আখাউড়ায় সিল মারার দলে ছিলেন ছাত্রদল সভাপতিও
প্রার্থী নিয়ে মনোবল ভাঙা আখাউড়া বিএনপি পৌর নির্বাচনে ছিল ছন্নছাড়া। নানা অজুহাতে নির্বাচনের পুরো সময়টাতেই গা বাঁচিয়ে চলেছেন দলের নেতাকর্মীরা। শুধু কি তাই, সরকার সমর্থক প্রার্থীর পক্ষে রীতিমতো প্রচারণায় ব্যস্ত ছিলেন দলের অনেক প্রভাবশালী নেতা। ভোটের দিন উপজেলা ছাত্রদলের এক নেতা নিজেই এক কেন্দ্রে নৌকা মার্কায় সিল মেরেছেন। তাই সুপার পরাজয় হয় দলীয় প্রার্থীর।
১৯৯৯ সালে গঠিত এ পৌরসভায় যে কয়টি নির্বাচন হয়েছে তাতে জয়-পরাজয় সামান্য ভোটের ব্যবধানেই হয়েছে। কিন্তু এবারের ফারাক বিশাল। প্রায় ১১ হাজার ভোট বেশি পান আওয়ামী লীগ প্রার্থী। এর জন্য অবশ্য ‘সিল মারার পার্টি’কে দায়ী করছেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। ২০১১ সালের ১৮ই জানুয়ারির নির্বাচনে বিএনপি নেতা এন এম হাসান খান মেয়র নির্বাচিত হন। ওই বছরের ১৫ই অক্টোবর হাসান খান মারা গেলে ২০১২ সালের ১২ই জানুয়ারি অনুষ্ঠিত উপনির্বাচনে মেয়র হন তাকজিল খলিফা কাজল। তখন হাসান খান পেয়েছিলেন ৪৪৬৬ ভোট আর কাজল ৩৫১৪ ভোট। আর উপনির্বাচনে কাজল ৪৫১৩ ভোট পেয়ে মেয়র নির্বাচিত হন। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী মাইনুল ইসলাম। তিনি পেয়েছিলেন ৩৫৫২ ভোট। ওই নির্বাচনে বিএনপি প্রার্থী জয়নাল আবেদীন আবদু মিয়া পেয়েছিলেন ৩৩৯০ ভোট। বিএনপির বিদ্রোহী হাসিব হুমায়ুন পান ২৯৮২ ভোট। ২০১২-এর দুটি নির্বাচনে এ পৌরসভার ভোটার ছিল ২০ সহস্রাধিক। মূল নির্বাচনে ১৫ হাজার আর উপনির্বাচনে প্রায় ১৬ হাজার ভোট কাস্ট দেখানো হয়। আর এবারের ভোটার সংখ্যা ২৪ হাজার ৭০০। ভোট কাস্ট দেখানো হয় ১৯ হাজারের মতো। এর মধ্যে বিএনপি প্রার্থী পেয়েছেন ৩ হাজার ভোট।
আখাউড়ায় বিএনপির সাংগঠনিক অবস্থা শক্তিশালী বলেই দাবি করেন বিএনপি নেতাকর্মীরা। দলের দায়িত্বশীল একাধিক নেতা জানান, প্রার্থী নির্বাচনই ঠিক হয়নি। যাকে দলের মনোনয়ন দেয়া হয়েছে তিনি মেয়র নির্বাচনের জন্য সব দিক দিয়ে উপযুক্ত ছিলেন না। উপজেলা বিএনপির একজন পদদারী নেতা হলেও গোটা পৌর এলাকার মানুষের সঙ্গে তার তেমন কোনো যোগাযোগ ছিল না। শিক্ষা-দীক্ষার মাপকাঠিতেও ছিলেন পিছিয়ে। শুধু দেবগ্রামের লোক, গোষ্ঠী আছে বিবেচনায় তাকে মনোনয়ন দেয়া হয়। তবে তার মনোনয়ন কীভাবে হলো তা নিয়েও প্রশ্ন আছে। এক গ্রুপ বলছে, এলাকার সাবেক সংসদ সদস্য মুশফিকুর রহমান তাকে মনোনয়ন দিয়েছেন। যদিও মুশফিকুর রহমান তখন দেশের বাইরে ছিলেন। আরেক গ্রুপ বলছে, বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা নাছির উদ্দিন হাজারীর চয়েজ মন্তাজ। প্রার্থী সিলেকশনে এ দুজনের কার হাত ছিল তা স্পষ্ট না হলেও তাদের দুজনই ছিলেন প্রচারণা থেকে দূরে। মুশফিকুর রহমান একদিন আর হাজারী একদিন করে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালান শুধু। তবে তৃণমূলের নেতকর্মীদের চাওয়া ছিল জয়নাল আবেদীন আবদু। তাকে মনোনয়ন না দেয়ায় শুরুতেই