Main Menu

প্রশিক্ষণ :: বদলাবে হিজড়ার জীবনধারা

+100%-
hijraবিশ্বজিৎ পাল বাবু, ব্রাহ্মণবাড়িয়া   ::প্রশিক্ষক স্মৃতি সবুর রিকশা থেকে নামতেই হাতে থাকা ব্যাগ নিতে এগিয়ে এলো তিন-চারজন। বলল, ‘ম্যাডাম, আমার কাছে দেন, আমি নেই।’ আবার সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা শারমীন রহমান চৌধুরী প্রশিক্ষণ কক্ষে প্রবেশ করতেই সবাই দাঁড়িয়ে সালাম দিল। বলল, ‘কেমন আছেন ম্যাডাম?’

কিছুদিন আগেও ব্যাপারটা এমন ছিল না। উচ্ছৃঙ্খল, বেহিসাবি জীবনযাপনে অভ্যস্ত ছিল তারা। আদব-কায়দার বালাই ছিল না। তবে এখন পাল্টে যেতে শুরু করেছে তারা! হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে ৫০ দিনব্যাপী মৌলিক দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচির আওতায় প্রশিক্ষণে অংশ নেওয়া হিজড়ারা নিজেদের জানতে শুরু করেছে, বুঝতে শুরু করেছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা সমাজসেবা কমপ্লেক্সে চলমান প্রশিক্ষণে ঘণ্টা দুয়েক অবস্থান করে হিজড়াদের বদলে যাওয়া সম্পর্কে ধারণা পাওয়া গেল। সেখানে রূপচর্চার ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে। কথা বলে জানা গেল, সরকারি এই প্রকল্পে প্রশিক্ষণ নিতে পেরে হিজড়ারাও বেশ খুশি। নিজেদের জীবনধারা পাল্টানো নিয়ে তারা আশাবাদী হতে শুরু করেছে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় হিজড়াদের গুরু হিসেবে পরিচিত খেলি হিজড়ার কণ্ঠে সেই আশারই কথা, ‘হাত পেতে বাঁচার চেয়ে কাজ করে খাওয়া ভালো। মানুষ আমাদের নিয়ে নানা কথা বলে। পেটের দায়ে মানুষের ওপর আমরা অত্যাচার করি। নিজের পায়ে দাঁড়ালে কেউ আমাদের কিছু বলার সুযোগ পাবে না। ট্রেনিং নিয়ে বিউটি পার্লার খোলার পরিকল্পনা আছে। নিয়মিত ট্রেনিং করার জন্য আমি সবাইকে উৎসাহ দিচ্ছি।’

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সমাজসেবা অধিদপ্তরের আওতায় হিজড়াদের জীবনমান উন্নয়নে গত ৪ জুন শুরু হয়েছে ৫০ দিনব্যাপী প্রশিক্ষণ। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত প্রশিক্ষণ চলে।

এতে নিয়মিত অংশ নিচ্ছে ৫০ জন হিজড়া। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জেলা প্রশাসক ড. মুহাম্মদ মোশাররফ হোসেন এই কর্মসূচির উদ্বোধন করেন।

কথা হলো প্রশিক্ষণরত হিজড়া শাহিনূর ও শাওনের সঙ্গে। তারা বলল, ‘মানুষের বাড়িতে গিয়ে, রাস্তায় দাঁড়িয়ে সাধারণ মানুষ অত্যাচার করি বলে আমাদের বাড়ি ভাড়াও দেওয়া হয় না। আমরা এসব না করলে মানুষ আর আমাদের মন্দ বলবে না। আর সে জন্যই চাই নিজেদের পায়ে দাঁড়াতে। এই ট্রেনিংয়ের পর যদি সরকার আমাদের আর্থিকভাবে সহায়তা করে তাহলে আমরা স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার সুযোগ পাব।’

মাঝবয়সী কয়েকজন হিজড়া অনেকটা ক্ষোভের সুরেই বললেন, ‘কোনো বাড়িতে সন্তান জন্মলাভের খবর পেলেই হিজড়াদের অনেকে সেই বাড়িতে ছুটে গিয়ে টাকার জন্য অত্যাচার শুরু করে। বিয়েবাড়িতে গিয়ে কিংবা রাস্তায় বরযাত্রীর পথ রোধ করেও জুলুম করা হয়। এটা একটা অপসংস্কৃতিতে দাঁড়িয়ে গেছে। আর এতে করে মানুষ আমাদের প্রতি ত্যক্ত-বিরক্ত।’

