১২ জানুয়ারী -নির্মম সহিংসতার বছরপূর্তি:: ধরা পড়েনি মূল অপরাধীরা



ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ইতিহাসে এক কলঙ্কজনক দিন। গত বছরের এই দিনে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় এক মাদ্রাসাছাত্রের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে ব্যাপক ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের কারণে অন্তত একশ’ কোটি টাকার ক্ষতি হয়। এ ঘটনায় ১৩টি মামলা হলেও একটি মামলারও অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেওয়া হয়নি। গ্রেফতার হয়নি মূল হামলাকারীরা। ফলে ক্ষুব্ধ সংস্কৃতিকর্মী ও মামলার বাদীরা।
কি ঘটেছিল ১২ জানুয়ারী ২০১৬ -তে
মাদরাসা ছাত্রের মৃত্যু : বিভিন্ন স্থানে ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ, শহরে ৪ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মোবাইল কেনাকে কেন্দ্র করে মাদ্রাসা ছাত্র ও ব্যাবসায়ী – ছাত্রলীগের মধ্যে গত সোমবার রাতের চার ঘন্টা ব্যাপী ত্রিমুখী সংঘষের্র ঘটনায় এক মাদ্রাসা ছাত্র নিহত হয়েছে। নিহতের নাম হাফেজ মাসুদুর রহমান (১৮)। মঙ্গলবার ভোরে জেলা সদর হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়। নিহত মাসুদ ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর শহরের ভাদুঘর এলাকার হাফেজ ইলিয়াস মিয়ার ছেলে। তিনি শহরের কান্দিপাড়া জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসার অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিলেন। তার সহপাঠীদের অভিযোগ, গত রাতে পুলিশ তালা ভেঙ্গে মাদ্রাসার প্রবেশ করে ছাত্রদের উপর হামলা করে। এসময় পুলিশের গুলিতে বেশ কয়েক জন আহত হয়। আহতদের মধ্যে গুরুতর আহত হাফেজ মাসুদুর রহমানকে সদর হাসপাতালে নেওয়া হলে সকালে চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করে।
পুলিশ এক মাদ্রাসা ছাত্রের মৃত্যুর কথা স্বীকার করেছে । এই ঘটনায় শহরে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। সকালে ছাত্ররা বিক্ষোভ করে হরতাল ঘোষনা করে।
এদিকে মাদ্রাসা ছাত্রের মৃত্যুর ঘটনাকে কেন্দ্র করে সকাল থেকে শহরের বিভিন্ন স্থানে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছেন হাজারো বিক্ষুব্ধ মাদরাসা ছাত্র। মঙ্গলবার সকালে ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশনে দু’দফায় হামলা চালিয়ে ভাঙচুর এবং রেললাইনে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে।
মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে একদল মাদরাসা ছাত্র অতর্কিতভাবে রেলওয়ে স্টেশনে এসে হামলা চালায়। এ সময় বিক্ষুব্ধরা স্টেশনের এক নম্বর প্লাটফরমের দরজা-জানালা, স্টেশন মাস্টারের কক্ষ, প্যানেল বোর্ড ও টেলিফোন, চেয়ার-টেবিল ভাঙচুর করেন। এ ঘটনার পর থেকেই ঢাকার সঙ্গে চট্টগ্রাম ও সিলেটের রেল যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। ভোর থেকেই ছাত্ররা শহরের টিএ রোড হাসপাতাল রোড় বন্ধ করে বিক্ষোভ মিছিল করে। ব্যাংক এশিয়া সহ বিভিন্র স্হানে ভাংচুর করা হয়।
শহরে দোকান ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। যানচলাচল বন্ধ রয়েছে। বিভিন্ন স্থানে টায়ারে আগুন জালিয়ে বিক্ষেভ করছে ছাত্ররা।
দুপুরের দিকে মাদ্রাসা ছাত্ররা স্হানীয় সাংসদ ও আওয়ামী লীগ অফিসে ভাংচুর করে ও অগ্নি সংযোগ করে। এরপর বিক্ষুদ্ধ ছাত্ররা আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গনে ভাংচুর ও অগ্নি সংযোগ করে।
জামিয়া ইসলামিয়া ইউনুছিয়া মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মাও. মোবারকউল্লাহ জানান, সামগ্রিক পরিস্হিতি নিয়ে আমরা বৈঠক করেছি। বৈঠক থেকে তিন পুলিশ কর্মকর্তার প্রত্যাহর দাবি করা হয়। এ রিপোর্ট লিখার সময় পর্যন্ত শহরে থমথমে অবস্হা বিরাজ করছে।
১২ বর্ডার গার্ড ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেঃ কর্ণেল মোঃ নজরুল ইসলাম, পিবিজিএম জানান, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে শহরে চার প্লাটুন বিজিবি সহ র্যাব, পুলিশ মোতায়ন রয়েছে।