হোঁচট খায় বিএনপি। আওয়ামী লীগ প্রার্থীর তুলনায় তেমন কোনো প্রচার-প্রচারণাই ছিল না বিএনপি প্রার্থীর। অনেক জায়গায় পোস্টারও দেখা যায়নি। কেন্দ্রীয় বিএনপি নেতা মনিরুল হক চৌধুরী আখাউড়ায় প্রচারণায় এসে প্রার্থী ভুল হয়েছে বলে দলের নেতাকর্মীদের বৈঠকে স্বীকার করেন। তিনি সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হয়ে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করার জন্য অনুরোধ জানালেও তা হয়নি। জয়নাল আবেদীন আবদু বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে তার জমা দেয়া মনোনয়ন উঠিয়ে নিলেও একেবারেই প্রচারণায় নামেননি। একাধিক সূত্রে জানা যায়, সরাসরি দলীয় প্রার্থীর পক্ষে মাঠে না নেমে তলেতলে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর সঙ্গে লাইন দিয়ে দেন বিএনপি নেতাকর্মীদের অনেকেই। উপজেলা ছাত্রদলের সভাপতি আল-আমীন ভোটের দিন শহীদ স্মৃতি কলেজ কেন্দ্রে নিজেই নৌকা মার্কায় সিল মারেন বলে অভিযোগ ওঠে। দলের প্রার্থী ও নির্বাচন পরিচালনায় সম্পৃক্ত একাধিক নেতা এ বিষয়টি নিশ্চিত করেন। পৌর বিএনপির সভাপতি বাহার মিয়া দলের প্রার্থী বাছাইয়ে মন্তাজ মিয়ার পক্ষে ছিলেন। ভোটের লড়াই জমে উঠলে তিনি আওয়ামী লীগের প্রার্থীর নৌকায় চড়ে বসেন। আওয়ামী লীগ প্রার্থীর একাধিক নির্বাচনী সভায় বক্তৃতা করেন বাহার। উপজেলা যুবদলের সভাপতি নাহিদুল ইসলামের বাবা উপজেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি আনোয়ার আহমেদও নৌকার নির্বাচন করেন। তবে নাহিদ দলীয় প্রার্থীর পক্ষে থাকলেও নির্বাচনের শেষ কয়েক দিন এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যেতে হয় তাকে। পুলিশ তাকে নানা ভয়ভীতি দেখায় বলে অভিযোগ রয়েছে। আওয়ামী লীগ সমর্থিত প্রার্থী কাজলের বিগত পৌর পরিষদের একজন সহকর্মী ছিলেন মন্তাজ মিয়া। তিনি ৮ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ছিলেন। এ কারণে আওয়ামী লীগ প্রার্থীর সঙ্গে আখেরে তার আঁতাত হয় বলে প্রচার আছে। আলোচনা আছে মন্তাজকে নিয়ে মাঠে থাকা বিএনপির একটি অংশের সঙ্গে উপজেলা বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক বর্তমানে উপজেলা আওয়ামী লীগের সদস্য রুহুল আমিন খাদেম এ ব্যাপারে যোগাযোগ রক্ষা করেন। রুহুল আমিন আওয়ামী লীগের প্রার্থী কাজলের ঘনিষ্ঠজন। আল-আমীনকে ছাত্রদলের সভাপতি বানাতেও ভূমিকা রাখেন অন্য দলের নেতা রুহুল আমিন। মামলাসহ সবকিছু থেকেই আল-আমীনকে সেইফে রাখেন রুহুল। আর এসব কারণেই আল-আমীন রুহুল আমিনের কথায় উঠে-বসে। সে কারণে নৌকা প্রতীকে সিল মারতেও কোনো দ্বিধা করেনি। নির্বাচনের দিন সকাল সাড়ে ৯টায় বিএনপি প্রার্থী মন্তাজ মিয়া তার বাসায় দলীয় নেতাকর্মীদের ডেকে পাঠান। সেখানে মন্তাজ মিয়া দলের নেতাকর্মীদের সঙ্গে করণীয় নির্ধারণে আলোচনা করার সময় তার ছেলে হুমায়ুন কবির হাজির হন। হুমায়ুন মানসম্মান রক্ষায় তাড়াতাড়ি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত দেন। তবে বিএনপির যে অংশটি মন্তাজ মিয়াকে মনোনয়ন দেয়ার পক্ষে ছিলেন তারা বলছেন নির্বাচন ফেয়ার হয়নি। নির্বাচন ফেয়ার হলে আমাদের দল থেকে একটা কলাগাছ দাঁড় করিয়ে দিলেও পাস করতো।
