Main Menu

‘গুলি লিটন’ এমপি’র স্ত্রীর অজানা গল্প

+100%-

apni20151006063545

জানা-অজানা ডেস্ক :: মঞ্জুরুল ইসলাম লিটন সুন্দরগঞ্জের এমপি হলেও এলাকার সবকিছুই দেখভাল করেন তার স্ত্রী সৈয়দা খুরশিদ জাহান স্মৃতি। নেতাকর্মীদের অভিযোগ শোনা, বিচার, সালিশ সবই করেন তিনি। স্থানীয় স্কুল-কলেজ থেকে সব প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণও তার হাতে। তিনিই মূলত উপজেলা প্রশাসনে খবরদারি করেন। এমনকি উপজেলা আইনশৃংখলা কমিটির মিটিংয়েও তার সরব উপস্থিতিও নানা আলোচনার জন্ম দিয়েছে। এভাবে উপজেলা প্রশাসনে স্ত্রীর ক্ষমতা চর্চার কারণেই স্থানীয় নেতাদের সঙ্গে এমপি লিটনের দূরত্ব বেড়েছে। এমনকি দেখা দিয়েছে বৈরিতা। আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতাকর্মীরা বলছেন, লিটন এমপি হলেও মূলত তার স্ত্রীই হলেন মাঠের এমপি। তার কথার বাইরে উপজেলায় কোনো কাজ করা সম্ভব নয়।

উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি ও সুন্দরগঞ্জ পৌরসভার বর্তমান মেয়র আবদুল্লাহ আল মামুন এলাকায় প্রভাবশালী নেতা হিসেবে পরিচিত। আর শিশুকে গুলি করার ইস্যুতে তিনিই এখন প্রকাশ্যে এমপির বিচারের দাবিতে মাঠে নেমেছেন।

স্থানীয় একজন আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, সুন্দরগঞ্জ পৌরসভায় কয়েকটি নিয়োগ নিয়ে প্রথমে এমপির স্ত্রীর সঙ্গে মেয়রের দ্বন্দ্ব শুরু হয়। এ দ্বন্দ্বের জের ধরে এমপির সঙ্গে তার বিরোধ চরম আকার ধারণ করে। অভিযোগ রয়েছে, পৌরসভার কয়েকটি পদে নিয়োগ বাণিজ্য করেন এমপির স্ত্রী সৈয়দা খুরশিদ জাহান স্মৃতি। প্রতিটি নিয়োগের বিপরীতে ৭ লাখ টাকা করে নেয়া হয়। এ নিয়োগ বাণিজ্যের প্রতিবাদ করতে গিয়ে এমপির স্ত্রীর সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন পৌর মেয়র। এরই জের ধরে এমপির সঙ্গে মেয়রের মুখ দেখাদেখিও বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া পুলিশ নিয়োগেও এমপির স্ত্রীর বিরুদ্ধে নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ ওঠে। সত্য-মিথ্যা যাই হোক এলাকার অনেকেই বলছেন, পুলিশে চাকরি দেয়ার কথা বলে এমপির স্ত্রী অনেকের কাছ থেকে টাকা নেন। চাকরি প্রার্থীদের কাছ থেকে ৬ লাখ করে টাকা নিয়ে অনেককে চাকরির আশ্বাস দেয়া হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত চাকরি পান মাত্র ৭ জন। পরে চাকরিবঞ্চিতরা টাকা ফেরত চাইলে বলা হয়, ‘ঘুষের টাকা ফেরত হয় না।’ আগামীতে আবারও চাকরির সুযোগ তৈরি হলে তাদের নিয়োগের আশ্বাস দিয়ে এখন ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। এছাড়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নৈশপ্রহরী কাম পিয়ন নিয়োগেও বাণিজ্যের অভিযোগ আছে। উপজেলায় ৫০টি নৈশপ্রহরী পদের বিপরীতে ৩৫টি নিয়োগ ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে, নৈশপ্রহরী নিয়োগে ৬ লাখ টাকা করে নিয়েছেন এমপির লোকজন।

