Main Menu

আমার স্টেনগানে ৬-৭ পাকিস্তানি সেনা শেষ

+100%-

‘সাথে থাকা মুক্তিযোদ্ধাকে আহত হয়ে ছটফট করতে দেখেছি। কিছুই করতে পারিনি। অনেকের শহীদ হওয়া খুব কাছ থেকে দেখেছি। লাশ টেনে নিতে গিয়েও শত্রুপক্ষের হামলার মুখে পড়তে হয়েছে। বীরশ্রেষ্ঠ মোস্তফা কামালের শহীদ হওয়ার দৃশ্য এখনো চোখে ভাসে। এসব ঘটনা মনে আরো জেদ বাড়িয়ে দিয়েছিল। একদিন তো সম্মুখযুদ্ধে স্টেনগানের গুলিতে ছয়-সাতজন পাকিস্তানি সেনা সদস্য মেরে ফেলি।’ কথাগুলো বলছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার বিজয়নগর উপজেলার মুক্তিযোদ্ধা মো. শহিদুল ইসলাম ওরফে সুদ মিয়া।

গতকাল শুক্রবার সকালে কথা হয় বিজয়নগর উপজেলার সিঙ্গারবিল ইউনিয়নের কাশিমপুর গ্রামের ওই মুক্তিযোদ্ধার সঙ্গে। বীরত্বগাথার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তিনি কখনো কখনো আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। বয়সের ভারে আর অসুস্থতার কারণে দিনক্ষণ ঠিকভাবে বলতে পারছিলেন না।

শহিদুল ইসলাম ছিলেন চতুর্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের হাবিলদার। যুদ্ধ করেছেন ২ নম্বর সেক্টরের অধীন কুমিল্লা, কসবা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া অঞ্চলে। শেষের দিকে ডাক পড়েছিল ঢাকায়ও। কোনো কোনো যুদ্ধে জয়ী হয়েছেন, আবার কখনো পিছপা হয়েছেন। এসব নিয়েই কথা বলেছেন তিনি।

শহিদুল ইসলাম জানান, ১৯৭১ সালের এপ্রিলের দিকে তাঁরা অবস্থান নিয়েছিলেন আখাউড়া উপজেলার দরুইন এলাকায়। পাশাপাশি দুটি বাংকার ছিল। পাকিস্তান বাহিনী একদিন অতর্কিতে আক্রমণ করে। আর্টিলারি শেল, বোমা নিক্ষেপের কারণে কোনোভাবেই টেকা যাচ্ছিল না। বাঁচবেন যে তা-ও তাঁরা ভাবেননি। নির্দেশ আসে সবাইকে সরে যাওয়ার। তবে মোস্তফা কামাল সরে যাননি। গুলি ও বেয়নেটের আঘাতে তাঁকে ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয়েছিল। মফিজ নামে আরো একজন সহযোদ্ধা ওই সময় শহীদ হয়েছিলেন। অন্যরা কোনো রকমে সরে গিয়ে চলে গিয়েছিলেন আখাউড়া স্থলবন্দর এলাকায়।

শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘স্থলবন্দরে পাকিস্তান বাহিনীর সঙ্গে আমাদের ঘণ্টা তিনেক যুদ্ধ হয়। পরে ভারতীয় বাহিনীর অনুরোধে সেখান থেকে আমরা সরে যাই। আখাউড়া থেকে গিয়ে আমরা অবস্থান নেই কসবার সালদা নদী এলাকায়। সেখানে তিন মাস যুদ্ধ চলে।’

সালদা নদী এলাকায় এক রাতের ভয়াবহ যুদ্ধের বর্ণনা দেন শহিদুল। সেখানে ৭০-৮০ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত এবং বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হওয়ার বর্ণনা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা পাকিস্তানিদের অবস্থান নেওয়া এলাকা আগে রেকি করি। ক্যাপ্টেন গাফফার আমাদের দায়িত্বে ছিলেন। উনি জানিয়ে গেলেন, নির্দেশমতো সময়ে আক্রমণ করতে হবে। রাত ৩টার দিকে আক্রমণ শুরু হয়। আমার পাশের মুক্তিযোদ্ধা সালামের মাথা উড়ে যায় ব্রাশফায়ারে। আশপাশের আরো ১০-১২ জনকে হারাই। আমি স্টেনগান হাতে যুদ্ধ করি। আমার উপর্যুপরি গুলিতে অন্তত ছয়-সাতজন পাকিস্তানি সেনা মারা যায়। আশাবাড়ী এলাকার মোখলেছ মেম্বার নামের এক ব্যক্তি শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের দাফনের ব্যবস্থা করেন।’