উপজেলা বিএনপির সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার মুসলিম উদ্দিন বলেন, প্রার্থীর কোনো ত্রুটি নেই। এখানে প্রার্থী-অপ্রার্থী কোনো ফ্যাক্টর নয়। তারা সব কেন্দ্র দখল করে ফেলেছে। সকাল ৮টা থেকেই তারা কেন্দ্রে কেন্দ্রে সিল মারা শুরু করে। বহিরাগত দুই হাজার লোককে তারা সাদা ক্যাপ পরিয়ে কেন্দ্রে পাঠিয়েছে। তারা শুধু নৌকা মার্কায় সিল মেরেছে। তার পরও কলেজ কেন্দ্রে আমাদের প্রার্থী দেড় শ ভোট পেয়েছে। আবদু মিয়ার গোষ্ঠীর ৪০০ লোক কি কলেজ কেন্দ্র ধরে রাখতে পারতো? মন্তাজ তো তার কেন্দ্রে পাস করেছে। আসলে মানুষ ভোট দেয়ার সুযোগ পায়নি। সুযোগ পেলে কলাগাছ দাঁড় করিয়ে দিলেও পাস করতো। আমাদের নেতাকর্মীদের এক মাস ধরে পুলিশ দৌড়ের ওপর রেখেছে। মারধর করেছে। মামলা দিয়েছে। আজকে যদি সুষ্ঠু ভোট হতো আর আমাদের প্রার্থী ফেল করতো তাহলে বুঝতাম প্রার্থীর সমস্যা ছিল। তিনি বলেন, দুজন দলীয় মনোনয়ন চেয়েছিলেন। এর মধ্যে যাকে দেয়া হয়েছে সে যথেষ্ট উপযুক্ত।
বিএনপির প্রার্থী মন্তাজ মিয়া বলেন, আসলে ঘটনা অইলো যারাই কাজ করতে নামছে তাদেরই পুলিশ দৌড়ানি দিছে। আমাদের উপজেলা বিএনপি নেতা দেলোয়ার হোসেন খাদেমকে পিটিয়ে বাঁ-হাতের গিরাগারা (হারের বিভিন্ন জয়েন্ট) ভেঙে দিয়েছে। পুলিশ আমার মার্কা দেখলেই পিটাইছে। এ ধরনের কর্মকাণ্ডের কারণে নেতাকর্মীরা দূরে দূরে থেকেছে। তিনি বলেন, ৫০ মিনিট নিরপেক্ষ নির্বাচন হয়েছে। এর মধ্যেই আমি ৩ হাজার ভোট পেয়েছি। ৮ ঘণ্টা সুষ্ঠু ভোট হলে আমি কত ভোট পাইতাম বুঝেন। আমার মনোনয়ন আল্লাহর কুদরতে হয়েছে। আমি আঁতাত করেছি এটা অবাঞ্ছিত কথা। কেউ কারও ভাত খায় না, কাপড় পরে না। এটা কি সম্ভব, আমি একটা বৃহত্তর দলের মনোনয়ন পাইয়া কাজলের কথা শুনবো। আমি কি এতই কাপুরুষ।
পৌর বিএনপির সভাপতি বাহার মিয়া বলেন, আমি আওয়ামী লীগ প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণায় যাইনি। নির্বাচন শুরুর আগে এলাকার উন্নয়নের বিষয়ে একটা মিটিং হয়েছিল। আমি সেখানে ছিলাম। কাউন্সিলর হিসেবে আমি কি উন্নয়ন করেছি তা এলাকার লোকজনের সামনে তুলে ধরেছি। প্রথমে ভেবেছিলাম মন্তাজ বড় গ্রামের লোক। তার এলাকায় ৫ হাজার ভোট আছে। গ্রামের মানুষও ঐক্যবদ্ধভাবে তাকে সমর্থন দিয়েছিল। আর আবদু মিয়া নারায়ণপুরের বাসিন্দা, তার এখানে মাত্র ৭০০ ভোট। আমরা ভোটের ব্যবধান হিসাব করে মন্তাজ মিয়াকে সমর্থন দিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম তার পক্ষেই জয়ী হওয়া সম্ভব। কিন্তু নির্বাচন যে দলীয়ভাবে হবে তা তখন বুঝতে পারিনি। তা ছাড়া আওয়ামী লীগ জোরে জয় নিয়েছে। নৌকার ভোট নিয়েছে প্রকাশ্যে। আর কাউন্সিলরের ভোট গোপনে। আমিও কাউন্সিলর নির্বাচন করেছিলাম। ৪২ ভোটে হেরে গেছি।
মানবজমিন