ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় দেড় শ বছরেও বিনোদনের ক্ষেত্র সৃষ্টি হয়নি
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মানুষ জেলাটিকে বলে থাকে সংস্কৃতির রাজধানী। জেলা শহরে বছরজুড়েই সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, সংগঠনের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড হয়ে থাকে।
বাংলা নতুন বছরের শুরুতে বৈশাখী মেলা আর ডিসেম্বরে আয়োজন করা হয় বিজয় মেলার। বিনোদনের অন্য কোনো ব্যবস্থা না থাকায় এসব সাংস্কৃতিক আয়োজনকে ঘিরে মানুষের উপচে পড়া ভিড় জমে। এর বাইরে বিনোদনের ব্যবস্থা নেই বললেই চলে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার প্রধান নাগরিক সমস্যা কী? সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে করা এ প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নের জবাবে অনেকে বিনোদনের ব্যবস্থা না থাকার কথা উল্লেখ করেছেন। জানিয়েছেন, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একটি উদ্যান না থাকার কথা। জানতে চাইলে তাঁরা বলেছেন, তিনটি সিনেমা হল বন্ধ হয়ে যাওয়ার বিষয়টি। খেলাধুলার মাঠের অভাবের কথাও বলেছেন অনেকে।
উদ্যান বলতে কাউতলী এলাকার ফারুকী পার্ককেই বোঝেন এলাকার মানুষ। তবে শিশুরা আনন্দ পাবে এমন কিছু নেই ছোট এই উদ্যানে।
মূলত স্মৃতিসৌধকে কেন্দ্র করেই এখানে বিকেলে কিছু লোকের সমাগম ঘটে। একটি পুকুর থাকায় বিশেষ করে গরমের দিনে অনেকে সেখানে সময় কাটান। তবে তারও একটি বড় অংশে লন টেনিসের কোর্ট করা হয়েছে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে।
অবশ্য আশার বিষয় হচ্ছে, ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌর এলাকার ভাদুঘরের কুরুলিয়া ব্রিজসংলগ্ন এলাকায় ব্যক্তি উদ্যোগে সম্প্রতি একটি উদ্যান নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে পৌরসভা ও জনপ্রতিনিধিদের কাছে একটি উদ্যান নির্মাণের দাবি উঠলেও এর কার্যত কোনো উদ্যোগ এখন পর্যন্ত লক্ষ করা যায়নি। প্রায় দেড় শ বছর আগের এ পৌরসভায় এখনো কোনো উদ্যান গড়ে না ওঠায় সচেতন নাগরিকদের মধ্যে ক্ষোভ আছে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া মেডিক্যাল কলেজের চেয়ারম্যান ডা. মো. আবু সাঈদের মতে, ‘শিশুদের তাদের ইচ্ছা মতো চলতে দেওয়ার দরকার হয়। সব শিশুই চায় খেলাধুলা করতে, ঘুরে বেড়াতে। এ কারণে খেলার মাঠ ও পার্কের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। এমন পরিবেশ না পেলে শিশুর মানসিক ও মেধার বিকাশ হয় না। শিশুরা বিভিন্ন মানসিক সমস্যায় ভোগে। ’
শিশু-কিশোরদের সংগঠন খেলাঘর আসর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাধারণ সম্পাদক নীহাররঞ্জন সরকার বলেন, আওয়ামী লীগ নেতা মো. হেলাল উদ্দিন মেয়রের দায়িত্বে থাকাকালে শিশুরাসহ গিয়ে একটি পার্ক নির্মাণের দাবি জানিয়েছিল। তিনি আশ্বস্ত করেছিলেন। এ ছাড়া বিভিন্ন ফোরামের আলোচনায় পার্ক নির্মাণের দাবি জানানো হয়। কিন্তু আজ পর্যন্ত পার্ক নির্মাণের বাস্তব কোনো পরিকল্পনা নেওয়া হয়নি। যে কারণে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার শিশুরা পড়ালেখার নির্দিষ্ট একটা গণ্ডিতেই আটকে আছে।
পৌর এলাকার সব কটি সিনেমা হল বন্ধ হয়ে গেলেও নতুন করে আর নির্মাণ হয়নি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নিকট অতীতেও পৌর এলাকায় তিনটি সিনেমা হল ছিল। এর মধ্যে প্রথম নির্মিত টিএ রোডের চিত্রালয় সিনেমা হলটি ঠিক কত সালে স্থাপিত হয়েছিল এর সঠিক কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। ১৯৪১ সালে স্থাপিত হয় রপশ্রী সিনেমা হল। এরপর রজনীগন্ধা সিনেমা হল। তবে বর্তমানে তিনটি সিনেমা হলই বন্ধ। তিনটিতেই হয়েছে বহুতল বিপণিবিতান।
২০০২ সালে বন্ধ হয়ে যাওয়া রূপশ্রী সিনেমা হলের অংশীদার বাদল গুহ বলেন, ‘ঢাকার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার তিনটি সিনেমা হলে ছবি (চলচ্চিত্র) চালানো হতো। যেদিন যে ছবি মুক্তি পেত, সেদিনই সেটা চালানো হতো ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। দর্শক অনেক হতো বলে পেশাটা লাভজনক ছিল। বিভিন্ন প্রযুক্তির কারণে ঘরে বসে ছবি দেখার সুযোগ পাওয়া যায় বলে একটা সময় সিনেমা হলে এসে ছবি দেখার আগ্রহ কমে যায়। এ অবস্থায় লোকসান হতে থাকায় আমাদের হল বন্ধ করে দেওয়া হয়। ’