এমপি ও তার স্ত্রীর এসব কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করতে গিয়ে এমপির বিরোধী পক্ষ হিসেবে ইতিমধ্যে চিহ্নিত হয়েছেন উপজেলা স্বেচ্ছাসেবক লীগের সভাপতি গোলাম কবির, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক সাজেদুল ইসলাম ও মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার এমদাদুল হক বাবুলসহ উপজেলা আওয়ামী লীগ ও সহযোগী বিভিন্ন সংগঠনের প্রথম সারির বেশ কয়েকজন নেতা। তারা বলছেন, এমপির বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের কারণে স্থানীয়ভাবে আওয়ামী লীগ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আর এসব অন্যায়ের প্রতিবাদ করায় এমপি ও তার স্ত্রীর বিরাগভাজন হয়েছেন।

স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা বলছেন, এমপির স্ত্রী জেলা মহিলা লীগের আহ্বায়ক। কিন্তু সাংগঠনিক কাজে তাকে দেখা যায় না। সংসদ সদস্যের যত কাজ তার সবই করেন তিনি। একজন আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, কিছুদিন আগে পুলিশ সুপারের কাছে নাশকতা মামলার আসামিদের নাম বাদ দেয়ার জন্য সুপারিশ পাঠান এমপির স্ত্রী। যাদের নাম বাদ দেয়ার জন্য তিনি সুপারিশ পাঠান তাদের বেশির ভাগই জামায়াত-শিবিরের পদবিধারী নেতা। উদাহরণ দিয়ে এক যুবলীগ নেতা বলেন, জামায়াত নেতা নাসির মেম্বার স্থানীয় জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা। তাকে মামলা থেকে বাদ দিতে পুলিশের কাছে সুপারিশ করেন এমপির স্ত্রী। এছাড়া সর্বানন্দ ইউনিয়নের সার ডিলার জামায়াত নেতা বাদশাকেও মামলা থেকে বাদ দেয়ার জন্য তিনি জোর তদবির করছেন। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় খাদ্য গুদামে খাদ্যশস্য মজুদ কার্যক্রমেও তিনি হস্তক্ষেপ করেন। নিয়মানুযায়ী কৃষক পর্যায় থেকে খাদ্যশস্য কেনার কথা থাকলেও কমিশন বাণিজ্যের মাধ্যমে দালাল ফড়িয়াদের কাছ থেকে খাদ্যশস্য কেনা হচ্ছে। এভাবে গত বছর সাড়ে ৮শ’ টন খাদ্যশস্য কেনা হয়। এলাকায় প্রচার আছে, খাদ্য গুদামে শস্য বিক্রি করতে হলে এমপির স্ত্রীকে টনপ্রতি ২ হাজার টাকা কমিশন দিতে হয়। স্থানীয় এক যুবলীগ নেতা যুগান্তরকে বলেন, এমপি কারও কাছ থেকে টাকা নেন না বলে বিভিন্ন সভা সমাবেশে প্রচার করেন। কিন্তু এটা হল তার আইওয়াশ। প্রকৃতপক্ষে এমপির কাছে কোনো কাজ নিয়ে গেলে তিনি তার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে বলেন। এভাবে বিশেষ কৌশলে টাকা নেন এমপির স্ত্রী।