শহিদুল বলেন, ‘আমার গ্রামের বাড়ির প্রতিবেশী শহিদুল ইসলাম নামের একজন মারা গেছেন মনে করে অষ্টগ্রাম এলাকায় গিয়ে দাফনের প্রস্তুতি নেই। ওই সময় গ্রাম্য এক ডাক্তার এসে বললেন তিনি হয়তো জীবিত আছেন। পরে উনাকে ভারতের আগরতলার জিবি হাসপাতালে নেওয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধা লুত্ফুল হাই সাচ্চু সেখানে ওনাকে রক্ত দেন। সেবা-শুশ্রূষায় তিনি ভালো হয়ে ওঠেন। আজও তিনি বেঁচে আছেন।’

মুক্তিযোদ্ধা শহিদুল ইসলাম আরো বলেন, ‘নামে মিল থাকায় ভারতে থাকা আমার পরিবার জানতে পারে আমি মারা গেছি। আমার স্ত্রী তো বিধবার বেশ নিয়ে নেয়। আমার মাকে বাঁচানো ছিল দায়। আমাদের কর্মকর্তা হারুন অর রশিদ আমাকে ক্যাম্প থেকে ডেকে পাঠিয়ে ওই ভুল ভাঙান। তবে ভারতে গিয়ে আমি তিন দিন থেকে আবার চলে আসি। ফেলে আসা কাপড়চোপড় নিয়ে আসব বলে সেখান থেকে চলে আসি।’

শহিদুল জানিয়েছেন আক্ষেপের কথাও। তিনি বললেন, ‘ভাতা পাওয়ার জন্য তো আর যুদ্ধ করিনি। আমাদেরকে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান বলা হয়। এটাই তো বড় প্রাপ্তি। আর এখন তো ভাতা পাওয়ার জন্য, চাকরিসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার জন্য মুক্তিযোদ্ধার কাগজপত্র তৈরি করা হচ্ছে। খারাপ লাগে যে যারা এসব করছে তারা মুক্তিযোদ্ধা না।’

শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘শেষের দিকে আমাদেরকে ঢাকার মিরপুরে ডেকে নেওয়া হয়। সেখানেও যুদ্ধে অংশ নেই। একসময় শুনতে পাই পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ করেছে। ৯ মাসের যুদ্ধ শেষে ওই দিন যে কী আনন্দ পেয়েছিলাম তা বলে বোঝানো যাবে না।’

মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেওয়ার আগে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে পাকিস্তানিদের সঙ্গে বিরোধের স্মৃতিচারণা করে শহিদুল বলেন, ‘রেডিও শোনা, পত্রিকা দেখার বিষয়ে আমাদের বারণ করা হয়। একসময় বলা হয়, আমাদের সবাইকে চাকরি থেকে অবসরে যেতে হবে। মেজর খালেদ মোশারফ, ক্যাপ্টেন আইনুদ্দিন, ক্যাপ্টেন গাফফারসহ অন্য বাঙালি কর্মকর্তাদের নির্দেশে আমরা এতে বিরোধিতা করি। একপর্যায়ে আমাদেরকে পাঁচটি ভাগে ভাগ করে বিভিন্ন এলাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। উদ্দেশ্য ছিল আমাদেরকে মেরে ফেলা। আমাদের কয়েকজনের একটি দলকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া আনার পর সঙ্গে থাকা পাকিস্তানি সেনাদেরকে কৌশলে জেলে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। আমরা অবস্থান নেই স্টেডিয়ামে। সেখানে আব্দুল কুদ্দুস মাখন, মাহবুবুল হুদা, আলী আজমসহ স্থানীয় আরো অনেকে এসে আমাদেরকে সহযোগিতা করার আশ্বাস দেন। কিছুদিনের মধ্যেই স্টেডিয়ামেও আক্রমণ করে পাকিস্তানিরা। আমরা প্রতিরোধ করি।’

সিনিয়র ওয়ারেন্ট অফিসার হিসেবে সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেন শহিদুল ইসলাম। বর্তমানে তাঁর বয়স ৭৫ বছর।






Shares