ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বেপরোয়া রাজ যোগালী থেকে সাংবাদিক হওয়া রেজাউল



পুলিশের কথিত সোর্স ও নির্মাণ শ্রমিক থেকে সাংবাদিক নাম ধারণ করা গন্ডমূর্খ রেজাউলের বিরুদ্ধে কিশোরীকে শ্লীলতাহানির অভিযোগে ব্রাহ্মণবাড়িয়া আদালতে মামলা হয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নারী ও শিশু নির্যাতন আদালতের বিশেষ ট্রাইব্যুনালে চলতি বছরের ১৮ জুলাই ধর্ষণ চেষ্টা মামলা দায়ের করেছেন শ্লীলতাহানির শিকার ঐ তরুনী। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন। এই ঘটনা রেজাউলের সামান্য একটু নমুনা মাত্র।
রাজমিস্ত্রীর যোগালী কাম সোর্স কাম সাংবাদিক নামধারী ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় রেজাউলের বিরুদ্ধে বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। রেজাউলের ধারাবাহিক অপকর্মে তার গ্রামের বাড়ি সদর উপজেলার মজলিশপুর ইউনিয়নের বাকাইল গ্রামবাসী তাকে গ্রামচ্যুত করেছে। অবৈধ গ্যাস বাণিজ্য, হেফাজতের মামলার আসামী বানিয়ে দেয়া বা রেহাই দেয়া, যে কোনো মামলার আসামীকে গ্রেফতার বা খালাস- সবই করতেন রেজাউল। কখনো তিনি সোর্স, কখনো তিনি সাংবাদিক, কখনো ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের সিনিয়র সাংবাদিকের প্রতিনিধি, কখনো সরকারি কর্মকর্তা- এসব করেই গত ৩টি বছর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দাপিয়ে বেড়িয়েছেন রেজাউল। এর মাঝে বেশ কয়েকবার গণধোলাইয়ের শিকারও হয়েছেন তিনি। তবু কিছুতেই থামছেন না রেজাউল।
কে এই রেজাউল : গ্রামের বাড়ি সদর উপজেলার মজলিশপুর ইউনিয়নের বাকাইল গ্রামে। কথিত সোর্স বা দালাল হিসেবে রেজাউলের পিতা মৃত সহিদ মিয়াও গ্রামবাসীকে জ্বালিয়েছেন। সহিদ মিয়াও ছেলেকে সেভাবেই তৈরি করেছেন। মৃত সহিদ মিয়া দেখে যেতে পারেন নি তার ছেলেকে শেষ পর্যন্ত গ্রামচ্যুত করা হয়েছে। পড়াশুনা না করা রেজাউল ছোট্ট বয়সেই যোগ দেয় নির্মাণ কাজের সহযোগি হিসেবে (যোগালি)। পরবর্তীতে রাজমিস্ত্রী হিসেবে সুনাম কিনলেও মূলত যোগালি হিসেবেই তিনি কাজ করতেন। এরপরের অধ্যায় অনেক ঘটনাবহুল। ঘটনার ধারাবাহিকতায় ত্যক্ত-বিরক্ত ও নিরূপায় হয়ে বাকাইল গ্রামবাসীকে তাকে গ্রামচ্যুত করেছে। সেই থেকে তার আবাস ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভার শেরপুরে। শেরপুরের মানুষও স্বস্তিতে নেই রেজাউলের ধান্ধায়।
যত অভিযোগ রেজাউলের বিরুদ্ধে : নির্মাণ কাজের মাঝখানেই হঠাৎ করেই হয়ে উঠেন সাংবাদিক। শার্ট-প্যান্ট ও কটি পড়ে বাহারি চশমায় অন্যরূপে আবির্ভূত হন তিনি। মোটরসাইকেলের সামনে ‘প্রেস’ লিখে দাবড়িয়ে বেড়ান জেলার এ মাথা-ও মাথা পর্যন্ত। কখনো বিজয়নগর, কখনো কসবা কিংবা নাসিরনগর। বাদ যায়নি বাঞ্ছারামপুর কিংবা নবীনগরও। আখাউড়া উপজেলায় যাতায়াত তো সপ্তাহের প্রায় ৫ দিনই। ২০২০ সালে বিজয়নগরের পাহাড়পুর ইউনিয়নে সরকারের প্রকল্প বাস্তবায়ন নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ তুলেছিলেন রেজাউল। সেখানে প্রকল্পের অনিয়ম ব্যাখা করতে না পারায় গণরোষের শিকার হয়ে উপরি পেয়েছেন গণধোলাই। অনুমোদিত কিংবা অঅনুমোদিত- যেখানেই গ্যাসের পাইপ লাইনের কাজ চলে সেখানেই হাজির রেজাউল।
