২৮ অক্টোবর শনিবার কমিউনিটি পুলিশিং ডে
জনকল্যাণে গণমুখী পুলিশিং —–মো. মিজানুর রহমান পিপিএম (বার)—–
পুলিশ সম্পর্কে সাধারণ মানুষের নেতিবাচক ধারণা এখন পাল্টেছে। উপনিবেশক শাসনামলের শাসক ও শোষকের ভূমিকাকে পেছনে ফেলে ‘বাংলাদেশ পুলিশ’ আজ একটি জনবান্ধব প্রতিষ্ঠানে রূপ নিয়েছে। প্রিয় স্বদেশের জন্য পুলিশ ও জনগণ এক কাতারে দাঁড়িয়ে কাজ করে যাচ্ছে। পাশাপাশি গণমানুষের কল্যাণের স্বার্থে ঢেলে সাজানো হয়েছে বর্তমান পুলিশিং ব্যবস্থাকে। এর ফলে বাংলাদেশ পুলিশিং ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। গতানুগতিক পুলিশিংয়ে সীমাবদ্ধ না থেকে জনসম্পৃক্ততাকে কাজে লাগিয়ে একটি সুস্থ, সুন্দর ও অপরাধমুক্ত সমাজ গঠনে পুলিশও যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে সেই ধারণা আমাদের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশ পুলিশের সম্মানিত ইন্সপেক্টর জেনারেল (আইজিপি) এ.কে.এম শহীদুল হক বিপিএম, পিপিএম মহোদয়। নিঃসঙ্কোচে স্বীকার করি যে, আমি আইজিপি স্যারের এই মহতী দর্শন দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত।
পুলিশ সুপার হিসেবে গোপালগঞ্জে পর আমার দ্বিতীয় কর্মস্থল ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় যোগদানের পর থেকেই জেলাবাসীকে নিয়ে নানা জনকল্যাণমুখী কর্মকান্ড চালিয়ে যাচ্ছি। আজ ২৮ অক্টোবর শনিবার কমিউনিটি পুলিশিং ডে। তাই সার্বিক অপরাধ দমন ও জনগণের দুর্ভোগ লাঘবে গণমুখী পুলিশিং কার্যক্রমের কয়েকটি চিত্র এখানে তুলে ধরছি।
১। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে গণমুখী পুলিশিং কার্যক্রম
ঘটনা- ১
রেহেনার (২৬) ছদ্মনাম; পাঁচ বছর হল বিয়ে হয়েছে। বিয়ের পর থেকেই যৌতুকের জন্য নির্যাতন করত তার স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকজন। নির্যাতন সহ্য করতে না পেরে তিন বছর আগে সাত মাসের শিশু পুত্রকে নিয়ে বাবার বাড়ি চলে যায় সে। এখনো পর্যন্ত তার স্বামী তার ও সন্তানের ভরণপোষণের ব্যয়ভার বহন করে না। গরীব বাবার আশ্রয়ে স্বামী পরিত্যক্তা হয়ে দিন কাটছে রেহেনার।
ঘটনা- ২
সাবিনা (৩০) ছদ্মনাম; ব্যক্তি জীবনে এক কন্যা সন্তান ও স্বামী নিয়ে তার সুখের সংসার হওয়ার কথা ছিল। অভাবের সংসারে ঝগড়া ও কথা-কাটাকাটির এক পর্যায়ে স্বামী তাকে মৌখিকভাবে তালাক দেয়। কন্যাসহ সেও আশ্রয় নেয় বাবার বাড়িতে। সময়ের ব্যবধানে সাবিনা তার স্বামীকে ক্ষমা করে দিয়ে কন্যা শিশুসহ ফিরে যেতে চায় স্বামীর সংসারে। কিন্তু বাঁধ সাধেন স্বজন ও সমাজপতিরা। শরীয়তের দোহাই দিয়ে সাবিনাকে ‘হিল্লা’ বিয়ে দিতে চান তারা।
ঘটনা- ৩
মরিয়রম (৫২) ছদ্মনাম; ৩৫ বছর আগে মাত্র দশ হাজার টাকা কাবিনে বিয়ে হয়েছিল তার। প্রবাসী স্বামীর পাঠানো টাকা দিয়ে সংসার চালানো ও ছেলে- মেয়েদের বড় করে তোলা ছিল একমাত্র ধ্যান-জ্ঞান মরিয়মের। জমানো টাকা আর বিভিন্নজনের কাছ থেকে অর্থঋণ নিয়ে ঢাকায় জমি কিনে বাড়ি তৈরি করেন তিনি। ভাগ্যের নির্মম পরিহাস, সেই বাড়িতে আজ ঠাই নেই তার। কারণ, ১৮ বছর পর স্বামী বিদেশ থেকে এসে তাকে তালাক দিয়ে নতুন করে সংসারী হয়েছেন। অন্যদিকে আশ্রয়হীন মরিয়ম পাওনাদারদের বাক্যবাণে জর্জরিত।
