠিয়ে কামাই করছেন পাইস।
সরাইল হাসপাতালের আশেপাশে আরো ৩-৪ জন ছালেহা রয়েছে। যারা নিয়মিতই গ্রামগঞ্জ থেকে আসা রোগীদের সাথে চিকিৎসা নিয়ে প্রতারণা করছেন।