জ্যাকলিন পপি হিজড়া নামের একজন নিজেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সরকারি কলেজের মাস্টার্সের ছাত্র বলে দাবি করেন। প্রকৃত নাম-ঠিকানা গোপন রাখার শর্তে তিনি বলেন, “ছোটবেলা থেকেই নানা হয়রানির শিকার হয়েছি। চাকরির আবেদনপত্রে ‘পুরুষ’ লিখলে আমার হাবভাব দেখে ‘হাফ লেডিস’ বলে মন্তব্য করে চাকরি থেকে বঞ্চিত করে। এখন আমার মা-বাবা বলছে হিজড়াদের সঙ্গে মিশলে আমাকে সম্পত্তি দেবে না। এ কারণে আমি বাড়িতে অনেক কথাই বলি না। বিউটি পার্লার দেওয়ার আমার যে স্বপ্ন ছিল তা এই প্রশিক্ষণের মাধ্যমে পূরণ হবে বলে আশা করছি।”

প্রশিক্ষণ কর্মশালায় গিয়ে দেখা গেল, নির্ধারিত সময় সকাল ১০টার মধ্যেই হাজির হয় অংশগ্রহণকারী সব হিজড়া। তারা মনোযোগসহকারে চুল কাটাসহ রূপচর্চার প্রশিক্ষণ নিতে শুরু করে। এ ছাড়া তাদের মনোগত পরিবর্তনের অনেক কথা বলা হয়। প্রশিক্ষণের শেষ দিকে আশা, তানভীর, শীলা, কিরণমালা, কাজলসহ আরো অনেকে নেচেগেয়ে ও অভিনয় করে পুরো প্রশিক্ষণ কক্ষ মাতিয়ে তোলে।

হিজড়াদের জীবনমান উন্নয়নে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেন কুমিল্লার আবুল কাশেম। অগ্নিবীণা সমাজকল্যাণ সংস্থার এই নির্বাহী পরিচালক কালের কণ্ঠকে জানান, তিনি নিজেও হিজড়া। গুরুর দেওয়া নাম অনুসারে সবাই তাঁকে কাশ্মীরি হিজড়া বলে চেনে। ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ৩০০, কুমিল্লায় ২৮০, চাঁদপুরে ৩০০, নোয়াখালীতে ২৫০ ও ফেনীতে ২০০ জনের মতো হিজড়া আছে বলে জানান তিনি।

প্রশিক্ষণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘আমাদের ভালো লাগার জায়গা হচ্ছে সাজগোজ করা। আর এখান থেকেই সরকার কাজটা শুরু করেছে। আমি মনে করি, এটা আমাদের জন্য খুবই ভালো একটা উদ্যোগ। এ উদ্যোগের ফলে আমাদের জীবনমানের উন্নয়ন হবে।’

প্রশিক্ষক স্মৃতি সবুর বলেন, “অল্প কয়েক দিনেই অংশগ্রহণকারীদের আচার-আচরণ পাল্টাতে শুরু করেছে। আগে কোনো কর্মকর্তা পরিদর্শনে এলে বলত, ‘এই বেডা কেডা।’ এখন কেউ এলেই তারা তাঁকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করে। এখন তারা গুরুর কথার পাশাপাশি আমার কথাও শোনে। বিউটিফিকেশনের প্রশিক্ষণও তারা খুবই মনোযোগের সঙ্গে নিচ্ছে।”

প্রশিক্ষণের সমন্বয়কারী সহকারী সমাজসেবা কর্মকর্তা নূরুল ইসলাম চৌধুুরী বললেন, ‘প্রথমদিকে প্রশিক্ষণটা কী কিংবা কেন এটা ওরা বুঝতে চাইত না। অবশ্য কয়েক দিনেই এ ব্যাপারে তাদের মধ্যে একটা পরিবর্তন এসেছে। সবাই সময়মতো এসে এখানে উপস্থিত হচ্ছে। নিজেদের নিয়েও তারা আশাবাদী হতে শুরু করেছে।’

প্রকল্প সমন্বয় পরিষদের সভাপতি আল-মামুন সরকার বলেন, ‘হিজড়াদের নিয়ে বর্তমান সরকারের সদিচ্ছার প্রমাণ এই প্রকল্প। শুরুতে বিউটিফিকেশন শেখানোসহ বিভিন্ন বিষয়ে তাদের মনোভাবে পরিবর্তন আনার চেষ্টা চালানো হয়। এরপর সেলাই, কম্পিউটার ও হাঁস-মুরগি পালনের মতো প্রশিক্ষণ কর্মসূচি নেওয়া হচ্ছে। আশা করা যায়, এই প্রকল্পের মাধ্যমে হিজড়া জনগোষ্ঠী অনেক দূর এগিয়ে যাওয়ার সুযোগ পাবে।’






Shares