ঘটনা- ৪
রেখা (১৪) ছদ্মনাম; সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী। স্কুলে যাতায়াতের পথে এক গ্রাম্য বড় ভাই তাকে উত্যক্ত করত। এ সমস্যার সমাধানে সমাজপতিদের দ্বারস্থ হয় রেখার পরিবার। গ্রাম্য সালিশে ঐ উত্যক্তকারীর সাথে রেখার বিয়ের দিন ধার্য্য করা হয়।
এসব ঘটনা গভীরভাবে পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাই যে, আইনের ফাঁক গলে আজও নারীরা কতটা অসহায়। সমাজ ও পরিবার হতেই নারী নির্যাতনের সূচনা। আবার এর সমাধানও লুকিয়ে আছে সমাজ ও পরিবারের মাঝেই। এ যেন কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মতো একটা কাজ। আর এই কাজটাই অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় পুলিশ সুপারের কার্যালয়ে ‘উইমেন্স সাপোর্ট সেন্টার’ সেলটির মাধ্যমে করে যাচ্ছি। গত ২০১৫ সালের ৫ আগস্ট যৌতুক ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধে সোচ্চার কমিউনিটি পুলিশিং এর সদস্যদের সাথে নিয়ে উইমেন্স সাপোর্ট সেন্টারের যাত্রা শুরু করি।
যৌতুক ও নারী নির্যাতনের মতো সামাজিক ক্ষত সারিয়ে তোলা এক-দুইদিনের কাজ নয়। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় ‘উইমেন্স সাপোর্ট সেন্টার’ এর কার্যক্রম পরিচালনার মাধ্যমে পুলিশ ও বিভিন্নস্তরের পেশাজীবি মানুষ একযোগে কাজ করে যাচ্ছে। বলতে দ্বিধা নেই ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলাবাসীর সর্বাত্মক সহযোগিতার কারণে জেলা পুলিশের এ উদ্যোগ আজ যে সফলতা পেয়েছে, তা রীতিমত ঈর্ষণীয়।
২। মাদকের করাল গ্রাস হতে যুবসমাজকে রক্ষার্থে গণমুখী পুলিশিং কার্যক্রম
মাদকের রাহুগ্রাসে যুব সমাজ এখন ধ্বংসের মুখে। ভারতের ত্রিপুরা সীমান্তবর্তী জেলা হওয়ায় ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মাদকর সহজলভ্যতা বেশী। জেলার আখাউড়া, বিজয়নগর ও কসবা থানা এলাকা সীমান্ত ঘেঁষা হওয়ার কারণে এখানে মাদকের প্রকোপ সবচেয়ে বেশি। মাদকসেবীরা মাদকের অর্থের যোগান দিতে গিয়ে নানা অপরাধমূলক কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়ে পড়ে। খুন, চুরি, ডাকাতি ও দস্যুতা ইত্যাদি অপরাধের সাথে জড়িত ব্যক্তিদের পূর্ব ইতিহাস যাচাই করতে গিয়ে অনেক সময়ই আমরা দেখি এসব অপরাধীরা মাদক সেবনে অভ্যস্ত। এমনকি উইমেন্স সাপোর্ট সেন্টারে আগত নির্যাতনের শিকার এমন নারীরা প্রায়ই অভিযোগ করেন যে, তাদের স্বামীরা নেশাগ্রস্থ হয়ে তাদের মারধর করে। সুতরাং বলা যায়, অপরাধ জগতে মাদকের একটা সুদূরপ্রসারী প্রভাব রয়েছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে আমরা মাদকের ব্যাপারে জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করেছি। কেবলমাত্র মাদকের চালান উদ্ধার ও মামলা রুজু অথবা আসামী গ্রেফতারের মধ্যেই আমরা আমাদের পুলিশিং কার্যক্রমকে সীমাবদ্ধ রাখিনি বরং বিভিন্নস্তরের মানুষকে সাথে নিয়ে মাদকের বিরুদ্ধে জনসচেতনতা তৈরির কাজ করছি। এক্ষেত্রে আমি কোনো পরিসংখ্যান দেব না। বরং একটা বাস্তব উদাহরণ দিতে চাই। সীমান্তবর্তী থানা হিসেবে আখাউড়াতে মাদকের আধিক্য বেশী। আখাউড়া উত্তর ও দক্ষিণ ইউনিয়নের সাধারণ জনগণ লাঠি-সোটা হাতে পাহাড়া দেয়। যাতে করে মাদক ব্যবসায়ীরা গ্রামে অনুপ্রবেশ করতে না পারে। গ্রামবাসীর এই উদ্যোগ এটাই প্রমাণ করে যে, আমরা আমাদের পুলিশিং ব্যবস্থায় আপামর জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করতে পেরেছি।