সাংবাদিকতার দাপট ও পুলিশের ভয় দেখিয়ে কামাই রোজগারের চেষ্টায় থাকেন রেজাউল। কখনো গ্যাস ফিল্ডের ডিজিএম বা কর্মকর্তা কখনো জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার গোয়েন্দা বাহিনীর সদস্য তিনি। এভাবে কয়েকটি ঘটনার পর গ্যাসের ঠিকাদার বা সংশ্লিষ্ট লোকদের গণধোলাইও খেয়েছেন তিনি। গণধোলাই খেয়ে আরও তেতে উঠেছেন যোগালী রেজাউল। উত্তর সুহিলপুর এলাকার একটি নিরঅপরাধ ছেলেকে পুলিশের সাথে যোগসাজশে ইয়াবা দিয়ে ফাঁসিয়ে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগও রয়েছে রেজাউল মিয়ার বিরুদ্ধে। একসময়ের নির্মাণকাজের সহযোগিকেও ছাড় দেননি রেজাউলের। রাজযোগালীর কাজ করার সময় রেজাউল তার সহযোগিদের একের এর এক সহযোগিকে নাজেহাল করেছেন। কয়েকটি পরিবারের কাছ থেকে টাকাও আদায় করেছেন রেজাউল। টাকা না দিলে তাদের ঘরে লুকিয়ে ইয়াবা রেখে তাদেরকে পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছেন।
২০১৯ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর মডেল থানার সামনে থাকা একটি সিএনজি অটোরিকশার ভিতর ইয়াবা আছে বলে পুলিশ দিয়ে সিএনজি ড্রাইভারকে আটক করে কিছু রোজগারের চেষ্টা করেছিলেন। এ সময় থানার তৎকালীন এসআই জামিরুলও উপস্থিত ছিলেন। পুলিশ গাড়িতে কিছু খুঁজে পায়নি। রেজাউলের ধান্ধাবাজি সোর্সগিরিতে ক্ষিপ্ত হয়ে অভিযুক্ত ড্রাইভারসহ অন্যান্যরা রেজাউলকে থানার সামনেই গণধোলাই দেন। এসআই জামিরুলও এ ঘটনায় বিব্রতবোধ করে অভিযুক্তদের নিকট ঘটনাস্থলেই ক্ষমা চেয়েছেন। অন্যান্য ঘটনার মত এই ঘটনার ভিডিওটিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়। সর্বশেষ ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হেফাজতে ইসলামের তান্ডবের ঘটনায় বিশেষ লাভ হয় রেজাউল ও তার লাইনের পুলিশের লোকজনের। বিভিন্ন গ্রামের নিরীহ জনসাধারণকে ফাঁসিয়ে দেয়ার কথা বলে, ফুটেজে তাদের ছবি আছে বলে প্রচুর মানুষকে হয়রানী করেছেন, টাকাও কামিয়েছেন। চলতি বছরের ১৮ জুলাই কিশোরীকে ধর্ষণ চেষ্টার মামলা হলেও পুলিশ বলছে আসামী পলাতক। অথচ নামধারী ‘প্রেস’ লিখে শহরে রেজাউল ঘুরে বেড়ালেও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নিকট রেজাউল পলাতক। কেন, তা তারাই জানে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভার শেরপুরেও পড়েছে রেজাউলের থাবা। বাকাইল গ্রাম থেকে তাকে বের করে দেওয়ার পর তিনি নিবাস গড়েছেন শেরপুরে। সুযোগ পেলেই রেজাউল রিপোর্ট করে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন। শেরপুরের গুলজার খানসহ বেশ কয়েকজন এই রেজাউলের বিরুদ্ধে অনৈতিক ও সাংবাদিকতার দাপট দেখিয়ে টাকা আদায় চেষ্টার অভিযোগ তুলেছেন। চলতি বছরের শুরুর দিকে গুলজার খানের বোনের বাড়িতে গিয়ে এখানে অবৈধ গ্যাস চলছে বলে টাকা দাবী করেন। ওই গৃহকর্ত্রী তার সাথে পরে যোগাযোগ করবেন বললে রেজাউল চলে আসেন। পরে গুলজার খান রেজাউলকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করলে রেজাউল বিষযটি বুঝানোর চেষ্টা করেন। এ সময় গুলজার খান ক্ষিপ্ত হলে এলাকার কয়েকজন রেজাউলকে মারধর থেকে রক্ষা করেন।