সূত্রগুলো বলছে, নিয়োগ বা সরকারি অর্থ বরাদ্দে অনিয়ম তো আছেই, স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর ম্যানেজিং কমিটি গঠনেও টাকা নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। এলাকায় অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এমপির স্ত্রীর চার ভাইয়ের মধ্যে তিন ভাই এখন এলাকার অন্যতম ধনাঢ্য ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। তারা হলেন বদরুল ইসলাম বাদল, সোহাগ ও তারিকুল ইসলাম তারেক। অভিযোগ, স্থানীয় অনেক লেনদেন এমপির স্ত্রী তার এই তিন ভাইয়ের মাধ্যমে করে থাকেন। সূত্র বলছে, এমপির স্ত্রীর ভাই বদরুল ইসলাম বাদলের মাধ্যমে নৈশপ্রহরী নিয়োগের টাকা নেয়া হয়েছে। এই টাকা সুন্দরগঞ্জ সোনালী ব্যাংকে বাদলের হিসাবে জমা হয়। পরে সেই টাকা তুলে নেন এমপির স্ত্রী। স্থানীয় একজন কলেজ শিক্ষক বলেন, বামনডাঙ্গা আবদুল হক ডিগ্রি কলেজের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি হলেন এমপির স্ত্রী। এ কলেজে কয়েকটি পদে নিয়োগ দেয়ার কথা বলে তিনি টাকা নেন। কিন্তু বিষয়টি ম্যানেজিং কমিটির সদস্যরা জানতেন না। এ নিয়ে ম্যানেজিং কমিটির অন্য সদস্য ও কলেজের অধ্যক্ষের সঙ্গে হাতাহাতি পর্যন্ত হয়। এমপির মালিকানাধীন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান আশরাফ আলী হিমগারের চেয়ারম্যান হলেন তার স্ত্রী সৈয়দা খুরশিদ জাহান স্মৃতি। তার নামে রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক থেকে ২২ কোটি টাকার ঋণ নেয়া হয়। হিমাগার থেকে তেমন লাভ না হলেও গত এক বছরেই ঋণের ১২ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। এই টাকার উৎস নিয়ে এলাকায় কৌতূহলের শেষ নেই। সুন্দরগঞ্জ পৌরসভার মেয়র আবদুল্লাহ আল মামুন যুগান্তরকে বলেন, এমপির স্ত্রীই মূলত উপজেলার সব কাজে হস্তক্ষেপ করেন। এসব কাজ করতে গিয়ে তিনি চরম দুর্নীতি করে চলেছেন। এক প্রশ্নের জবাবে মেয়র বলেন, স্থানীয় এতিমখানার জন্য বরাদ্দকৃত ৬২ মেট্রিক টন খাদ্যশস্য আÍসাৎ করা হয়েছে। এছাড়া সোলার প্যানেল কেনার বরাদ্দও লুটপাট করেছেন এমপির স্ত্রী। স্থানীয়রা বলছেন, এমপির পরিবার যা কিছু সম্পদ গড়ছেন তার সবকিছুই করছেন ঢাকায়। ধানমণ্ডিতে ফ্ল্যাট কিনেছেন। এছাড়া নামে-বেনামে ঢাকায় বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও গড়ে তুলেছেন। এমপি হওয়ার আগে লিটনের তেমন আর্থিক সচ্ছলতা না থাকলেও বর্তমানে তিনি কোটিপতি। একাধিক বিলাসবহুল গাড়ি কিনেছেন। এমপি ও তার স্ত্রীর চলাফেরায় আভিজাত্য এসেছে। এসব অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণেই এমপির নিজের নিরাপত্তা নিয়ে শংকা তৈরি হয়। নিরাপত্তাহীনতার আশংকা থেকে তিনি অস্ত্রের লাইসেন্স নেন। একাধিক অস্ত্র নিয়েই তিনি চলাফেরা করতেন। তবে হাতে অস্ত্র আসার পর তিনি অনেকটাই বেসামাল হয়ে পড়েন। যাকে তাকে অস্ত্রের ভয় দেখানো শুরু করেন। খেয়ালখুশিমতো গুলিও ফোটান। এভাবে গুলি করা তার অভ্যাসে পরিণত হয়। আর এমপির এই বদঅভ্যাসের শিকার হয়েছেন অনেকেই। সর্বশেষ শুক্রবার স্কুলছাত্র শাহাদাত হোসেন সৌরভ তার অস্ত্রের গুলিতে আহত হয়ে এখন হাসপাতালে চিকিৎসাধীন, যা টক অব দ্য কান্ট্রিতে রূপ নিয়েছে।



(পরের সংবাদ) »



Shares