ওয়েবসাইট ঘেঁটে দেখা গেছে, ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভা গঠিত হয় ১৮৬২ সালে। কার্যক্রম শুরু হয় ১৮৬৮ সালে। সাড়ে পাঁচ বর্গমাইল নিয়ে যাত্রা শুরু করা পৌরসভাটি বর্তমানে ১৮ বর্গকিলোমিটার এলাকা নিয়ে গঠিত। ১২টি ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত এ পৌরসভার লোকসংখ্যা প্রায় দুই লাখ।
ওয়েবসাইটে পৌরসভার লক্ষ্য অংশে বলা হয়েছে, সব ধরনের নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করে ২০১৫ সালের মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়াকে স্বয়ংসম্পূর্ণ নগরী হিসেবে গড়ে তোলা। শহরটি সব অবকাঠামোর দিক দিয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ, দারিদ্র্যমুক্ত, নিরাপদ, উন্নত দৈনন্দিন জীবিকা সংবলিত পরিবেশবান্ধব, বর্জ্য-দূষণমুক্ত এবং আর্থিক ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে দক্ষ একটি পরিকল্পিত শহর হবে। কার্যাবলিতে লেখা আছে, শিক্ষা, খেলাধুলা, চিত্তবিনোদন, আমোদ-প্রমোদ এবং সাংস্কৃতিক সুযোগ সৃষ্টি ও প্রসারে সহায়তা করা। পাশাপাশি শহরের সৌন্দর্য বাড়ানোর কথাও রয়েছে কার্যাবলিতে।
কিন্তু এসবের বাস্তব কার্যক্রম নেই বললেই মনে করেন সুধীজনরা। তাঁরা কালের কণ্ঠকে বলেন, পৌরসভার উদ্যোগে অন্যান্য নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করার বিষয়ে কাজ করা হলেও বিনোদনের বিষয়ে তেমন কোনো উদ্যোগ কখনোই তেমনভাবে চোখে পড়েনি।
সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আহ্বায়ক আব্দুন নূর বলেন, শিশুদের পরিপূর্ণ মানসিক বিকাশের জন্য ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অন্তত একটি শিশু পার্ক খুবই জরুরি। বিভিন্ন সময়ে এ দাবি উঠলেও কার্যকর কোনো পদক্ষেপ লক্ষ করা যায়নি। ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘সাংস্কৃতিক বিনোদনের ক্ষেত্রে বাধা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হলরুমগুলো। কেননা এগুলোর ভাড়া অনেক বেশি হওয়ায় অনুষ্ঠান করতে সংগঠনগুলোকে হিমশিম খেতে হয়। আমি মনে করি, এগুলোর ভাড়া কমানো হলে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড আরো বেগবান হবে। ’
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা নাগরিক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক রতন কান্তি দত্ত বলেন, ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মতো জেলা শহরে পার্ক না থাকার কথা ভাবাই যায় না। আমরা জনপ্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের কাছে পার্ক নির্মাণের দাবি জানিয়েছি বিভিন্ন সময়ে। কিন্তু এখন পর্যন্ত দৃশ্যত কোনো কার্যক্রম চোখে পড়ছে না। ’
ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভার সচিব আবু জর গিফারী কালের কণ্ঠকে বলেন, পৌর এলাকার ভেতরে থাকা পুরনো জেলখানার (পরিত্যক্ত) জায়গাটি বরাদ্দ দেওয়ার জন্য জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে আবেদন পাঠানো হয়েছে। জায়গাটি বরাদ্দ পেলে এখানে পৌরসভার উদ্যোগে পার্ক নির্মাণের ব্যবস্থা করা হবে।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া পৌরসভার সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আল-মামুন সরকার বলেন, “১৯৯৩ সালে আমি পৌরসভার চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ৮০ লাখ টাকা ব্যয়ে ভারতীয় খ্যাতনামা কম্পানি ‘গির্জি অব ইন্ডিয়া’ দিয়ে পৌরসভার উন্নয়নে মাস্টারপ্ল্যান করাই। ওই প্ল্যানে শিশু পার্কের কথা উল্লেখ ছিল। মেড্ডা এলাকায় শিশু পার্কের জন্য জায়গাও নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু পরে অন্য চেয়ারম্যান, মেয়ররা এসে ওই প্ল্যান ফলো করেননি। শিশু পার্ক নির্মাণে পৌরসভা এখন যে উদ্যোগ নিয়েছে সেটি বাস্তবায়নে সংসদ সদস্য র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী চেষ্টা করছেন। ”
#কালেরকন্ঠে প্রকাশিত