চলতি বছরের ১৮ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়া নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে সোর্স রেজাউলের বিরুদ্ধে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগ করেছেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভার ভাদুঘরের নোয়াপাড়া গ্রামের মো. দুলাল মিয়ার স্কুল পড়ুয়া কন্যা কিশোরী সানজিদা আক্তার সায়মা। মামলায় বাদীনি অভিযোগ করেন- সোর্স রেজাউল বাদীনির পিতাকে মৎস্যজীবী জেলে হিসেবে সরকারি কার্ড এবং বাদীনির মাকে সরকারিভাবে সেলাই মেশিন পাইয়ে দেয়ার কথা বলেন। পরবর্তীতে রেজাউলের খবরের ভিত্তিতে ঘটনার তারিখ ও সময়ে মৎস্যজীবী কার্ড ও সেলাই মেশিন নেয়ার জন্য বাদীনি রেজাউলের বাসায় আসলে বাদীনিকে একা পেয়ে রেজাউল তাকে যৌন হয়রানি করেন ও ধর্ষণের চেষ্টা করেন।
ভুক্তভোগীদের বক্তব্য : রাজযোগালীর কাজে রেজাউলের একসময়ের সহযোগি একাধিক রাজমিস্ত্রী ও যোগালি এ প্রতিবেদককে বলেন, রেজাউল আমাদের সাথে নির্মাণ কাজ করতো। সে কখন পড়াশুনা করল কখন সাংবাদিক হল- আমরা জানি না। তারা বলেন- রেজাউল তাদের নিকট এখন দুঃস্বপ্ন। তার বিপক্ষে কথা বললে সে পুলিশের ভয় দেখাত, ইয়াবা দিয়ে ফাঁসিয়ে দেয়ার হুমকি দিত। কয়েকজনকে রেজাউল সর্বশান্ত করে ছেড়েছে।
রাজমিস্ত্রীর সহযোগি যোগালী কয়েকজন বলেন- আমরা দুজন অনেক জায়গায় একসাথে কাজ করেছি। সে একদিন হঠাৎ এসে বলে সে সাংবাদিক হয়ে গেছে। এসব কাজের আর প্রয়োজন নেই। রেজাউলের চক্রান্তের শিকার হয়েছেন- এমন একজন সহযোগি বলেন- একবার এক ঘটনায় তার বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেওয়ায় ইয়াবা দিয়ে ফাঁসিয়ে দিবে হুমকি দিয়ে কয়েকবার কয়েকটি পরিবার থেকে টাকা নিয়েছে।
বাকাইল গ্রামের বেশ কয়েকজনের সাথে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তারা বলেন- রেজাউল বাকাইল গ্রামের বহু নিরঅপরাধ লোকজনকে ঘরে ইয়াবা রেখে ফাঁসিয়ে দিয়ে পুলিশ দিয়ে টাকা আদায় করত। বেশ কয়েকজন অভিযোগ করে বলেন- শুধু রেজাউলের বিরুদ্ধে যাওয়ায় মিথ্যা অভিযোগে তাদেরকে পুলিশ রিমান্ডে নিয়ে মারধর করেছে।
বাকাইল গ্রামবাসী জানায়- সোর্স রেজাউল এলাকায় আসতে পারে না। নানা অপকর্মের জন্য তাকে গ্রাম থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। তার বাড়ি-ঘর কিছুই নেই। তার বাবাও ছিল সোর্স। ভাল মানুষকে পুলিশ দিয়ে ধরিয়ে দিয়ে ফাঁসিয়ে দিতো। স্থানীয়রা বিষ্ময় প্রকাশ করে বলেন- গন্ডমূর্খ রাজ যোগালী রেজাউল কিভাবে সাংবাদিক হয়? রেজাউল সোর্স হিসেবে টাকা রুজি করে আর সাংবাদিক পরিচয় দিয়ে এসব অপকর্ম আড়াল করে। গ্রামবাসী প্রশ্ন তুলেন- রেজাউলের এসব অপকর্মে সাংবাদিকদের কোনো দায় নেই?
