ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ফতোয়ায় ভেঙ্গে যাওয়ার পথে ১৪ বছরের সংসার
শামীম উন বাছির ঃ
নারী বাদের উত্থান ঘটেছে। সর্বত্রই নারীরা এগিয়ে। তারপরও সমাজ ব্যবস্থায় পদে পদে নির্যাতিত নিপিড়িত হচ্ছে অবলারা। ফতোয়াবাজদের কবলে পড়ে নারী আজ বিপন্ন। একনাগাড়ে একযুগের বেশী সময় ধরে স্বামীর সংসারে ঘর করার পর অবৈধ স্ত্রী বলে কোনঠাসা এক নারী। একের পর এক গ্রাম্য সালিশ বৈঠকে সেই নারীকে এক ঘরে করে রাখা হয়েছে গত তিন মাস ধরে। স্থানীয় ফতোয়াবাজরা ফতোয়া দিয়েছে তার বিবাহ বৈধ নয়। ১৪ বছর অবৈধ সংসার করার জন্য তিরস্কার করা হয়েছে। কাফ্ফারা (জরিমানা) হিসেবে স্বামী-স্ত্রীকে ১০ হাজার টাকা ধার্য করা হয়। তবে স্ত্রীকে জরিমানা করা হয় ১লক্ষ টাকা এবং গ্রাম ছেড়ে অন্যত্র চলে যেতে বলা হয়। সালিশের রায় উপেক্ষা করলে গ্রামবাসীকে ১০ হাজার টাকা জরিমানা জুতাপেটার নির্দেশ দেয়া হয়। ফতোয়াবাজদের এই রায়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে ছুটছে অসহায় নাজমা বেগম (৪৫)।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া তালশহর গ্রামের নাজমা বেগম (৪৫) কিশোরী থাকা অবস্থায় আশির দশকে প্রথম ভাগে বিয়ে হয় সদর উপজেলার নরসিংসার গ্রামের আবদুল করিমের সঙ্গে। বিয়ের পরে ভালই চলছিল স্বামীর সংসার। কিশোরী নাজমার একে একে দুটি পুত্র হয়। এরপর থেকে কারনে অকারনে তার উপর চলতে থাকে অমানুষিক নির্যাতন। এ অবস্থায় স্বামীর বাড়িতে টিকতে না পেরে বাবার বাড়িতে আশ্রয় নেয় নাজমা। ৮৮ সালের ১৯ জুন স্বামী তাকে বাইন তালাক দেয়। সবকিছু মেনে নিয়ে সেখানেই চলতে থাকে। এরই মাঝে ছেলে দুটি বড় হয়। এক পর্যায়ে বিদেশ যাবার জন্য উদ্যোগ নেয়। এ সুযোগে স্বামী আবদুল করিম গ্রামবাসীকে নিয়ে নাজমাকে নিয়ে আবার সংসার করার ফন্দি আটে। নাজমা রাজি না থাকলেও সমাজ সংসারের চিন্তা করে রাজি হয়। এর পর ২০০১ সালে ছেলেদের চাপে পিতা আব্দুল করিম নরসিংদীর এক মাওলানার মাধ্যমে নতুন করে বিয়ে পড়িয়ে ঘর সংসার শুরু করে। এরপর কেটে যায় এক যুগ। স্থানীয় একটি মহল তাদের এক যুগের ঘর সংসারকে অবৈধ আখ্যা দেয়। শুরু হয় একের পর এক অত্যাচার। এর মাঝে ছেলে দুটি বড় হয়ে প্রবাসী জীবন যাপন করে। মায়ের নামে টাকা পাঠাতে থাকে। প্রায় ১৫ লক্ষ টাকায় নাজমা স্বামীর বাড়িতে ঘর উঠায়। স্বামীকে কিনে দেয় ৯ লক্ষ টাকা মূল্যের জমি। মায়ের সুখের জন্য প্রবাসী ছেলেরা টাকা পাঠাতে থাকে। এরই মাঝে একাধিক বিয়ে করে আবদুল করিম। বায়না ধরে নাজমা পিত্রালয়ে চলে যেতে। এসব ঘটনায় মামলা করার পর গ্রামবাসী মুচলেকা দিয়ে আবদুল করিমকে আদালতের মাধ্যমে মুক্ত করে আনে। কিন্তু তারপরও তার উপর অত্যাচার নির্যাতন থামছেনা। গত ৫/৬ মাস ধরে তার উপর চলতে থাকে নানা ধরনের নির্যাতন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া ২৪ ডটককে নাজমা জানান, গত ৬ মাস ধরে একের পর এক গ্রাম্য সালিস বসা হয়েছে। এতে সালিশকাররা ফতোয়া দেয় তার বিয়ে অবৈধ। ১৩ বছর ধরে স্বামীর সংসার করায় জরিমানা করা হয় ১ লক্ষ টাকা। স্থানীয় ফতোয়াবাজরা কাফারা স্বরূপ এ টাকা দিতে চাপ দেয় তার উপর। শুধু তাই নয়, গত ৩ মাস ধরে তাকে এক ঘরে করে রাখা হয়েছে। তার সঙ্গে আশপাশের লোকজনের কথা বলতে বারন। তার হাতের খাবার গ্রহণও নিষিদ্ধ। এই গ্রাম ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে সমাজপতিরা। অবৈধ স্ত্রী স্বামীর বাড়িতে থাকার সুযোগ নেই বলে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়। এসবের নেতৃত্বে রয়েছে তার স্বামী আব্দুল করিম। তার স্বামী আবদুল করিম সাংবাদিকদের সব কিছু অস্বীকার করে বলেন, স্ত্রী তার কোন কথা শোনেন না। তার সাথে সব সময় খারাপ আচরন করে। তার বিরুদ্ধে মামলা দিয়ে জেল খাটিয়েছে। নাটাই দক্ষিণ ইউপি মেম্বার ফরিদ উদ্দিন জানান, এসব ঘটনার জন্য তার স্বামীই দায়ী। এ ধরনের কোন সালিশের সাথে আমি জড়িত নই।