রাজনৈতিক কর্মসূচীতে জড়ানো হচ্ছে শিশুদেরও
বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মসূচীতে শিশুদের ব্যাপক হারে ব্যবহার হতে দেখা যাচ্ছে। চারিদিকে মুহুর্মুহু গুলি ছুড়ছে পুলিশ, আর এরই মধ্যে দুটি পক্ষ একে অপরের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত। ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের দশ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে সোমবার দিনভর এমন সংঘর্ষ চলেছে দুটি পক্ষের মধ্যে। একটি পক্ষে পুলিশের সাথে সরকারি দলের সমর্থকেরা, অপর পক্ষ স্পষ্টতই হেফাজতে ইসলামের সমর্থক, যদিও অনুসন্ধানে দেখা গেছে এই পক্ষে বিরোধী বিএনপি এবং জামায়াত-শিবির সমর্থিত অনেক মানুষ রয়েছে। দুই তরফেই প্রচুর শিশুকে অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়। তাদের অনেকেরই বয়স দশ বছরের কম, অনেক ক্ষেত্রেই সংঘর্ষে লিপ্ত বয়স্ক মানুষের কন্ঠ ছাপিয়ে শোনা গেছে শিশুদের চিৎকার। এর আগে হেফাজতে ইসলাম যে কর্মসূচী পালন করেছে তাতে বহু মাদ্রাসা ছাত্রকে যোগ দিতে দেখা গেছে, যাদের বয়স আঠারো বছরের অনেক কম। রবিবার মধ্যরাতে পুলিশের সাঁড়াশি আক্রমণে পালিয়ে যাওয়া এমন বহু শিশু সোমবার ঢাকার পথে পথে ঘুরছিল। এমন একজনের সাথে কথা হয় আমার, যার বয়স কোনোমতেই পনেরোর বেশী নয়। ছেলেটি বলছিলো সে নোয়াখালীর একটি আলিয়া মাদ্রাসার নবম শ্রেনীর ছাত্র। সে রাতে পুলিশের তাড়া খেয়ে দলছুট হয়ে গেছে। এখন সে নোয়াখালীতে ফিরে যেতে চায়। কিন্তু কোথা দিয়ে কীভাবে যেতে হবে সেটা সে জানে না। শুধু গত কয়েকদিন সহিংস কর্মসূচীতে নয়, সাম্প্রতিক সময়ে প্রায় সব ধরণের রাজনৈতিক কর্মসূচী কিংবা অরাজনৈতিক সংগঠনের বড় ধরণের আন্দোলন-বিক্ষোভে দেখা গেছে শিশুদেরকে ব্যাবহার করতে। যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তির দাবিতে শাহবাগে সম্প্রতি যে দীর্ঘ আন্দোলন হয়, সেখানেও দেখা গেছে একই চিত্র। “আমরা কোনো মতেই চাই না শিশুদের এমন জায়গায় ব্যবহার করা হোক যেখানে সহিংসতা হবার সম্ভাবনা আছে। সেখানে শিশুরা অংশ নিক। “ আমিনুল ইসলাম, ইউনিসেফের শিশু নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ শাহবাগ আন্দোলনের ফেসবুক মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত শাহবাগে সাইবার যুদ্ধ নামের সাইটে প্রকাশিত একটি ছবিতে আমি দেখছিলাম, একটি মোমবাতি প্রজ্জলন কর্মসূচীতে একটি শিশুকে কাঁধে করে নিয়ে গেছে তার অভিভাবক। শিশুটির মাথায় বাঁধা ব্যান্ডানায় লেখা, রাজাকারের ফাঁসি চাই। অপরদিকে, শাহবাগ আন্দোলনের বিরোধী পক্ষ হিসেবে পরিচিত একটি ফেসবুক পাতা, বাঁশের কেল্লায় একটি শিশুর মৃতদেহের ছবি প্রকাশিত হয়েছে। সেটির ক্যাপশনে লেখা, সপ্তম শ্রেণীর পড়ুয়া এই শিশুটি গত আটাশে ফেব্রুয়ারী মৃত্যুদন্ডপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদীর মুক্তির দাবিতে একটি সংঘর্ষে জড়িয়ে পরে মারা যায়, এবং সে ইসলামী ছাত্র শিবিরের সমর্থক। এই বিষয়গুলো নজরে এনেছিলাম জাতিসংঘের শিশু বিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের শিশু নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ আমিনুল ইসলামের। মি. ইসলাম বলছিলেন, ‘সরকারী হোক কিংবা সরকারবিরোধী যে কোন জায়গাই হোক না কেন, আমরা কোনো মতে চাই না শিশুদের এমন জায়গায় ব্যবহার করা হোক যেখানে সহিংসতা হবার সম্ভাবনা আছে। সেখানে শিশুরা অংশ নিক। এটা যদি কোনো অভিভাবক করেন, আইনের দৃষ্টিতে সেটা তারা করতে পারেন না’। “অভিভাবকদেরই খেয়াল রাখতে হবে যে তাদের শিশুরা যাতে এধরনের কোনো সহিংসতা কিংবা রাজনৈতিক কর্মসূচীর সংস্পর্শে আসতে পারে” তারিকুল ইসলাম, নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মিস্টার ইসলাম আরো জানান, বাংলাদেশে শিশু বিষয়ক যে আইন রয়েছে সেখানে স্পষ্টভাবে এধরণের কর্মসূচীতে শিশুদেরকে ব্যবহার করাটাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেই সাথে, জাতিসংঘের শিশুরক্ষা বিষয়ক সনদেও বাংলাদেশ স্বাক্ষর করেছে, যেখানে কোনও রাজনৈতিক কর্মসূচীতে শিশুদের ব্যাবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। তবে এক্ষেত্রে আইন প্রয়োগের চাইতে অভিভাবকদের উদ্বুদ্ধ করবার উপর বেশী গুরত্বারোপ করছেন দেশটির নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রনালয়ের সচিব তারিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘আমরা চাই শিশুরা তাদের অভিভাবকের সাথে থাকুক। এ ব্যাপারে অভিভাবকদের যতভাবে সাহায্য করা যায় সেটা আমরা করছি, যাতে করে অভিভাবকরাই খেয়াল রাখতে পারে যে তাদের শিশুরা এধরনের কোনো সহিংসতা কিংবা রাজনৈতিক কর্মসূচীর সংস্পর্শে আসতে পারে’। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, আঠারো বছরের কমবয়েসী সব মানুষকেই শিশু হিসেবে গণ্য করে জাতিসংঘ। |