নানান অপকর্মের পর গা ঢাকা দিয়েছেন সাংবাদিক ও সোর্স নামধারী গন্ডমূর্খ রেজাউল মিয়া। সাংবাদিকতার নাম দিয়ে, সোর্সের নাম ব্যবহার করে রেজাউল ঘুরে বেড়াচ্ছে শহরে, সদর থানার সামনে, কোর্ট এলাকায়। অথচ পুলিশ বলছে- আসামী রেজাউল পলাতক, তাই তাকে গ্রেফতার করা যাচ্ছে না।
সাংবাদিক রেজাউল শুধু সাংবাদিকদের নয়, সমাজেরও বিষফোড়া। গন্ডমূর্খ হয়েও কিভাবে সাংবাদিক হওয়া যায় তাই দেখিয়েছেন রেজাউল। ছিলেন যোগালী, করতেন বিল্ডিং এর মালামাল চুরি। রেজাউলের পিতা সহিদ মিয়া ছিলেন রাজমিস্ত্রী কাম সোর্স। তার ছেলে রেজাউল সোর্স কাম সাংবাদিক। সিনিয়র সাংবাদিক নেতৃবৃন্দের নাম ভাঙিয়ে সুবিধা আদায়সহ পুলিশ, জাতীয় নিরাপত্তা সংস্থার দায়িত্বে থাকা বিভিন্ন সরকারি গোয়েন্দা সংস্থার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নামভাঙিয়ে সাধারণ মানুষকে ভয়ভীতি দেখিয়ে মোটা অংকের টাকা-পয়সা প্রতারণা করে হাতিয়ে নেওয়ার একাধিক অভিযোগ রয়েছে রেজাউল মিয়ার বিরুদ্ধে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিশিষ্ট রাজনীতিবীদ ও সমাজ সেবক কমরেড নজরুল ইসলাম বলেন- রাজনীতির সুবাদে বিভিন্ন এলাকায় আমার যোগাযোগ আছে। প্রায়ই রেজাউল নামের এক সাংবাদিক বা সোর্সের বিরুদ্ধে অনৈতিক কর্মকা-ের অভিযোগ শুনতে হয়েছে। জেনেছি সে একসময় রাজমিস্ত্রী বা যোগালি ছিল।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রেসক্লাবের সাবেক সাধারণ সম্পাদক দীপক চৌধুরী বলেন- রেজাউল কি থেকে কি হয়ে গেল, সেটা আমাদেরও বুঝতে অনেক সময় লেগেছে। তার বিরুদ্ধে মানুষকে হয়রানী, প্রতারণা ও সোর্স হয়ে নিরীহ লোকজনকে ফাঁসানোর বিস্তর অভিযোগ রয়েছে জেলা শহরের সাংবাদিকদের কাছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাংবাদিক মহল, সুধী ও সচেতন মহল মনে করছেন-হঠাৎ গজিয়ে উঠা হলুদ সাংবাদিকের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ ব্যবস্থা না নিলে একের পর এক রেজাউল আসতেই থাকবে। নেতৃবৃন্দ এসব ধান্ধাবাজদের নির্মূলে প্রশাসনের সুদৃষ্টি আকর্ষণ করেন।
(প্রতিবেদনটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বহুল প্রচারিত একুশে আলো পত্রিকায় প্রকাশিত)