গত রাতের ঘটনায় পুলিশ মাদ্রাসা ছাত্রসহ শতাধিক লোক আহত হয়েছে। ৪ ঘন্টা ব্যাপী সংঘর্ষে অন্তত ৫শ রাউন্ড রাবার বুলেট ও টিয়ার সেল নিক্ষেপ করে পুলিশ।
এসব ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তরা বাদী হয়ে ১৪টি মামলা এবং পুলিশ বাদী হয়ে সদর থানায় দুটি মামলা দায়ের করে। এসব মামলায় প্রায় ১০ হাজার লোককে আসামি করা হয়। এসব মামলার পাশাপাশি মাদ্রাসা ছাত্র নিহত হওয়ার ঘটনায় দায়ের হওয়া মামলায়ও চার্জশিট দেয়নি পুলিশ।
এদিকে প্রতিটি মামলায় বিএনপি নেতাকর্মীদের জড়িয়ে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ করেছে দলটি। জেলা বিএনপি সাধারণ সম্পাদক মো. জহিরুল হক খোকন বলেন, ১২ জানুয়ারি ঘটনার সঙ্গে বিএনপির কোনো রকম সম্পর্ক নেই। তারপর ১৩টি মামলায় বিএনপিকে জড়ানো হয়েছে। আওয়ামীলীগ, ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও পুলিশের সাথে মাদ্রাসার ছাত্রদের সৃষ্ঠ ঘটনা, যার সাথে বিএনপি ও তার নেতাকর্মী কেহই সম্পৃক্ত ছিলনা, যা দিবালোকের মত স্পষ্ট।
১২ জানুয়ারী ২০১৬ এর ঘটনার পর প্রতিক্রিয়ায় মোকতাদির চৌধুরী এম.পি
ফুটেজ দেখে হামলাকারীদের গ্রেপ্তার করতে হবে
বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের কার্য নির্বাহী কমিটির সদস্য, বিশিষ্ট লেখক, মুক্তিযোদ্ধা, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি ও জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি র.আ.ম. উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এম.পি বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশে বর্তমানে উন্নয়নের জোয়ার বইছে। উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে হলে শেখ হাসিনার হাতকে শক্তিশালী করতে হবে।
তিনি শুক্রবার বিকেলে সদর উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে সদর উপজেলা আওয়ামীলীগের কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে একথা বলেন।
সদর উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি হাবিবুল্লাহ বাহারের সভাপতিত্বে এবং সাধারণ সম্পাদক ও সদর উপজেলা চেয়ারম্যান মোঃ জাহাঙ্গীর আলমের পরিচালনায় অনুষ্ঠিত সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে মোকতাদির চৌধুরী এমপি আরো বলেন, গত ১২ জানুয়ারি দিনভর ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মৌলবাদী ও স্বাধীনতা বিরোধীদের হামলা, বাংলাদেশের স্বাধীনতা, বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদ, বাঙ্গালীর কৃষ্টি, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে ধ্বংসের জন্যই হামলা। তিনি বলেন, যারা এই হামলা করেছে তারা রাজাকার, আল বদরদের পেতাত্মা। তিনি বলেন, কারো সাথে আমাদের কোন বিরোধ নেই। আমরা সবাই মিলে মিশে ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে গড়তে চাই।
মোকতাদির চৌধুরী এম.পি আরো বলেন, আওয়ামীলীগ ধ্বংসে নয় উন্নয়নে বিশ্বাসী। আমি হামলা-ভাংচুরের ঘটনায় বিচার বিভাগীয় তদন্ত দাবি করি। ভিডিও ফুটেজ দেখে দেখে হামলাকারীদের গ্রেপ্তার করে বিচারের আওতায় আনার দাবি জানাই।
সভায় বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন জেলা আওয়ামীলীগের সহ-সভাপতি ও পৌর মেয়র মোঃ হেলাল উদ্দিন, সহ-সভাপতি মুজিবুর রহমান বাবুল, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবুল বারী চৌধুরী মন্টু, সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মাহাবুবুল আলম খোকন।
সভায় গত ১১ এবং ১২ জানুয়ারি মৌলবাদিদের তান্ডবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া রেলওয়ে স্টেশন, সুর সম্রাট দি আলাউদ্দিন সঙ্গীতাঙ্গন, জেলা শিল্পকলা একাডেমী, জেলা আওয়ামীলীগের কার্যালয়, প্রশিকা কার্যালয়, জেলা আওয়ামীলীগের সাবেক সভাপতি ও সাবেক এম.পি অ্যাডভোকেট আলী আজমের বাসভবন, শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ভাষা চত্বরের শহীদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত স্মৃতি পাঠাগারসহ বিভিন্ন সাংস্কৃতিক সংগঠনের কার্যালয় ভাংচুর-ও অগ্নিসংযোগের নিন্দা করা হয়।সূত্র