৩। জঙ্গিবাদ নিরসনে গণমুখী পুলিশিং কার্যক্রম
সাম্প্রতিক সময়ে দেশ উত্তাল করা ইস্যু- ‘জঙ্গিবাদ’। আমাদের তরুণ সমাজ আজ নানা কারণে বিভ্রান্ত হয়ে ঝুঁকে পড়ছে জঙ্গিবাদের দিকে। আর এই অবস্থা হতে উত্তরণের জন্য আমরা জেলা পুলিশের উদ্যোগে বিভিন্ন সময়ে সর্বস্তরের জনসাধারণের পাশাপাশি স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসার ছাত্র-ছাত্রী ও অভিভাবকের সাথে জনসংযোগ করেছি। জঙ্গিতৎপরতার বিভিন্ন তথ্যাদি প্রদানে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছি বলেই আমরা বিশ্বাস করি। ইতোমধ্যে জেলা পুলিশের উদ্যোগে আমরা ভাড়াটিয়াদের তথ্য হালনাগাদ করেছি এবং ভাড়াটিয়াদের তথ্য সম্বলিত একটি পূর্ণাঙ্গ ডাটাবেজ তৈরির বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। জঙ্গিবাদ বিরোধী সভা, সমাবেশ, মানববন্ধনসহ অন্যান্য প্রচারণাতে জেলা পুলিশ সর্বোতভাবে সহায়তা করছে। বিভিন্ন মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল-কলেজে জঙ্গিবাদ বিরোধী প্রচারণা চালাতে সাধারণ জনগণকে উৎসাহিত করা হচ্ছে।
সর্বোপরি, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা পুলিশিং ব্যবস্থায় জনগণের স্বতঃষ্ফূর্ত অংশগ্রহণের ফলে পুলিশিং এর গতিশীলতা এসেছে।
৪। সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে গণমুখী পুলিশিং কার্যক্রম
২০১৪ সালে ৪টি দাঙ্গা-হাঙ্গামা, ৯৯টি খুন এবং ১৮টি ডাকাতি মামলা রুজু হয়। ২০১৫ সালে ১টি দাঙ্গা-হাঙ্গামা, ৮৫টি খুন এবং ১২টি ডাকাতি মামলা রুজু হয়। ২০১৬ সালে কোনো দাঙ্গা-হাঙ্গামার মামলা রজু হয়নি, তবে ৯টি ডাকাতি ও ৬১টি খুনের মামলা রজু হয়েছে। উপরিউক্ত তথ্যাদি এটাই প্রমাণ করে যে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। আর এটা সম্ভব হয়েছে অপরাধ অনুসন্ধানসহ অপরাধী সনাক্তকরণ এবং অপরাধ সংশ্লিষ্ট তথ্যাদি প্রদানে ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসীর সর্বাত্মক সহযোগীতায়। এমনকি ব্যাপক গণপ্রচারণার ফলে অনেকেই অপরাধজগত থেকে ফিরে এসে বর্তমানে সুস্থ, স্বাভাবিক জীবন-যাপন করছে।
শতাব্দীকাল ধরে পুলিশের যে চিত্র মানুষের মনে দাগ কেটে আছে তা একদিনে দূর হবার নয়। তবে পুলিশিং এ কমিউনিটিকে সম্পৃক্ত করার যে ধারণাটি আইজিপি স্যার বাংলাদেশে প্রবর্তন করেছেন, তাতে করে বাংলাদেশ পুলিশের ইমেজের ইতিবাচক পরির্তন ঘটছে বলে আমরা বিশ্বাস করি। চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি থাকাকালীন সময়েও আইজিপি স্যার কমিউনিটি পুলিশিং কার্যক্রমকে জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে সচেষ্ট ছিলেন। ‘পুলিশই জনতা, জনতাই পুলিশ’ আক্ষরিক অর্থেই এই মূলমন্ত্রে উজ্জ্বীবিত হয়ে জেলা পুলিশ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়াবাসী একযোগে কাজ করে যাচ্ছে।
লেখক: পুলিশ সুপার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া।